ধারাবাহিক উপন্যাস
তাহার নামটি
(তেরো)
সুয্যি পাটে এলে কাবেরী পিম কোলে ছাদে এসে দাঁড়ান। পাশের
বাড়ির ছাদে অঞ্জন বলে ছেলেটা এখন নেই।- কী করে ও সারাদিন ছাতে বসে? পড়াশোনা নেই?
পিমের পিঠে হাত ডুবিয়ে দেন কাবেরী। পায়ের
আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখেন কখন যেন সুনীলও এসে দাঁড়িয়েছেন ছাদে।
“কিচু বলবেন দাদা?”
সুনীল কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন।
“দাদা?”
“ডুবতে থাকা সুর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়, তাই না?”
“হ্যাঁ, তেজ কম হয় তো, তাই”
“হুম, তেজ কম হয়” সুনীল বলেন, আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে
বলে ওঠেন, “কাবেরী,”
“হ্যাঁ দাদা,”
“আমার ধারণা জিজি টিক জায়গাতেই আচে, আর তাই তোমরা এত
নিচ্চিন্ত, কি তাই তো?”
কাবেরী কিছু বলেন না।
“ও ভেবেচে আমি পুলিশে খবর দেবো, কোনোদিনও ওই মেয়ের জন্য আমি
পুলিশের কাচে যাবো না আমি বলে দিলুম! কি ভেবেচে ও, সুনীল মজুমদারকে অপদস্ত করবে
ও!... তুমি সেদিন কিচু বলে উটলে না কেন কাবেরী?”
“আমি খুব ভয় পেয়ে গেচিলাম দাদা, মেয়েটা এমন বেয়াড়া হয়ে
উটেচে...”
“আমি সেদিনের কতা বলচি না”
“তবে?” কাবেরী অবাক হন।
“ওর ছোটবেলায়, আমি বেশ কয়েকবার, ওকে...”
“থাক দাদা, একন এসব কতা বলার মানে নেই”, আবেগহীন স্বরে বলে
ওঠেন কাবেরী।
“তুমি তো মা!” আর্ত শোনায় সুনীলের কন্ঠস্বর।
“হ্যাঁ, আমি মা, আমি আমার দায়িত্ব পালন করিনি, তাই তো? কে
করেচে? ওর বাবা? আপনি? ওর ভাই? কেউ কি ককনো টিকমতো আমাদের দায়িত্ব পালন করতে
পেরেচি?”
পিম লাফ দিয়ে নেমে যায় কাবেরীর কোল থেকে।
“আপনি ওর বাবার দাদা। ওর বাবার ক্ষমতা হতো আপনার উপর গলা
তোলার? না হয়নি তো! গলায় দড়ি দেবার ক্ষমতা
তার বরাবর চিল। সে তাইই করেচে। আমায় কিতার্ত করেচে!” কাবেরী ছাদ থেকে বেরিয়ে ঘরে
ঢুকে যান।
পায়ে নরম কিছু ঠেকতে সুনীল মাথা নামিয়ে দেখেন পিম তার পায়ের
কাছে এসে বসেছে। সুনীল পিমকে কোলে তুলে নেন। পিমের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন,
“ক্ষমা করবি? করবি ক্ষমা?”
চেম্বারে বসে কাজ সারতে থাকা সুনীল মুখ তুলে দেখেন তাঁর
সামনে ঋতম দাঁড়িয়ে,
“তুমি? ককন এলে? বোসো বোসো...” সুনীল ব্যস্ত হতে ঋতম তার
দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দেয়।
“কী এটা?” সুনীল অবাক হয়ে কাগজটা খোলেন...
প্রিয় ঋতম,
তিনি বললেন,
“Life is pleasant. Death is peaceful. It's the transition that's troublesome.”
ভেবেছিলাম আর চিঠি লিখতে হবে না, কত কিছুই তো আমরা শেষবার
করছি বলে ভাবি, কত কত শেষ আসে আমাদের জীবনে, শেষ সিগারেট, শেষ প্রেম, শেষ কবিতা,
শেষ উড়ান। তবু আমরা ভাঙি, ছিঁড়ে ফেলি কবিতার খাতা, নীচের দিকে নামতে থাকি। তুই
কখনও ভেবে দেখেছিস, নীচের দিকে নামতে এত আরাম লাগে কেন?- আসলে টান। এই টান আছে
বলেই নীচে নামতে ভালোলাগে এত। টানটা উপরের
দিকে নেই, থাকলে হয়তো খালি উড়তেই ভালো লাগত। যাইহোক সাব্বিরকে চিঠি লিখতে লিখতে এক
সময় মনে হতো পৃথিবীতে সাব্বির ছাড়া আর কারো ঠিকানা বোধ হয় আমার কাছে নেই। কিন্তু
আজ খেয়াল করলাম, তোর ঠিকানা তুই ছেড়ে গিয়েছিস আমার কাছে। করুণা করে। মায়ের করুণা,
টোটোর করুণা, জ্যের করুণা,- তোর মায়ের করুণা, সমস্ত করুণা জমে জমে ইতিমধ্যে পাহাড়
হয়ে আছে ঋতম। এই অসহ্য ভার পিঠে বয়ে ওড়া আর সম্ভব নয়। ভালো থাকিস,
ইতি, রঞ্জনা।
পুনশ্চঃ তিনি এও বললেন, “Death
is not the greatest loss in life. The greatest loss is what dies inside us
while we live.”
“এ... এর মানে কী? আমি কিচুই বুজতে পারচি না”, সুনীল ঋতমের
মুখের দিকে তাকান।
“রঞ্জনা আজ সকালে লাইব্রেরী
যাচ্ছে বলে বেরিয়েছিল, বিকেলের দিকে মা ওর ঘর গোছাতে গিয়ে বালিশের তলায় এই চিঠিটা
পায়।
“সাব্বির কে?”
“জানি না! আমি জানি না!” চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়ে ঋতম।
রেল লাইনের ধার, গঙ্গার ঘাট, দিল্লি রোডের আশপাশ খুঁজে দেখা
হয়ে গেছে, কোথাও নেই রঞ্জনা। সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরে রাজীব আর অঞ্জন।
“দিদিটা মরে গেলে কী হবে জুলপি!”
“মরবে না, তুই এরকম ভাবছিস কেন?”
“বাবাও তো...”
“তাতে কি হয়েছে? তোর দিদি তো তোর বাবার মতো ছিল না!”
“কিন্তু দিদি খুব বাবা ন্যাওটা ছিল জানিস, সারাক্ষণ বাবার
গায়ে লেপটে থাকত।”
“তুই এসব ভাবিস না, দেখ, কাল সকালে ঠিক ফিরে আসবে বাড়িতে।
আজ হয়তো কোনো বন্ধুর বাড়িতে আছে।”
“আর কোন বন্ধু? তুইই তো আমার সাথে ওর সমস্ত বন্ধুদের বাড়ি
গেলি, ছিল কোথাও?”
“ভেঙে পড়িস না টোটো, ঠিক ফিরে আসবে।”
“আসবে তো? তুই বলছিস যখন তখন ঠিক ফিরবে। তাই না জুলপি?”
“হুম, ঠিক ফিরবে।”
রাজীব বাড়িতে ঢুকে গেলেও অঞ্জন বাড়ি ফেরে না। বড় বটতলা, বেল
সার্কেল, আর এম এসের মাঠে যায়। একটা রাস্তাও বাদ দেয় না, একটা গলিও বাদ দেয় না,
একটা ধুলোও বাদ দেয় না, কিন্তু রঞ্জনাকে পায় না খুঁজে। কোথায় গেল সে? মানুষের
বেলায় কাল কি এত সহজেই বদলানো যায়! গলা অবধি কান্না নিয়ে অঞ্জন বাড়ি ফেরে। কোনো
রকমে সাইকেল রেখে ছাদে উঠে আসে। দূরে ঘুরতে থাকা লাল আলোর ক্রেন তার চোখে পড়ে না। ছাদের স্টোররুমে
ঢুকে দরজা আটকিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে অঞ্জন। ঠিক তখনই স্টোররুমে আলো জ্বলে ওঠে।
অঞ্জনের কান্না থেমে যায়, সে
অবাক হয়ে বলে, “তুমি? এখানে!”
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন