ডার্করুমে কেউ জেগে
এপাশে ভেজা দ্রবণে মসৃণ কাগজের ওপর একটু একটু জন্মে উঠছে আবছায়া। সাদাকালোর চেয়ে সামান্য উষ্ণ সেপিয়ায়। এদিক ওদিক দ্রবণের ভেতর ধীরে ধীরে ডুবে যায় প্রগাঢ় এক মুখাবয়ব। দেয়ালের ওপাশে হেমন্তের স্ফটিক রোদ মুখ ডুবিয়ে ঘাসের বুকে। কিছু পরে হলুদ পাতা সরিয়ে রেবা কিংবা কাবেরী নদীর শ্বাসে শ্বাস মেলাবে অঢেল সময় ধরে। দরজার বাইরে লেখা আছে - ‘ডার্করুম ইন ইউজ’।
ভেতরে ঘড়ির কাঁটা উল্টো ঘোরে। ডার্করুমে ট্রামলাইন বয়ে যায় ধীরে। আস্ত হরিণ গেলা অজগরের মতো অলস গতিতে। এখানেই হিজল জামের আধঘুমন্ত বনজ স্টেশন অথচ দেশপ্রিয় পার্কের রাত্রিকালীন ট্রাম থামে না,
চলে যায়। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডে এখন একা যে, তার চোখে বনলতা সেন এর পাণ্ডুলিপির রঙ। তার সমস্ত শরীর অবাধ জ্বরের লীলাক্ষেত্র।
তাকে আমি জিজ্ঞেস করিনি- কবিদের নীড়ে কি শুধুই শীতের রাত আর শিশিরের জল? কখনো কি এতে বসন্তের দীপ্তি খেলে যায়? নাকি হামাগুড়ি দিয়ে শুধু পেঁচাই নেমে আসে? প্রশ্ন করা গেল না। ততক্ষণে কেওড়াতলার শ্মশানঘাটে চিতা জ্বলছে। বিকেলের ম্লান আলোয় সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছে লাবণ্য দাশ। কী রইল জীবনে? কীই বা ছিল?
এই তো সংসারের চাকাটা আরেকটু ঘুরে গেলেই মেয়ের চুলে শ্যাম্পু, গালে রোদ্দুর। মেয়ের মা পাটভাঙা শাড়িতে। শাড়ি ভরা স্বচ্ছলতার ঘ্রাণ, সিঁথিতে জোছনা। ছেলের নতুন ব্যাট-বলে ক্লাবের হয়ে খেলা। সন্ধ্যে না হতেই সেদিন ঘরে খুশির চাঁদ ওঠে। সে চাঁদ আলো ঝরায় আর সংসার জুড়ে চিত্ররেখায় আরেক কবিতা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে ফিক্সড ডিপোজিট, ইনস্যুরেন্স, ইএমআই। কেবলই লাইন বড় হয়,
সরকারী ট্রাকের সামনে ন্যায্যমূল্যে কিছু চাল-চিনি, তেল-নুন পাবার আশায়।
যদি বলি আরও এক চাঁদ আছে,
কেবলই আঁধার ছড়ায়। আছে কুয়াশা কাটিয়ে উঠতে না পারার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। অবিরাম হাতড়ে বেড়ানো কিছু। আঁধার ঘরে একটি কালো বিড়াল খুঁজে বেড়ানোর মতো কষ্টকর কিছু। যেখানে বিড়াল বলে আদতে কিছুই নেই। পুত্র-কন্যা-জায়ার কাব্য রচে আদৌ কি অতটা গৃহী হয়ে উঠতে পেরেছি? না-হওয়া-সন্ন্যাসী অথচ গৃহস্থ-না-হয়ে-ওঠা। প্রাত্যহিকতা এসে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ভাবনাকে। সকালের প্রাতঃকৃত্য থেকে রাতের ওষুধ ছাড় দেয়নি কিছুই। ব্যস্ততা বাড়ে। বাড়ে হুড়োহুড়ির
তবু হাওয়ার দিনে কিংবা হাওয়ার রাতে জানালার বাইরে তাকালে ওপাশের কার্নিশে চ্যাপটা, আংশিক সিগারেটে, কমলার টাটকা খোসা দেখতে পাই। সেখানে উড়ে এসে লেপ্টে থাকে মলিন রুমাল কিংবা বহুল ব্যবহৃত অন্তর্বাস। দলিত মথিত রোদ-ধুলো-জলে। বুদ্ধের মতো নিমীলিত চোখে তাকিয়ে দেখি। জীবনের ছড়ানো ছিটানো অক্ষরগুলোই যেন কার্নিশের ওপর জমে আছে। স্ত্রী এসে বাজারের ব্যাগ রেখে গেছে। হতে পারে আজ মন ভালো নেই। ঘুম থেকে ছুটি নিয়ে কারো কাছে যাওয়া হয়নি অথবা কেউ আসেনি। এতে কার কী এসে যায়?
শুধু কবিতার ক্ষতি হয়, আর কিছু কবির।
বর্তমানকে উপলব্ধি করি সামান্যই। তার আগেই সে অতীত হয়ে যায়। তাই অতীতকে যতটা গভীর অনুভব করি, বর্তমানকে ততটা নয়। অতীতও আবার কখনো বিস্তৃত হয়ে বর্তমানের সীমানায় আছড়ে পড়ে। শিউলির গন্ধে শরৎ, জলপাইয়ের গন্ধে শীত আসে। উলের সোয়েটারে হিসেব মতো চলছে ঘর বোনা। একটু বেসামাল টান পড়েছে কী হুড়হুড় করে সব খুলে সোয়েটার আবার শুধুই এক সুতোর গুটলি। সবই তো বৃহৎ পরিবারের অনুষঙ্গ। আজ ছুটি। ছেলের জ্বর বাড়ছে অথচ হঠাৎ ‘নীরা’র জন্য মন কেমন কিংবা সেই
‘অ্যানাবেল লী’র মতো কিছু লিখতে চাওয়া, যে কবিতা আজো হয়ে উঠেনি। সামান্য আঁকিবুঁকি কাটি। কিছু পাগলামী খাতায় তুলে রাখি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পত্রিকা খুললে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, শেয়ার বাজারের নিম্নগামী সূচক, মূল্যবোধের অবক্ষয়। এর মাঝে এক রোম্যান্টিক বিপ্লবীর সাথে আনমনে কিছু বিড়বিড়ানি। ও দিকে মেয়ে ডাকছে, বাবা... খবরের কাগজের বিল দিতে হবে।
ডার্করুমে তবু কেউ জাগে একা। হয়তো এত সহজে সে ঘুমোতে পারে না। সে এক ডেভেলপার নাকি আমিই সে? তরল থেকে কাগজ তুলি। ডুবাই আবার ভাসাই ফিক্সার দ্রবণের ট্রেতে। বিশুদ্ধ পানিতে ধুয়ে নেওয়া তারপর। ঘোরঘুট্টে অন্ধকারে ট্রাম আসার আগেই পা সরিয়ে নিই। পা ছুঁলো কি?
ট্রাম সবার পা ছোঁয় না।
বোধের বিশাল প্রবাহে হিজল জামের বনস্টেশানে কাউকে ডেকেছিল কেউ। শুধু তাই কী অসাধারণ নির্মিত হয়ে উঠতে থাকে একেকটি ছবি!
সুষুপ্তি থেকে জেগে উঠি কিংবা আবার ঘুমিয়ে পড়ি। ততক্ষণে হাওয়া এসে শুকিয়ে দিয়েছে ভেজা কাগজের অবয়ব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন