ধারাবাহিক উপন্যাস
তাহার নামটি
(চোদ্দ)
ছাদে টবের পাশে এসে বসেছে পিম। রাতের আলোয় তার চোখ কালচে। ছাদে
এখন হাওয়া দিচ্ছে, ছাদে হাওয়া দিলে
পিম ভয় পায়। চারপাশে সব গাছের পাতা নড়ে ওঠে বলে। গাছের পাতা নড়ে উঠলে পিম ভয় পায়। অজানা
শব্দ হয় বলে। যে কোনো অযাচিত অজানা আওয়াজকে পিম ভয় পায়। তার কান সজাগ হয়ে ওঠে, তার রোম খাড়া হয়ে যায়। তখন ঘেরাটোপ খোঁজে পিম, ঠিক গুনে গুনে চারটে দেওয়াল। সেইখানে গরম, সেইখানে আরাম, সেইখানে ঘুম, নাহ্, মানুষের চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয় পিম। ছাদে টবের পাশে উঠে আসে
পৃথিবীর চাঁদ, সেই দিকে তাকাতে অন্ধকারে পিমের
কালচে চোখ চকচক করে ওঠে।
ছাদে এসে দাঁড়ান কাবেরী। তাঁর মেয়ে আজ দুপুর থেকে নিখোঁজ। সন্ধ্যে
থেকে মাছ পোড়ার গন্ধ পাচ্ছেন তিনি।
আকাশে তবু চাঁদ উটেচে। তাতে কোনো অনুজ্জ্বলতা নেই। রুপোর থালাটির
মতন চাঁদ উটেচে, এক্কেবারে গোল। মেগও নেই কোন।
টগরের মায়ের মোচা মেজের চেয়ে ঢের পরিষ্কার লেপাপোচা আকাশ। কে এমন করে পরিষ্কার করে
রাকে?
কার এত সময়! বিশ্ব বম্মান্ড ঘুরিয়ে, দশটাকে মেরে, বিশটাকে পয়দা করিয়ে, পাঁচটাকে নিকোজ
করে দিয়ে,
তারপরও আকাশকানা পরিষ্কার করবার সময় পায় পোড়ারমুকো। কই কাবেরী
তো পাননা এত সময়, কাবেরী তো পাননি
সেদিন! সিঁড়ির পাশের স্টোর রুম থেকে খুট খুট আওয়াজ আসচিল বটে, কিন্তু কড়াতে তকন নড়চে ইলিশ মাচ, জিড়ে ফোরনের সাতে তার চলচে দর কষাকষি। স্টোর রুমে খুট খুট আওয়াজটা
বাড়তে বাড়তে যকন গোঙাতে তাকল, কাবেরী বলে উটলেন, “কী হলো গো? আবার কি বাদাচ্চো?” – গলা, মানুষটা গলায় দড়ি
পরচিল তকন। অতচ মাচ পুরে যাবে, স্টোর রুম অবদি ছুটে যেতে গেলে, রুপোর ইলিশগুনো পুরে যাবে গো, কাবেরী সময় পাচ্চেন না উপরে যাওয়ার। অতচ স্টোর রুম গোঙাচ্চে, সিঁড়ি ঘর গোঙাচ্চে। কাবেরী প্রাণপণে নাড়িয়ে চলেচেন খুন্তি, ইলিশ মাচের ঢেউয়ের সাতে লড়চেন, কেমন চকচকাচ্চে ইলিশ মাচ! অল্প লাল হয়ে উটতে কাবেরী সিঁড়ি বেয়ে
ওটেন,
দরজা ভিতর তেকে নাগানো, একটু ধাক্কাধাক্কি করতে অল্প ফাঁক হওয়া দরোজা দিয়ে কাবেরী দেকলেন, ঝুলচে, গলা তেকে ঝুলচে।
নিচ তেকে পোড়া গন্দ উটে আসচে সিঁড়ি বেয়ে, হইহই করে উটে আসচে মাচ পোড়া গন্দ, পড়িমরি করে কাবেরীর নাকে মুকে ঢুকে আসচে জ্বলা পোড়া ইলিশের গন্দ। কাবেরীর খেয়াল
হয়,
মাচেদের কোনো গলা নেই, মাচেদের কোনো গলা তাকে না।
ছাদ ভরে পোড়া মাছের গন্ধ পান কাবেরী, -কার বাড়িতে পুরচে গো! পিমকে কোলে করে কাবেরী ঘরে ফিরে যান।
মেয়েটার চুল লেগে আছে বালিশে। মেয়েটা নেই। মেয়েটার মাথার গন্ধ
লেগে আছে বালিশে। মেয়েটা কই? বালিশ বুকে চেপে
ধরে ঋতম। ফাঁকা ঘর, অন্ধকার। বালিশ
বুকে চেপে ধরে দুলতে থাকে ঋতম রায়। কান্না পায়, কান্না পায়। -কাঁদে না, না না, কাঁদে না, এমন ভাবে কাঁদতে আছে? না না, সব ঠিক হয়ে যাবে, সমস্ত ঠিক হয়ে যাবে। - কোথায় যাবে ও সবকিছু ছেড়ে! সবাইকে ফেলে
রেখে কোথায় যাবে রঞ্জনা! না হয় ঋতমকে ফেলে গেল, সাব্বিরকে ফেলে কোথায় যাবে রঞ্জনা?! সাব্বির! বলো কোথায় গিয়েছে সে? বলো,
সে ঠিক আছে কি না! সাব্বির! জোর করে ঋতমের গলায় চেপে রাখা কান্নাটা
একটা অস্বস্তিকর আওয়াজ হয়ে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। দরজা থেকে অনীতা সরে যান।
মুখে ক্রীমের ফোঁটা মেখে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল গরিমা। দুই
হাত দিয়ে গালে, কপালে, চোখের পাতায়, মুখের সব অংশে অল্প অল্প করে ছড়িয়ে দিতে লাগল ক্রীম। কেমন দেখাচ্ছে আজকে গরিমাকে? সুন্দর, গরিমা সব সময়ই
সুন্দর,
ও তেমনই একজন মানুষ, যাকে দেখলে কিছুক্ষণের জন্য মন খারাপ ভুলে থাকা যায়। গরিমা সবার মধ্যেই একটা রেশ
রেখে যায়। গরিমা একজন রেশ রেখে যাওয়া মানুষ, রেশ রেখে যাওয়া মানুষেরা সবার মধ্যে নিজেদের কিছুটা কিছুটা ছেড়ে রেখে, ফেলে রেখে যায়, অবজ্ঞায়, যেন তার নিজের জন্য যথেষ্ট
রাখা আছে। গরিমার কি সত্যিই নিজের জন্য যথেষ্ট তুলে রাখা আছে? নিশ্চয়ই আছে। অথবা নিজের জন্য তার যথেষ্ট না থাকলেও চলে, গরিমা হয়তো এমনও একজন মানুষ যার নিজের জন্য কিছু না থাকলেও চলে, নিজের সাথে ভাগ বাটোয়ারায় বসার মতো মানুষ গরিমা নয়। তবে গরিমা
ঠিক কেমন?
গরিমা হইয়তো তা জানে না। তার না জানলেও চলে। তবে গরিমার আয়না
জানে,
আয়না জানে গরিমা ভালোবাসে, অথচ গরিমা জানে না। মুখের চারদিকে ক্রীম ঘষতে থাকা আয়নার ছায়া গরিমাকে দেখে। দেখে
দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
গোগ্রাসে জল দিয়ে রুটিগুলো গিলে নিচ্ছে রঞ্জনা। অঞ্জন তার সামনে
হাঁটু মুড়ে বসা, হাতে তার আরো খান তিনেক রুটি।
রুটি শেষ হলে রঞ্জনা বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে অঞ্জনের দিকে তাকায়, “তাপ্পর? কেমন চলচে সব? মুতচিস্ দেওয়ালে দেওয়ালে?”
“পেট ভরেছে তোমার?”
“হ্যাঁ, কিন্তু তুই ওরকম
মরাকান্না জুড়েচিলি কেন মাজরাতে! হুম?! আমি তো ভয় পেয়েই লাইট জ্বালিয়ে ফেললাম... কী রে, কাঁদছিলি কেন? গার্লফ্রেন্ড লাথ
মেরেছে?”
“বেঞ্চের ওপরে বালিশ আর চাদর রাখা আছে, আমি আসি, অনেক রাত হয়েছে, কাল পড়া আছে সকালে”, অঞ্জন স্টোররুম থেকে বেরিয়ে ছাদে এসে দাঁড়ায়, লাল আলো ক্রেন দেখা যাচ্ছে না। দরজা ফাঁক করে রঞ্জনা বলে, “অ্যাই শোন, কেউ যদি জানতে
পারে আমি এখানে, একদম খাল খিচে নেব কিন্তু!” দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে অঞ্জন অস্ফুটে বলে ওঠে, “গাঁড় মেরেছে...!”
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন অনীতা। টেবিলে পড়ে আছে টি. পি.
মাইতি,
রঞ্জনার বালিশের তলায় এই বইটার মধ্যেই চিঠিটা রেখে গিয়েছিল সে।
তার কিছুক্ষণ আগেই রঞ্জনাকে অরীন রায়ের ব্যবহার করা পেন দিয়েছিলেন অনীতা। বলেছিলেন, “লিখো”
রঞ্জনা কিছু বলেনি।
এরপর রাইটিং প্যাড তুলে দিয়েছিলেন তার হাতে, বলেছিলেন, “লিখো”
“কেন এসব করছেন কাকিমা? করুণা বশত?”
অনীতা অবাক হয়েছিলেন, “তোমার কেন এমন মনে হলো?”
“আমি আপনাদের সকালবেলার কথা শুনেছি। আমি কোনো পাখি নই কাকিমা, যে আপনারা অপেক্ষা করবেন কবে সে খাঁচায় ফিরে আসবে, আর তাকে কাগজ কলম ধরিয়ে দিয়ে বলবেন,- লিখো। আমি ফিরবো না কাকিমা, কোথাও ফেরার জন্য আমি আপনাদের কাছে আসিনি”, রঞ্জনা থামে।
অনীতা ধীরে ধীরে বলেছিলেন, “বেশ তো, তবে চলে যেও!”
ঠিক এর আধঘন্টা পরে টি. পি. মাইতির মধ্যে চিঠিটা রেখে রঞ্জনা
বেরিয়ে যায় ঋতমের বাড়ি থেকে। অনীতা দরজা লক করে দেন।
অনীতা এখন অনেকগুলো পুরনো ডায়েরি নিয়ে বসেছেন। সব কটা ডায়রির
শেষ পাতা খুলে খুলে দেখছেন। অবশেষে একটা পাতায় এসে তিনি স্থির হলেন, ডায়েরি হাতে টেলিফোন সেটের কাছে গিয়ে বসলেন, শান্ত ভাবে ডায়াল করলেন একটা নাম্বার,
“হ্যালো,”
“আমি অনীতা বলছি”
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসে না।
কিছুক্ষণ পর অরীন রায় বলে ওঠেন, “কেমন আছো?”
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন