চাঁদের পাহাড়ের কথা
আফ্রিকা বলতেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেরেঙ্গেটির
জঙ্গল। পাল পাল পশু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে, বা এক দল হরিণের পেছনে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক বাঘের
সতর্ক নজর, ঘুমিয়ে পড়ার আগে সিংহর
বিশাল হাই তোলার দৃশ্য অথবা গাছের ডালে চিতার লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকা! অথবা ঘন
জঙ্গলের ভেতরে কোনো আদিবাসী গ্রামে আগুন ঘিরে এক দল আধা ন্যাংটো নারীপুরুষের হুল্লা হুল্লা নৃত্য!
ডাইনী বিদ্যা, তুকতাক, ব্ল্যাক ম্যাজিকের দেশ আফ্রিকা, গোবি মরুভূমির দেশ আফ্রিকা, চাঁদের পাহাড়ের দেশ আফ্রিকা – এই তো ধারণা ছিল মাত্র! একদিন ভাবলাম, এদের সাহিত্যের ইতিহাস একটু নেড়েচেড়ে দেখি। আর চমৎকৃত হলাম! অনেকটা আমাদের
দেশের মতোই শুরু। প্রথমে শ্রুতি নির্ভরতা, তারপর সেই শ্রুতির ওপর ভিত্তি করে লেখার হরফের প্রবেশ। আর
বেশিরভাগ সাহিত্যের বিষয় ধর্মীয় বা ঐতিহাসিক। পরবর্তীকালে সমসাময়িক প্রসঙ্গ এসেছে, বৃটিশ বা পাশ্চাত্যের উপনিবেশ তৈরি হওয়ার ফলে সেখানকার
আধুনিক সভ্যতার সুফল যেমন আমাদের দেশও পেয়েছিল, আফ্রিকাও সেরকমই ফল পেয়েছে। আর তারপরেই এসেছে রেসিজম, নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির সংঘাত। আমি
মোটামুটি ভাবে আফ্রিকার সাহিত্যের শুরু থেকে এই সংঘাতের সময় পর্যন্ত চলনটা ধরার
চেষ্টা করেছি আমার লেখায়।
আফ্রিকান সাহিত্য মূলত প্রথাগত মৌখিক উপাদানের ওপর
নির্ভরশীল ছিল। সেই উপাদান ও পরবর্তীকালে ও অ্যাফ্রো-এশিয়াটিক এবং আফ্রিকান ভাষায়
যে লিখিত সাহিত্য রচিত হয়েছে – এই দুইয়ের
মিলিত ফসল রয়েছে আফ্রিকান সাহিত্যের ভান্ডারে। প্রথাগত লিখিত সাহিত্য সীমাবদ্ধ ছিল
খুব ছোট ভৌগলিক অঞ্চলে, যা কিনা
সাব-সাহারান কালচারের অঙ্গ এবং এর উৎপত্তি আবার মেডিটেরেনিয়ান কালচার থেকে।
নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, উত্তর
নাইজিরিয়া ও সোমালির পন্ডিতরা হওসা এবং আরবি ভাষায় প্রথাগত সাহিত্য সৃষ্টি
করেছিলেন। এছাড়াও ইথিওপিয়া অঞ্চলের দুটি ভাষা, গি’জ ও অ্যামহারিক-এ লেখা হয়েছিল কিছু সাহিত্য। প্রসঙ্গত, ইথিওপিয়া অনেক আগে থেকেই খ্রীস্টান সভ্যতার ছোঁয়া পেয়েছিল।
বিংশ শতক থেকে ইউরোপিয়ান ভাষায় আফ্রিকায় সাহিত্যের কাজ শুরু হয়। প্রথাগত মৌখিক ও
লিখিত সাহিত্য এবং আধুনিক মৌখিক ও লিখিত সাহিত্যের মধ্যে সেতু তৈরি করতে গেলে এখন
আমাদের যোজন দূরত্ব হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই সম্পর্কের জটিলতা ভেদ করা সহজসাধ্য ব্যাপার
নয় মোটেই।
প্রথমেই আসি মৌখিক প্রথার কথায়। কথকের ভূমিকাই এখানে প্রধান।
তিনি বলবেন, সময় থমকে যাবে, আর শ্রোতারা পৌঁছে যাবে ইতিহাসে। যে বর্তমান আমাদের সামনে
উপস্থিত,
সেই বাস্তবকে তিনি পিছিয়ে নিয়ে যাবেন অতীতে। সময় যেন মুখোশ
পরে নেবে তাঁর কথায়। তিনি ও শ্রোতারা তখন সেই ইতিহাসের পাতায় চলে গেছেন। কথক তাঁর
কথা-শিল্প দিয়ে, তাঁর বর্ণিত রহস্য, অনুষঙ্গ, উপমা দিয়ে সেই
সময়কে এমন ভাবে বর্ণনা করতেন যে, শ্রোতাদের
অবচেতনে সেই ইতিহাস প্রবেশ করে যেত। তারা তখন ক’পাতা ইতিহাস মুখস্থ করছে না, তারা তখন সেই
ইতিহাসের সাক্ষী ও ইতিহাসের চরিত্র। এইভাবে দীর্ঘদিন স্মৃতিতে বহন করা হতো ইতিহাস
বা অন্য বিষয়গুলি। যা আধুনিক তথ্য নির্ভর জ্ঞানের থেকে অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ছিল।
সেই কথকতা ছিল জীবন্ত এক প্রক্রিয়া, যা সময়কে কঠিন হতে দিত না। গল্পগুলো সাময়িক ভাবে সমাহিতও
হয়ে যায় না, সবসময়ে বাস্তবের সঙ্গে তাল
মিলিয়ে চলে, কিন্তু সেই চলন থাকে
সময়হীনতার সাজে। এই কারণে এই গল্প বলা শুধুমাত্র স্মৃতিনির্ভর হয়ে থাকে না। যুগের
সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজনীয়তায় ক্রমাগত বাস্তব ও অতিবাস্তবের সঙ্গে মিশে যায়
এই গল্পগুলো। বক্তা বর্তমান থেকে ছবি নিয়ে সেই ছবিগুলি বেঁধে দেয় অতীতের সঙ্গে।
ফলে শ্রোতার চোখে অতীতের ছবিগুলো নিত্যনতুন আকারে তাদের বর্তমানের অভিজ্ঞতায় নতুন
হয়ে ধরা দেয়। বক্তারা সবসময়ে মানুষের সুখ, দুঃখ,
সমাজ, পৃথিবী, আচার-আচরণের খোঁজখবর রাখতেন। এবার সেই বক্তার শিল্পী
সত্ত্বা সুতো তৈরি করতেন, গল্পকার
সুতোটা বেঁধে দিতেন। আর এই বাঁধন ছিল অতীত ও বর্তমানের, মানুষের সঙ্গে তার ঈশ্বরের, তার নেতা, তার সংসার, তার ভালোবাসা, তার আশা ও আশা ভঙ্গের ভয়ের, তার সমাজের
নিত্য প্রয়োজনীয়তা ও বিশ্বাসের।
বক্তা গল্প বলার সময়ে কিছু ছবি, কিছু ছবির স্কেচ, হাতের কাছে রাখতেন। এছাড়া যখন যেমন দরকার নিজের গলা বদলে অভিনয় করতেন। তাঁর
স্মৃতিতে থাকত অতীত এবং সামনে থাকত শ্রোতাদের বর্তমান মানসিক অবস্থান। যে গল্পটি
বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে শ্রোতাদের
নিজেদের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, কল্পনা ও কথকের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণে যে নতুন গল্প
তৈরি হতো,
সময়ের কাছে তা হয়ে দাঁড়াত এক নতুন সময়ের অভিজ্ঞান। কথক কখনই
তাঁর গল্পটিকে পুরোপুরি আঁকতেন না, কিছুটা তৈরি করে ছেড়ে দিতেন পূর্বোক্ত
ঘটনার ওপরে। ফলে সেই গল্প কখনই ইতিহাস হতো না, ইতিহাসের ছায়া নিয়ে, বর্তমান ও
কল্পনার বুনোনে এক নিত্য নতুন গল্পের
সৃষ্টিধারা বয়ে চলত। এক রূপক বা মেটাফোর-এর জন্ম হতো। মিথ-এর ধারণাও
থাকত এবং প্রায় প্রত্যেক গল্পেই ঈশ্বরকে প্রধান ভূমিকায় রাখা হতো প্রথমটায়। এরপরে পরিবর্তন ঘটে চলত নিত্য নতুন
ভাবে। যুদ্ধের গল্পে যেমন হিরো থাকত একজন, পরে ক্রমশ বদলে যেত পাত্র-পাত্রীর ভূমিকা। প্রত্যেক মৌখিক প্রক্রিয়াগুলি
ইতিহাসের ছায়ায়, এক কল্পিত দৃশ্যের ধারণার
ওপর ভিত্তি করে তৈরি করত এক একটি রূপক বা মেটাফোর। আফ্রিকান স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা
নির্ভর এই সংস্কৃতি থেকেই উঠে এসেছিল এক আন্তর্জাতিক শিল্পের রূপ।
হেঁয়ালি
এবার হেঁয়ালির কথায়
আসি। হেঁয়ালি বা রিডল-এর দুটি উদাহরণ দিই আগে।
মুখ
নেই তবুও কলস – (একটি ডিম)
যে
লোকটা নিজের পেট নিজেই টানছে – (ছুঁচ-সুতো)
হেঁয়ালিগুলোতে সাধারণত দুটি অসম বা প্রায় অসম বস্তুর তুলনা
করা হতো। এক্ষেত্রে একটি
জিজ্ঞাসা বা সমস্যা তৈরি করা হতো এবং সব শেষে তার সমাধান বা উত্তরও খুঁজে পাওয়া যেত। সবথেকে
গুরুত্বপূর্ণ ছিল এটাই যে দুটি করে হেঁয়ালি থাকত এবং উত্তর খোঁজার সময়ে একটির উপাদান
অন্যটির দিকে নিয়ে যাওয়া হতো। অবশ্যই এই হেঁয়ালিগুলোয় কো্নো কাব্যিক ব্যাপার থাকত না, সমস্তটাই ছিল
বুদ্ধির খেলা মাত্র। এই দুটি হেঁয়ালি তৈরির সময়ে কল্পনা ও উদ্বেগগুলোর সঙ্গে
শ্রোতার কল্পনা ও উদ্বেগ মিশে যেত। হেঁয়ালির উত্তর খুঁজতে তারা যত চেষ্টা করত, ততই তারা একে একে নিজেরাই সেই হেঁয়ালির অংশ হয়ে উঠত। ফলে
এখানেও সেই রূপকের মাধ্যমে পরিবর্তন বা মেটাফোরিকাল ট্র্যান্সফরমেশন সৃষ্টি হয়ে
যেত। যদিও এই হেঁয়ালিগুলো খুব একটা জটিল ছিল না, তবুও এগুলোর দুটি দশা – আক্ষরিক ও
আলংকারিক-এর মধ্যে একটা সৃষ্টিশীল সম্পর্ক স্থাপন হতো। ফলে এই রূপককে
যত সহজ ভাবা যাচ্ছে, আদপে দেখা
গেছে এরা ঠিক অত সহজও নয়।
লিরিক বা গান
আফ্রিকান গানগুলি সাধারণত কবিতার মধ্যে রূপকের অবস্থান
প্রতিষ্ঠা করে থাকে। তাই ওই হেঁয়ালিগুলোকে এই লিরিকের মোটর বলা যেতে পারে। লিরিকে
একজন গায়ক যদি এক গুচ্ছ হেঁয়ালিকে এক কবিতার বয়ানে আনেন, তো তার কৃতিত্ব কিন্তু ওই হেঁয়ালি বা রিডলেরও কম নয়। গায়ক
প্রত্যেকটা রূপককে একে একে সাজিয়ে সেই কবিতায় পূর্ণতা আনে, এরপর শ্রোতার আবেগকে জড়ো করে ও ধাপে ধাপে নিয়ন্ত্রণ করে এই
পদ্ধতিতে। তখন আর একটাও হেঁয়ালিকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না। হেঁয়ালির অর্থ
লিরিকের ভেতরে ভেতরে বিক্রিয়া ঘটায়, ঘনীভূত হয় ক্রমশ। আর তখনই গায়ক শ্রোতাদের মনে কবিতার নিহিত অর্থটিকে গেঁথে
দিতে সক্ষম হন। এরপরেও কবিতার ছন্দের অনুপ্রাস, কবির বর্ণিত চিত্রকল্প, হেঁয়ালির
সংগঠিত হওয়া এবং গায়কের কন্ঠ, তার শরীরের
ভাষা আবিষ্কার বাকি থেকে যায়। রিডলের মতো এই লিরিকও মেটাফোর বা রূপকের দিকে ঝুঁকে
থাকে।
প্রবাদ
মাটি নরম থাকতে থাকতে ঘড়া বানাও।
জ্ঞান জ্ঞানীকে খুন করে।
আফ্রিকান প্রবাদগুলো প্রাথমিক ভাবে বস্তাপচা অনুভূতিকে
প্রকাশ করে থাকে, কিছু মামুলি
শব্দ বারবার ব্যবহারে যতক্ষণ না ক্ষয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই প্রবাদগুলোও কর্মক্ষম, আর রূপকও বটে। ফলে এগুলোর কাজ আর রূপক একসঙ্গে মিলে ক্ষমতা
পেয়ে যায়। এক দিক থেকে দেখতে গেলে এই প্রবাদগুলো অনেকটা হেঁয়ালি ও গানের মতো এবং
অন্য এক অর্থে এগুলোর ভেতরে ভবিষ্যৎ উপন্যাসের বীজ পাওয়া যাবে। প্রবাদগুলো আসলে রূপকের মাধ্যমে
বাস্তব জীবনের শ্রোতাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে।
গল্প
হেঁয়ালি, গান আর প্রবাদ
এই সবগুলোর উপাদানই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে থাকে। হেঁয়ালির মধ্যে রূপকের
যে সম্ভাবনা থাকে, প্রবাদ
সেগুলোর ব্যাখ্যা করে রূপকের ধারণাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। গল্পের ছবিতে তখন ধরা দেয়
গানের ছন্দ ও সুর। আর এই ছবিতে থাকে দুটি ধারা। একটি হলো প্রচলিত অর্থাৎ বাস্তবিক
পটভূমিকা আর একটি হলো প্রাচীন ঐতিহ্য অর্থাৎ কাল্পনিক জগত। এই দুটি বিপরীত ধারাকে গল্পকার একসঙ্গে ছন্দে বেঁধে দিয়ে
বলতে থাকেন। কাল্পনিক চিত্রের সঙ্গে শ্রোতারা নিজেদের আবেগ মিশিয়ে ফেলতে পারতেন, আর এই আবেগই হলো একটি রূপকের সৃষ্টির কাঁচা উপাদান। ফলে এই
গল্প তৈরির জটিল প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো সরল
উপাদান ও বাস্তবের মেলবন্ধন হতো। একটি গল্প তৈরির
প্রথমে এক আদর্শ সৃষ্টি করা হতো। এবং তারপর একের পর এক উপাদান মিলিয়ে গল্পটি সম্পূর্ণ হতো।
জটিল গল্পের ক্ষেত্রে গল্পকার দুটি চরিত্রকে তিনটি বিভিন্ন
রকমের জগতে ছড়িয়ে দেন। ফলে বিভিন্ন দৃশ্য, বিভিন্ন ঘটনা, ভিন্ন ভিন্ন
রূপকের মাধ্যমে সুরে বাঁধা হতে থাকে। গল্পটির চরিত্রগুলো আর সরল থাকে না, একে অপরের সঙ্গে আলাদা আলাদা সুতোয় জড়িয়ে থাকে। আর সেটাও হয়
রূপকের মধ্য দিয়ে। এভাবেই এক মহাকাব্যর সম্ভাবনা রয়ে যায় সরল গল্পের মধ্যে আর
জটিলের মধ্যে থেকে যায় উপন্যাসের আখ্যান।
বীরগাথা
বীরগাথা বা স্তুতি (panegyric) –তেও গান আর দৃশ্য একসঙ্গে মিশেছে। যেমন হেঁয়ালি, প্রবাদ, গল্প ও গানে রূপক এসেছে, এখানেও রূপকের কাঠামো থেকে যাচ্ছে। এখানে একজন বীর বা হিরো
থাকেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে, যাকে ঘিরে
যাবতীয় কল্পনা, গান বা কাল্পনিক আবহ তৈরি
হয়। এটিও এক দ্বৈত প্রক্রিয়া। ইতিহাসকে নতুন করে বর্ণনা করা হচ্ছে একদিকে, অন্যদিকে বর্তমানের অভিজ্ঞতা মিশে যাচ্ছে এই বর্ণনায়।
মহাকাব্য
মহাকাব্য বা এপিক তৈরি হয় বিভিন্ন অসম্পর্কিত গল্প, নানান রকম রূপক, হেঁয়ালির নিয়ন্ত্রণ মূলক গঠন এবং গান, প্রবাদ ও বীরগাথার সংমিশ্রণে। এখানেও কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন বীর থাকেন।
কিন্তু যত কাহিনী এগোতে থাকে, এই বীর নানা
ভাবে সমস্যার মুখোমুখি হন, যেভাবে একটি
জীবনে মানুষ নানা দিক পার করে আসে, সেভাবেই। এই বীরকে কখনো ধ্বংসের মুখে পড়তে হয়, মানসিক বা শারীরিক ভাবে বিপর্যস্ত হতে হয়, দুঃখ,
দৈন্য, দুর্দশার
মধ্যে এক সংগ্রাম পূর্ণ জীবন কাটিয়ে তিনি আবার নতুন ভাবে বেঁচে ওঠেন, নতুন জ্ঞান লাভের মধ্যে দিয়ে তাঁর নতুন জীবন কাহিনী শুরু
হয়। এই অতি-পরিবর্তন বা মিথিকাল ট্রান্সফর্মেশন সম্ভব হয় সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের
হাতেই। এই মহাকাব্যে ইতিহাস থাকে, স্থান,কাল, পাত্রের
ভূমিকা থাকে, তারপরেও এক সংঘর্ষ মূলক
কাহিনী থেকে যায়। এই কাহিনীগুলো ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে মানুষের সাংস্কৃতিক জগতের
মেলবন্ধন ঘটায়। এক কথায় বলা যায় - গল্প, বীরগাথা, ইতিহাস ও মিথ একযোগে মিলে
এক মহাকাব্যের সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয় চরিত্রটি ইতিহাস নির্ভর হলেও তার মানসিক
অবস্থান বিশ্লেষণ করা হয়, অর্থাৎ
ইতিহাসকে সমসাময়িক দৃষ্টভঙ্গী দিয়ে, মানবিক রূপ দিয়ে দেখা হয়। আর বর্ণনার সময়ে রূপকের ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী হয়ে
থাকে।
মৌখিক ও লিখিত কথকতার ঐতিহ্য কিন্তু পাশাপাশি চলেছে। এবং
একে অপরের ওপর প্রভাবও ফেলেছে। প্রাচীন মিশরীয় লিপি বা প্রথমদিকের হওসা ও সোয়াহিলি
ভাষার সমসাময়িক স্মৃতিধর ও বর্ণনাকারী জনপ্রিয় উপন্যাস লেখকরাই মৌখিক সাহিত্যের
ধারা থেকে লিখিত ধারায় সাহিত্যের পট পরিবর্তন করেন। এরপরে ধীরে ধীরে উত্তর ঘানার
ফুলানি,
সেনেগালের গুয়াং, ওলফ-এর তুকুলর প্রজাতিরা এবং সোমালিয়া ও মাদাগাসকরেও লিখিত সাহিত্যের
অনুপ্রবেশ ঘটে। লিখিত ও মৌখিক সাহিত্যের মাঝে এক মিশ্র সাহিত্যের সূত্রের খোঁজ
পাওয়া যায়। যেমন - লিটারেচার, নাইজিরিয়ার
অনিতশা মারকেট লিটারেচার, আক্রা ঘানার
জনপ্রিয় কল্পিত কাহিনী, নাইরোবির
জনপ্রিয় প্রেম ও গোয়ান্দা গল্পগুলো, কেপ টাউনের দোকানে পাওয়া যেত। তবে এই সূত্রে জনপ্রিয় লেখার পাশাপাশি কিছু জটিল
ও সিরিয়াস লেখারও খোঁজ পাওয়া গেছে। আর এও মানতে হবে আফ্রিকান কোলোনি গঠন হওয়ার
পরেই ক্রিশ্চিয়ান ও মুসলিম ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটে, ফলে আরবি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ ও পর্তুগীজ সাহিত্যের আধুনিকতার প্রভাব আফ্রিকার
সাহিত্যকে আরও উন্নত করে তোলে। আর সব থেকে বড় কথা এই যে, আফ্রিকার সাহিত্যিকরা কারুর অন্ধ অনুকরণ করেন নি, বরং উল্লিখিত সমস্ত ভাষার সাহিত্যকর্মকে নিজেদের ঐতিহ্য
অনুসারে নিজেদের ফ্রেমে ফেলে লিখেছেন।
হিস্ট্রি ও মিথ
মৌখিক সাহিত্যের মতোই লিখিত সাহিত্যেও বাস্তব ও কল্পনার
জগতের মিশেল ছিল। একদিকে যেমন সমসাময়িক
জীবন ও ইতিহাস, অন্য দিকে তেমন মিথ ও হিরো
–
আর রূপকের মাধ্যমে এই দুই জগতের মিশ্রণ ঘটেছে এখানেও।
এখানেও লেখক ইতিহাসের ঘটনাকে বাস্তবের সঙ্গে মিশিয়ে নতুন এক ইতিহাস রচনা করছেন এবং
নিজেও সেই ইতিহাসের এক অঙ্গ হয়ে উঠছেন।
যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকার মানুষ ক্রমশ পাশ্চাত্য
ধারার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। উপনিবেশ সৃষ্টিকারী যে সব জাতিরা এসেছে, তাদের ভাষাকে আপন করে নিয়েছে। যেভাবে দেখা গেছে ইংরেজিতে
আফ্রিকায়,
বিশেষ করে নাইজিরিয়ায় অনেক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি হয়েছে।
এভাবেই ফ্রেঞ্চ, অ্যারবিক ভাষাগুলিতেও
আফ্রিকার মানুষরা সড়গড় হয়ে গেছে। এর মধ্যে ডাচ ভাষার প্রভাবের কথা উল্লেখ না করলেই
নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় দীর্ঘদিন ডাচদের বসবাস। ফলে এমন অবস্থা হয়েছিল যে সাদা
মানুষদের ভাষা হিসেবে ডাচ কৌলীন্য আদায় করে নিয়েছিল, ফলে স্থানীয় আফ্রিকান ভাষাগুলি ব্রাত্য হয়ে পড়ে। এরই প্রভাবে ১৮৭৫ সালে প্রথম
আফ্রিকান ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। স্টিফেনাস জ্যাকোবাস দু টয়েট এবং অন্যান্যদের
নেতৃত্বে আফ্রিকান ভাষাগুলিকে ডাচ ভাষার থেকে পৃথক করার দাবী জানানো হয়। ১৯২৫ সালে
পার্লামেন্ট আফ্রিকান ভাষাকে সরকারী মর্যাদা দেয়। এর মধ্যে যত দিন গড়িয়েছে
আফ্রিকার ভাষার পরিবর্তন ঘটেছে স্বাভাবিক ভাবেই। যেভাবে আমাদের বাংলা ভাষার সাধু
যুগ থেকে ক্রমে কথ্য ভাষায় লেখার রীতি চালু হয়েছিল, সেভাবেই। একঝাঁক অগ্রদূত কবির উদ্দীপনায় শুরু হয় দ্বিতীয় আফ্রিকান ভাষা
আন্দোলন। এঁদের মধ্যে লিপোল্ড, মারাইস, সেলিয়েরস, জ্যাকব
ড্যানিয়েল দু টয়েট বা টোটিউস, ড্যানিয়েল ফ্র্যানকোজ
মালহারব্রে এবং টুন ভ্যান দে হিবার (Leipoldt, Marais, Celliers, Jakob
Daniel du Toit (Totius), Daniel François Malherbe, and Toon van den Heever) ছিলেন অগ্রগণ্য। লিপোল্ডকে আবার একসময়ে আফ্রিকানরা
বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়েছিলেন তাঁর ডাচ ভাষা প্রীতির জন্য! পরবর্তীকালে কবিতার পাশাপাশি
ছোটগল্প,
উপন্যাস, নাটকেও
আফ্রিকান ভাষায় আধুনিকতা ও বিশেষ এক ধারা দেখতে পাওয়া গেছে। ১৯১৩-১৯১৪-র আফ্রিকান
বিদ্রোহের পরে গদ্যরীতিতে পরিবর্তন আসে।
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আফ্রিকার
সাহিত্যে অনেক জল বয়ে গেছে। এই বিষয়ে আমার বক্তব্যকে অযথা দীর্ঘ করব না। ব্যক্তিগত
ভাবে আমি বিশ্বাস করি, যে কোনো ভাষার
সাহিত্যের রস খুঁজতে গেলে তার উৎস মুখে যেতে হয়। শেকড় থেকেই না জল পৌঁছয় পাতায়! ফলে শুরুর দিকটা আমার
জানা হলো,
যা কিনা নেহাতই এক
ইতিহাসের খন্ডচিত্র। মূল সাহিত্যের ভাব বুঝতে গেলে এখনও অনেক ভেতরে, অনেক গভীরে যেতে হবে। তবে যদি আফ্রিকান সাহিত্যের কিছুটা
হলেও ধ্যানধারণা পাওয়া যায়। এই সন্ধানের যাত্রায় এবার যাব। এও চাঁদের
পাহাড় আবিষ্কারের থেকে কম অ্যাডভেঞ্চারাস কিছু না!
(আফ্রিকান শব্দগুলির বাংলা
উচ্চারণে অনেক ভুলভ্রান্তি থেকে গেছে হয়তো। পাঠক নিজগুণে ক্ষমা
করে দেবেন আশা করি।)
সমৃদ্ধ হলাম।অনেককিছু জানতে পারলাম।উৎসাহ পেলাম আর একটু বিস্তারিত জানার।খুব ভালো লেখা...
উত্তরমুছুনভালবাসা নিও
মুছুনসুন্দর উপস্থাপনা । অনবদ্য এবং তথ্য সমৃদ্ধ।
উত্তরমুছুনআলোচ্য রচনার সূত্র গুলি লিখিত চাইছি।
উত্তরমুছুন