বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০১৭

সুবীর সরকার

উত্তরকথা





(২৫)

‘বাচ্চা বাপই সোনার চান
গরু দুইটা আইলত বান্ধ’

কইকান্তকে রাধাকান্তর দিকে হেলে পরতে হয়।চোখে চোখ রাখতে হয়। জনমভরের এ এক আবশ্যিকতাই হয়তো বা। তাদের অন্তরঙ্গতা দেখে পাখপাখালিরা উড়াল দেয়। সোমেশ্বরী তখন আন্ধনঘরের ভেতর তেলহলুদের এক দিনদুনিয়া নিয়ে পুরনো গল্পের দিকে নুতন গল্পগুলিকেই এগিয়ে দিতে থাকে। এগিনায় হেঁটে বেড়ানো হাঁসমুরগির দল তখন জীবনের জেগে ওঠাকেই যথাযথ করে তুলতে থাকে। গোহালের বুড়ি গাই-এর হাম্বা ডাকের সঙ্গে খিলচাঁদ খামারুর চটকা গান মিশে  যায়-

‘ওরে ধলা মুরগিটা
বাচ্চা ফুটাইছে
ওরে বগিলা চিলাটা
উড়িয়া রে যাছে’

উত্তরের লোকজীবনের ছন্দে ছন্দে এভাবেই সংসারের মায়া সাজাতে থাকে সোমেশ্বরীরা। বুঝি হলখল কাশিয়ার বন। হালাউ হালাউ দুধের ঘটি।



(২৬)

দিনের পিঠে দিন যায়। শীতের জেগে ওঠা নদীর বিশাল সব চরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ময়নামতী কত রকমের পাখি দেখে। ফড়িং-এর পিছে পিছে, প্রজাপতির পাখনায় চলকে যাওয়া সোনা রোদের বাহার দ্যাখে। ময়নার জীবন জুড়ে চারপাশের এই ব্যাপ্ততা একধরনের শূন্যতা এনে দেয়। সে বুঝি বিষাদময়য় মেঘরোদের এক বহতা জীবনকে নিজের সমস্তটুকুর ভেতর তীব্র ভাবে প্রবেশ করাতে থাকে। আর তার শরীরের খুব গোপন থেকে জেগে উঠতে থাকে কেমন এক বুক খালি করে দেওয়া গান-

‘তোমরা যাইবেন অংপুর মইশাল ও
ও মইশাল কিনিয়া রে আনিবেন কি
ও কি বাচ্চা বাপইর নাল বটুয়া
মোরও দাঁতের মিশি মইষাল ও’

গানের ভিতর রংপুর। কোথায় পড়ে থাকছে সেই রংপুর। এত এত দূরে থেকেও ময়নামতি তো গাইতে পারে, নাচতে পারে সেই রংপুরের গানের দোলায় দোলায় ভেসেও যেতে পারে হয়তো বা! সে কি তবে তার মা’ও সোমেশ্বরীর আন্ধনঘরের  দিকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে গেয়েই ফেলে-

‘ও রে অংপুরত হামার বাড়ি
যুবা বয়সের মুই চেংড়ী
কি দেখেন মোর
মুখের ভিতি চায়া’

এতসব ঘটে। ঘটতে থাকে। আর ময়নার চোখের সামনে ভাসতে থাকে রঙ্গরসে ভরা সেই এক মস্ত শহর রংপুর।




(২৭)

রাধাকান্ত কইকান্তকে ইশারা দিতেই কইকান্ত দেখে ফেললো আবারো দুই কুড়ি সাত বছর বাদে দিন দুপুরেই জমে ওঠা মস্ত এক গানবাড়ি। মেলা মানুষজন। ঢোল কাশি বাঁশি দোতোরার সুরে সুরে বাদ্যবাজনায় ভরে ওঠা। নানান রঙের রঙ্গীলা দালানবাড়ি যেন। তখন দূরের সেই দলদলির হাট মুছে যেতে থাকে। গরুর গাড়ি থেকে নেমে পড়ে কইকান্ত আর রাধাকান্ত। তারা পরম বিস্ময়ে দেখে ফেললো এত এত দিন, এত এত সময় পেরিয়ে তাদের থেকে মাত্র হাতকয়েক দূরেই দাঁড়িয়ে আছে কুদ্দুস আর ইয়াসিন। পরস্পরের মুখোমুখি হতেই হলো তাদের। কিছুটা সময় এই দুনিয়ার কোথাও কোনো শব্দ নেই। তারপর কইকান্ত আর রাধাকান্তর বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো কুদ্দুস আর ইয়াসিন। সে এক বারংবার রচিত গল্প। গল্পের পাকে পাকে এ এক চিরকালিনতাই বুঝি! ভরা দুপুরের সেই গানবাড়িতে তখন গান বাজে, বাদ্যের বাইজনের সাথে নাচতে থাকে সোমেশ্বরী হলদীবালা ময়নামতী-

‘বারো মাসে তেরো ফুল ফোটে
বছরে ফোটে হোলা সই
তোমরা না যাইও যাইও
না যাইও সই লো
ওই না যমুনার জলে’

উত্তরের পথে পথে টাড়িতে টাড়িতে এভাবেই আবহমানের সব আখ্যান রচিত হতেই থাকে।













কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন