জন্মদাগ ও মানুষী বিপদ
সব মানুষই নানা জন্মদাগ নিয়ে জন্মায়। তার ভাষা, তার ধর্ম,
তার বর্ণ, তার ভূগোল, তার সংস্কৃতি,
তার অসহায়তা। সব কিছুই সে সঙ্গে নিয়ে আসে। ভূমিষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে সে নানা ছাঁচে ঢালাই হতে শুরু করে। ভিন্ন জন্মদাগের সঙ্গে তার লড়াই সেদিন থেকেই শুরু। কারণ নশ্বর পৃথিবীতে সব কিছু বদলে যায়। শুধু জন্মদাগ বদলায় না।
এই তো কিছুদিন আগেই বেশ ঘনিষ্টভাবে দেখলুম। কী বিকট জন্মদাগের লড়াই। এক ধর্ম, এক বর্ণ, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক ভূগোল। তা সত্ত্বেও অন্ধ্র আর তেলেঙ্গানার লোকজন কী হিংস্রভাবে নিজেদের হেঁসেল আলাদা করে নিলো। তফাতটা কী? তটীয় অন্ধ্রপ্রদেশে ইংরেজ রেললাইন তৈরি করে দিয়েছিলো কলকাতা থেকে তৎকালীন ‘ম্যাড্রাস’ শহর পৌঁছোনো সহজ করতে। এর ফলে ইছাপুরম থেকে বিজয়ওয়াড়া পর্যন্ত দেশের সমগ্র অংশটা পেয়ে গেলো ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ। সরকারি চাকরি আর বিকশিত হবার নানা সুযোগ। কিন্তু নিজামের রাজত্বের অংশ তেলেঙ্গানা আর বিদর্ভ এলাকা এই উন্নতির বাইরে থেকে গেলো। দেশ স্বাধীন হবার পর নিজামের অন্ত হতেই বিদর্ভ আর তেলেঙ্গানার লোকজন তুমুল ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেদের ঘর 'আলাদা' করে নেবার দাবি জানাতে শুরু করেন। একদল সফল হয়েছেন। আরেকদল এখনও হননি। সেই সময় দীর্ঘকাল দেশের ঐ অংশে বসবাসের সূত্রে কাছ থেকে দেখেছি, কীভাবে মানুষ কষ্টকল্পিত, ভিত্তিহীন জন্মদাগের সন্ধান করে হয়রান হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের কী লাভ হলো বোঝা যায় না। কিন্তু বেশ কিছু রাজনীতিকের চতুর্দশ পুরুষের ব্যবস্থা হয়ে গেলো।
এদেশের পূর্বপ্রান্তে যখন ইংরেজ তাদের রাজত্ব শুরু করে, তখন তাদের সঙ্গে সঙ্গে এসেছিলো য়ুরোপিয় জাতীয়তাবাদের নিজস্ব মডেল, যেটা আমাদের দেশের থেকে আলাদা। য়ুরোপে একটা এথনিক জাতি একটা নির্দিষ্ট জাতীয়তাবাদের মডেল অনুসরণ করে। পরে যেটা সর্বনেশে
'নেশনতত্ত্ব' হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ফলত বিশ্বযুদ্ধের রমরমা। আরো অনেক বিষয়ের মতো বাঙালি এই ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদের পাঠও নিয়েছিলো ইংরেজের থেকে। সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকেই বাঙালিরা নিজস্ব জাতীয়তাবাদের একটা মডেল তৈরি করে ফেলেছিলো। পরবর্তীকালে গুরুমারা চেলার মতো সেই জাতীয়তাবাদের পথেই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিহাস বলছে, ইংরেজসংসর্গ করে বাঙালিরা বুঝতে পারে তারাও সাহেবদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে পারে। প্রায় সমানে সমানে। সরকারি চাকরি,
নানা অর্থকরী পেশা,
নতুন সময়ে তৈরি হওয়া নানা সুযোগের সদ্ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালির আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। সেই পর্বটারই নাম বঙ্গীয় রনেশাঁস যুগ। বাংলা জাতীয়তাবাদের শিকড় ছিলো তার মধ্যেই। বঙ্গীয় 'জাতীয়তাবাদ'
সেই হিন্দুমেলা, বঙ্কিমচন্দ্র ইত্যাদি নানা পর্ব পেরিয়ে বেশ বলিষ্ঠ একটা মাত্রা পেয়ে যায়। বেশ মসৃণভাবেই তা বাঙালি অহমেরও ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। উত্তর ও পূর্ব ভারতে তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনও এদেশীয় শক্তি ছিলো না তখন। কিন্তু ইংরেজ বিদায় হবার সঙ্গে সঙ্গে বিহার, উত্তরপ্রদেশ,
ওড়িশা ও অসমে (যেসব জায়গায় ইংরেজি শিক্ষা ও প্রশ্রয়ের সূত্রে সমাজজীবনে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির একটা বেশ প্রকট প্রতিপত্তি ছিলো) প্রচ্ছন্ন স্থানীয় জাতীয়তাবাদ (পুরো বঙ্গীয় মডেলেই) মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ছয়ের দশকের শুরু থেকেই এই সব প্রদেশে আমরা নানাভাবে বাঙালিবিরোধী সেন্টিমেন্ট গড়ে উঠতে দেখি। তার মধ্যে ওড়িশা আর অসমে ব্যাপারটা ছিলো বেশ প্রকট।
বঙ্গীয় জাতীয়তাবাদের যে মডেলটি অনুসারে ওড়িশায় মরাঠি বর্গিদের উত্তরসূরি মধুসূদন রাও প্রমুখ এবং অসমে লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া
নিজস্ব জাতীয়তাবাদের ছাঁচটি প্রস্তাব করেছিলেন, তার শিকড় ছিলো উনিশ শতকে তাঁদের
কলকাতায় পড়াশোনা করার সময়কালে অধীত অভিজ্ঞতা ও ধ্যানধারণায়। আলোকিত হবার তাড়নায় মধুসূদন রাও ব্রাহ্মধর্মও গ্রহণ করেছিলেন সেকালে অনেক বাঙালির মতো। লক্ষ্মীনাথ তো স্বয়ং ঠাকুরবাড়ির জামাই ছিলেন। অসমিয়া আর বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রভেদ নিয়ে তাঁর এবং খুড়শ্বশুর রবীন্দ্রনাথের বাদানুবাদ তো সর্বজানিত। নিজস্ব জন্মদাগের খোঁজে এইসব মনীষী সদাব্যস্ত থাকতেন। ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবোধ তৈরি করার পদ্ধতিটি অসম ও ওড়িশার মানুষ বাঙালিদের থেকেই শিখেছিলেন। ইংরেজদের থেকে জাতীয়তাবাদের পাঠ নিয়ে যেভাবে বাঙালি ইংরেজের বিরুদ্ধেই তা ব্যবহার করেছিলো একদিন, তার পুনরাবৃত্তি আমরা অসম আর ওড়িশার
মানুষদের মধ্যেও দেখেছি। তবে এই দুই প্রদেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিলো বাঙালির সামাজিক প্রাধান্য ও প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক অস্তিত্ত্ব। তবে এই বর্ণাশ্রমের দেশে যাবতীয় জাতীয়তাবাদ শেষ পর্যন্ত জাতিবাদে পর্যবসিত হয়।
হয়তো সবাই নয়,
কিন্তু বাঙালিদের একটা বৃহৎ অংশ কিন্তু ‘উড়ে-মেড়ো-খোট্টা-ছাতু’ সংস্কৃতির অঙ্গ। ইংরেজদের ঔপনিবেশিক অহংকারকে অনুকরণ করে বাঙালিও একসময় নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলো তার অন্যান্য প্রান্তের স্বদেশবাসীর কাছে। সব জাতিকেই এই অহমিকার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে। বাঙালিরা ছাড়া ইংরেজ রাজশক্তির কাছের লোক ছিলেন তামিল সম্প্রদায়। উগ্র মহারাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ বম্বে থেকে তামিলদের বিতাড়ন করেছিলো। পুনে’কে কেন্দ্র যখন নানা ভারিশিল্প গড়ে উঠতে থাকে তখন মরাঠিরা অন্য প্রান্তের মানুষদের সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে অনেক বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। নদীর জলকে কেন্দ্র করে তামিলনাড়ুর সাধারণ মানুষ কর্ণাটকের সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। পঞ্জাবে একসময় কী হয়নি? এদেশে কেউই ব্যতিক্রম ন'ন। শুরু হয় স্থানিক জাতীয়তাবাদ থেকে। কিন্তু অচিরেই তা পৌঁছে যায় জাতিবাদের অন্ধত্বে।
রাজেন্দ্রপ্রসাদ সহায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকালের উজ্জ্বলতম ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা বিষয়ে অতি বড় শত্রুরও কোনও সন্দেহ নেই। স্বাধীনভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ কিন্তু কলকাতায় ছাত্রজীবনে ‘খোট্টা’ হবার অপরাধে নিয়মিত কটাক্ষের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকতেন। পাটনায় থাকাকালীন দেখেছি যখন বাঙালি সিবিআই ডিরেক্টর উপেন বিশ্বাসের উদ্যোগে হাইকোর্টের বাঙালি বিচারক সুধাংশুজ্যোতি মুখোপাধ্যায় লালুপ্রসাদের কারাদণ্ড আদেশ করেন, তখন লালুর দলের গুণ্ডারা গুলজারবাগ,
পাটনা সিটি এলাকার দুশো বছরের পুরনো বঙ্গালি মহল্লায় বাঙালিদের বিরুদ্ধে অনেক গুণ্ডামি করেছিলো। উত্তরভারতের (বিহার ও উত্তরপ্রদেশে) অনেক কায়স্থ ও ব্রাহ্মণরা বাঙালিদের সম্বন্ধে বেশ বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। কারণটি নিতান্ত অর্থনৈতিক। ইংরেজ আসার পর বাঙালিরা সরকারি কাজে কায়স্থদের এবং শিক্ষা ও অন্যান্য লাভদায়ক ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের প্রতিস্থাপিত করে দিয়েছিলো। বিশেষত সিপাহি বিদ্রোহের পর।
কিছুদিন আগে একটি লেখায় মূলত ভূপেন হাজারিকার সঙ্গীত প্রতিভা ও তাঁর জীবনের অন্য কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করেছিলুম। লেখাটি পড়ার পর লক্ষ্য করলুম কয়েকজন মান্য বাঙালি পাঠক তাঁর সঙ্গীত ক্ষমতা বিষয়ে সন্দিগ্ধ না হলেও ব্যক্তি ভূপেনের রাজনৈতিক ও মানবিক রংবদল নিয়ে বিরূপ অবস্থান নিয়েছেন। ভূপেন নবরূপ অসমিয়া জাতীয়তাবাদের একজন আইকন। জন্মদাগ খোঁজার লড়াইটা যখন হবে বঙ্গীয় জাতীয়তাবাদ ও তার অসমিয়া প্রতিভাগীর মধ্যে,
তখন ভূপেনের অবস্থানটি নিয়ে কোনও রকম সন্দেহের অবকাশ কী করে
থাকতে পারে? ‘বঙ্গাল খেদা’ নানা রূপে এদেশে অনেক প্রদেশেই হয়েছে। স্থানিক জাতীয়তাবাদের আগুন যখন বিশেষ একটি
সম্প্রদায়ের দিকে ধাবিত হয় তখন তা দুঃখজনক হলেও বিরল নয়। সারাদেশে অনেক মেধাবী, সৃজনশীল মানুষ এই রকম মনোভাব পোষণ করেন। বাঙালিরাও ব্যতিক্রম ন'ন। বিচ্ছিন্নতাবাদী অসমিয়া জাতীয়তাবাদের আগুনে শুধু বাঙালিদের নয় অন্যান্য অনেক সম্প্রদায়ের আঙুল পুড়েছে। কিন্তু ভূপেনের বিরুদ্ধে অভিযোগটি অনেক জোরালো। কারণ তিনি প্রথমজীবনে বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং জীবনের একটা বৃহৎ অংশ বাঙালিদের সঙ্গে কাটিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি বাঙালিদের দীর্ঘকাল মুগ্ধ করেছে। কিন্তু নব্য অসমিয়া জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে তিনি অসমিয়া অস্মিতাকে বাঙালি আনুগত্যের উপরে রেখেছেন। এটা কী অস্বাভাবিক? কেউ কেউ তাঁকে ‘নিমকহারাম’ও মনে করেন। তাঁকে এসব বলার আগে একটু ভেবে নেওয়া দরকার তাঁকে প্রদত্ত ‘নিমক’টি তাঁর উপার্জন না ‘বাঙালির’ দয়ার দান?
বাঙালিরা দেশের অন্য প্রান্তের সমস্ত ভারতীয়দের শিল্পকৃতির প্রতি একটা উচ্চমন্য পিঠচাপড়ানো অবস্থান নিয়ে থাকেন। এখনও। ভূপেনের গান ভালোবেসে বাঙালি শ্রোতা শিল্পীকে কৃপাধন্য করেছিলো নাকি? বাঙালির এই মনোভাব আমি সারাদেশে দেখেছি। পাটনা, ভুবনেশ্বর, গুয়াহাটি,
তিরুবন্থপুরম বা হায়দরাবদের গুণী সাহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রশিল্পীরা বাঙালির এই মুহূর্তের সৃষ্টির প্রতি সতত সজাগ থাকেন। কিন্তু বাঙালিরা কতটা জানেন তাঁদের সৃষ্টিজগতের খবর? মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তাঁরা আপনহারা মাতোয়ারা হয়ে থাকতেই অধিক অভ্যস্ত।
প্রথম জীবনের ‘জাতীয়তাবাদী’ রবীন্দ্রনাথ যখন পরিণত বয়সে পৌঁছে এই সেন্টিমেন্টের অসারতা অনুভব করেন তখন অক্লান্তভাবে এই মনোভাবের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠেন। এই কারণেই আজ নানা প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল থেকে রবীন্দ্রনাথকে কালোতালিকাভুক্ত করার জন্য প্রবল প্রয়াস চলেছে। বাঙালিদের সৌভাগ্য এতদিন আগেই আমাদের একজন এই বিষয়ে বাঙালিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। আমাদের জন্মদাগ আনুগত্যের বিপদ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু আমরা বোধহয় যথেষ্ট সচেতন হইনি।
ভূপেনের মৃত্যুর পর একটি লেখা পড়েছিলুম। সেখানে ভূপেনের যাত্রাটি সামগ্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার আংশিক উদ্ধৃতি এখানে রাখছি। হয়তো ভূপেনের সম্বন্ধে কিছু বাঙালির মনোভাবের সঙ্গে তা মিলবে না। কিন্তু সত্য যে কঠিন!
“...Contradictions and ambiguities also
followed his engagement with the six yearlong anti-immigrant Assam movement
which started in 1979. On the one hand Hazarika would, supporting the mass
character of the movement, also attest to its principal aim of the expulsion of
peasant migrants from Bangladesh led by the All Assam Students Union (AASU).
And on the other, it was precisely during its heydays, when sentiments were
sharpening against ‘migrants’ conflated with Muslims as a whole, that he
composed and sang ‘Mohabahu Brahmaputra’ where he painted the long history of
migration and assimilation of diverse people which built a composite culture in
the region, singing ‘podda nodir dhumuhat pori, koto xotojon aahiley; luit’or
duyu parote kotona atithik ado riley … kisu lobo lagey, kisu dibo lagey, jin
jaboloi holey… Robindranatheo koley’ (‘caught on the
storm of river Podda, hundreds came, and the banks of the Brahmaputra welcomed
them as guests … take some, give some, to melt into each other…also said
Rabindranath’). Though often interpreted as a liberal plea, this can be read as
a warning of the danger of a sectarian politics of essential sing, of the
aggressive upper-caste Assamese Hindu colour of the movement, which sought to
violently erase this myriad history into extinction. His assertion that ‘we all
have a history of migration and thus we (including the migrants from the
erstwhile East-Bengal, now Bangladesh) must strive to live together’, baffled
both the supporters as well as the opponents of the movement. Many within
AASU began to suspect his support for the movement, as despite his apparent
avowal that the Assamese people are in the danger of becoming homeless in their
own land (the official AASU line), all he had to offer as a solution was a
narrative of migration- hardly a satisfactory answer to the requirements of a
sharp anti-immigrant tenor.” (Taking the
Jajabor’s Journey Forward: Remembering Bhupen Hazarika: Radical Notes: Mayur Chetia & Nayanjyoti: Nov
11, 2001)
‘পলিটিক্সের ধূলিচক্র’ ও অতল পাঁক যখন মানুষকে শ্বাসরুদ্ধ করে তখন শিল্পের অক্সিজেন তাকে বাঁচিয়ে রাখে। ভূপেনের পলিটিক্সে কী কী বিচ্যুতি ছিলো
(অবশ্যই ছিলো) তা ইতিহাস বিচার করবে। তিনি সারাজীবন ক্রমাগত পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক মতের দোলাচলে উদ্ব্যস্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁকে দেখতে পাই নির্দ্বিধায় হাত মিলিয়েছিলেন অতি দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে।
“With
the ever more naked rightist turn in the political life of Assam’s middle
classes in the late 1990s, Hazarika followed suit. With the formation of the
NDA government (Asom Gana Parishad or AGP was part of the coalition) in 1998,
his political journey came to its culmination with viewing the rabidly communal
RSS as the authentic agent of social transformation. He even contested a Lok
Sabha seat from Guwahati (which he fortunately lost) on a BJP ticket in 2004,
with its cadres blaring his humanist plea ‘mahuhe manuhor babey, jodihe okonu
nabhabey…bhabibo kunenu kuwa, xomonia’ (‘if man doesn’t think of man … who
will?’) on their election vans. Under the pressure of RSS, he even tried to
replace the word Axom with Bharat (as Axom is only to be subsumed within the
larger Indian national discourse) in some of his old compositions, but these
modifications never became popular. Hazarika’s use of rhetorical forms, like of
the ‘virgin earth’ and ‘nation as the mother’ and thus someone to be protected,
have been used by patriarchal chauvinists, and this tinge in his content had
itself perhaps led to his ‘straying’ into the right wing fold who today find it
easy to appropriate him as their own." (ibid)
এই দোলাচলের ট্র্যাজেডি হয়তো কিছু সৃজনশীল শিল্পীর অনভিপ্রেত স্বভাবলক্ষণ। স্বয়ং বব ডিল্যান একসময় শুদ্ধ খ্রিস্টিয়তার দিকে ধাবিত হয়েছিলেন। বাঙালির একান্ত সুমনও এই প্রবণতার ব্যতিক্রম ন'ন। এই বিচ্যুতি শিল্পক্ষেত্রে তাঁদের অবদান তুচ্ছ করে দিতে পারে না।
কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের জন্য অন্য একটি প্রশ্নও সমান তাৎপর্যপূর্ণ। সারা উত্তর ও পূর্বভারতে যখন বাঙালিরা ক্রমাগত প্রতাড়িত হতে থাকে তখন তার জন্য কি শুধু স্থানীয় মানুষেরাই দায়ী?
বাঙালির কোনও দায় নেই? স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রদেশেরই ভাষাভিত্তিক গঠন হওয়ার জন্য নিজস্ব অস্মিতার রাজনীতি দিন দিন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তার প্রতি যথাসময় সচেতন না হতে পারার জন্যই বাঙালিরা সেই সব জায়গায় একঘরে হয়ে পড়েছে, যেখানে তাদের এককালে বহুমুখী আধিপত্য ছিলো। এমন কী এই মুহূর্তের মোকাম কলকাতাও তার ব্যতিক্রম নয়। শ্রমবিমুখ, বাণিজ্যবিমুখ বাঙালিজাতির একমুখী সাদাজামার চাকরির আকাঙ্ক্ষা তাকে যাবতীয় পরিশ্রমকেন্দ্রিক অথবা ব্যবসামুখী উদ্যম থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছে। ভিন্ন প্রদেশের যেসব মানুষ দীর্ঘকাল ধরে এই সব পেশা থেকে বাঙালিকে প্রতিস্থাপিত করেছেন তাঁরাও আজ এই শহরে নিজস্ব প্রভাব দেখাতে শুরু করেছেন। বিশেষত রাজনৈতিক ও আপরাধিক জগতে তাঁদের স্বচ্ছন্দ গতিবিধির সঙ্গে ‘ভদ্রলোক’ বাঙালি আর পাল্লা দিতে পারছে না। ফেসবুকে গালমন্দ করে তাঁদের বশীভূত করা যাবে না। প্রভাবচ্যুত বাঙালির ক্ষুব্ধ হবার কারণ হয়তো রয়েছে। কিন্তু দোষটা কার? প্রতিষেধক হিসেবে কিছু দুর্জন লাঠি-তলওয়ার নাচিয়ে ক্ষুব্ধ বাঙালিকে রাজপথে মিছিল করতে প্ররোচনা দিচ্ছে। ঈশ্বর আছেন কি না জানি না। যদি ভুলক্রমেও কেউ থেকে থাকেন তিনি বাঙালিকে এই দুর্যোগ থেকে বাঁচান। এই জন্মদাগের অভিশাপ বাঙালি বহন করতে পারবে না।
ভূপেন বিষয়ে অনেক বাঙালির মনোভাবটিও এই ক্ষোভেরই প্রকাশ। ভূপেনের রাজনৈতিক অবস্থান কোনও ব্যক্তিগত মাত্রা নয়, অসমের নব্য অস্মিতার মুখ। বাঙালিকে যেন এজাতীয় ‘অস্মিতা’র শিকার না হতে হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন