বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০১৭

শ্যামশ্রী চাকী

ছাউনি


করিমচাচার টিনের চালে বৃষ্টির জল পরে আর পিছলে যায়, আবার রোদ উঠলেই চকমকি রূপো এহেন একটা টিনের চালের ঘরে ঘুমোবার ইচ্ছে বহুদিনের প্যালার একটাও ফুটোফাটা নেই। ওদের বাড়ির চালের খড় এবছর সেভাবে দেওয়া হয়নি। প্যালার বড়দা দু’ আঁটি কোত্থেকে এনে বিছিয়েছিল, তা অর্ধেক উড়ে গেছে বোশেখী ঝড়ে আর কিছুটা প্যালা চুপিচুপি খাইয়েছে বিন্তি ছাগলিকে। বিন্তি বাচ্চা দেবে ক'দিন বাদে। বেড়িয়ে এর তার ক্ষেতে মুখ দেয় চাষীরা আটকে রাখে বিন্তিকে কাঁঠালগাছটা কাটবার পর পাতা নিয়ে মহা সমস্যা পাড়ার কেউ দিতে চায় না  সবার বাড়ি ছাগল গরু। ঘাস পাতা আজকাল না বলে নেওয়া যায় না সেদিন মাঠের দুটো ঘাস তুলছিল প্যালা, রে রে করে তেড়ে এলো রামজ্যাঠার ছেলে মাঠের ঘাস তোলা যাবে না লিজ না কী বলে সেটা নেওয়া হয়েছে। একটা পাতা ছেঁড়ারও জো নেই।

পথের ধারে দুটো আগাছা ঘাস আছে বলে রক্ষা, সেগুলো তুলে আজকাল বিন্তিকে  দেয় প্যালা। বাদাড়ে জংগলে বাপকে সাপে কাটার পরে মা যেতে দিব্যি কেটে মানা করেছে। আর কী করবে প্যালা, চুপিচুপি ছাউনির খড় দেয় বিন্তিকে তাতেও ক্ষিদে মেটে না। প্যালারও ক্ষিদে পায় খুব।

এখনও পাচ্ছে সকালে এক সানকি পান্তা দু'ভাই ভাগাভাগি করে খেয়ে  বেড়িয়েছিল। ইস্কুল ছুটি, মিডডে মিল বন্ধ সেই মা খড়ি কুড়িয়ে শাকপাতা কুড়িয়ে এনে কখন রাঁধবে, তখন খাবে প্যালা। গ্রামে গরমের ছুটি থাকে ধান বোনার সময়।  বিন্তিটা বিয়োলে দুধ দেবে, বাচ্চা দেবে। প্যালা কিছুতেই দুধ বেচবে না। ওই দুধ খাবে প্যালা আর বাচ্চাগুলো বড় হলে আরো দুধ! প্যালা স্বপ্ন দেখে কলসি কলসি দুধ, প্যালা খেয়ে দাদা খেয়ে মা খেয়েও শেষ হচ্ছে না... পায়েস হচ্ছে, ক্ষীর হচ্ছে। প্যালার মনটা আলো আলো হয়ে যায়।

খুট করে একটা শব্দ হয়, প্যালা হুড়মুড়িয়ে উঠে দেখে মা এক বোঝা কাঠ নিয়ে এলো প্যালা দৌড়ে এসে মাথা থেকে বোঝা নামায় আজ মেটেআলু, কলমিশাক আর গুগলি এনেছে মা। পুকুরপাড় থেকে নেয়ে এসে রান্না চড়ায় মা।

এমন সময় পাড়ার লোকেরা দাদাকে নিয়ে ঢোকে দাদার জ্ঞান নেই, বেহুঁশ! মাঠে পরে ছিল! গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। মা রান্না ফেলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

সদর হাসপাতাল থেকে তিনদিন পর ছাড়া পায় প্যালার দাদা। শরীর দুর্বল, পথ্যি  দিতে বলে ডাক্তার। ওষুধপাতি ফ্রিতেই পায়, কিন্তু পথ্যি! চাল চুঁইয়ে জল পড়ে রাতে ভিজে দাদার এই জ্বর। খড় এখন পায় কোথায়? বাড়ির দাওয়ায় বসে দাদা  আর প্যালা হিসেব কষে। আবার নিকষ কালো মেঘ করেছে! রাতে আকাশ ঢালবে। প্যালার দাদার গায়ে একটা ছেঁড়া কাঁথা। মা কোথায় যেন গেছে।  বিন্তি ছাগলি আর  ক'দিন বাদেই বিয়োবে। প্যালা আর ওর দাদা গল্প করে দুধের, দুজনে মিলে দুধ খাবে গেলাস ভর্তি...


প্যালার মা সশঙ্কোচে করিমচাচার ঘরের দরজায় দাঁড়ায়। চাচির হাতে রুপোর হার আর বাজুবন্ধ তুলে দেয় এগুলো তার শাশুড়ি বিয়েতে দিয়েছিল। ক'আঁটি খড় নিয়ে করিমচাচার ছেলে মায়ের পেছন পেছন বাড়ি ঢুকে বিন্তি ছাগলিকে টেনে হিঁচড়ে  নিয়ে যায়। মা আঁচলের গিঁঠ খুলে  টাকাগুলো লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে রাখে। বিন্তিকেও আধি দিয়েছে মা। বিয়োলে একটা বাচ্চা পাবে শুধু। প্যালার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে দাদা বলে কাঁদিস না, বিন্তির ছানাটা ক’দিন বাদেই বড় হবে, তখন আমরা  দুধ খাবো। প্যালা কিছুক্ষণ পরে চোখ মুছে বলে, বিন্তি কি টিনের চালের ঘরে থাকবে রে দাদা?  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন