(শেষাংশ)
ভূতকে প্রত্যক্ষ করার জন্য পশ্চিমের দেশের মানুষই প্রথম
প্ল্যানচেটের সৃষ্টি করে। কখনো এক মাধ্যম(যে কিনা একজন রক্তমাংসের মানুষ)-এর ভেতরে
কোনো একজন তাঁর মৃত কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের আত্মাকে স্মরণ করে মনে মনে ডাকেন। আর তারপর সেই মাধ্যমের শরীরে সেই মৃত
আত্মা ভর করে প্রত্যক্ষকারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তখন সেই মাধ্যমের নিজের
গলার স্বর বদলে যায়। এছাড়াও মাধ্যম না থাকলে একটি তিনকোণা বোর্ডের তিনকোণ তিনজন
ধরে মৃত কাউকে স্মরণ করলে আত্মা সেই বোর্ডে এসে উপস্থিত হয়। বোর্ডটির মাঝখানে ফুটো
করে একটি চক লাগানো থাকে। আত্মা এসে ওই চকের সাহায্যে উত্তর লিখে যায়। এই সময়ে
যাঁরা ওই বোর্ড ধরে থাকেন তাঁদের হাতের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তো এই প্ল্যানচেট
ছিল অসম্ভব এক জনপ্রিয় ধারা যা পাশ্চাত্য
দেশ থেকে এদেশেও আমদানি হয়েছিল এবং প্রচলনও। পরে এই ধারার জনপ্রিয়তা কমে আসে
বিভিন্ন ঘোস্ট হান্টারদের জন্য।
ঘোস্ট হান্টার নামের এক অ্যামেরিকান প্যারানর্মাল
রিয়্যালিটি টিভি সিরিজ চালু হয় ২০০৪-এর ৬ই অক্টোবর। যে সব জায়গা ভৌতিক বলে জানা
গেছে, সেই জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে, নানারকম তদন্ত করে প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর
জ্যাসন হয়েস এবং গ্র্যান্ট উইলসন এই শো-এ তার বিবরণ দিতেন। জ্যাসন হয়েস এবং
গ্র্যান্ট উইলসন আর তাঁদের লোকজন দ্য ‘অ্যাটলান্টিক প্যারানর্মাল সোসাইটি’ (ট্যাপস)-এর প্রতিষ্ঠাতা। তদন্ত করার
সময়ে এই দলের সদস্যরা প্রথমে বক্তার মুখ থেকে তাঁর অভিজ্ঞতার খুঁটিনাটি শুনতেন।
এরপর রাতে সেই জায়াগাটি দেখে আসতেন। এরপর অনেক সময় ধরে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড
তৈরি করে সেই জায়াগার তাপমাত্রার পরিমাপ রাখতেন, ইভিপি (এই যন্ত্রের সাহায্যে ভৌতিক শব্দকে পরিবর্তন করে ইলেক্ট্রনিক শব্দে বদলে ফেলা
যায়) –র সাহায্যে শব্দ রেকর্ডিং করতেন, ডিজিটাল ভিডিও ক্যামেরার সাহায্যে ছবি তুলে
রাখতেন। এই কাজের জন্য তাঁরা ডিজিটাল থার্মোমিটার, ইএমএফ মিটার
(ইল্কট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের মধ্যে থেকে এই যন্ত্র বিভিন্ন অস্বাভাবিক কম্পন,
স্পন্দন মাপতে পারে), থার্মোগ্রাফিক ও নৈশকালীন ক্যামেরা, ডিজিটাল ভিডিও ক্যামেরা,
ডিজিটাল অডিও রেকর্ডার ও ল্যাপটপ কম্পিউটারের ব্যবহার করতেন।
এই বছরেই, ১১জুলাই ২০১৬-এ দিল্লির দ্বারকার ৩২বছরের ভূত
শিকারি গৌরব তেওয়ারীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। বাথরুমে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া গেছিল।
তাঁর গলার চারপাশে কালো দাগ পাওয়া গেছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, শ্বাসরোধ হওয়ার
ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। যদিও আত্মহত্যার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে কোনো অশান্তি
তাঁর ছিল না। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি
স্ত্রীকে বলেছিলেন, এক নেগেটিভ ফোর্স তাঁকে মেরে ফেলতে চাইছে। ৬০০০-এর বেশি ভৌতিক
স্থানে তিনি গেছিলেন। ভারতের প্রথম প্যারানর্মাল সোসাইটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
ভূত ধরার জন্য যেমন শিকারি রয়েছে, তেমনি ভূত তাড়াবার জন্যও
রয়েছে ওঝা, গুণিন। এদেশে এবং বিদেশেও। ভূতের অস্তিত্ব বা ভূত শিকারির সফলতা নিয়ে
যেমন সংশয় রয়ে যায়, তেমনই এই ওঝা গুণিনদের পুরো ক্রিয়াকর্মও সংশয় ছাড়িয়ে গিয়ে
মিথ্যে দেখনদারী ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। শিক্ষার আলোর বাইরে থেকে যাওয়া
অন্ধবিশ্বাসী কিছু মানুষ এদের শিকার হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হিস্টিরিয়া রুগীদের
গ্রামবাসীরা ভূতে ধরেছে বলে এই ওঝা বা গুণিনদের কাছে নিয়ে আসে। আর ভূত তাড়াবার নাম
করে কিছু মন্ত্রতন্ত্রের ছলে ঝাঁটা পেটা, লাথি মারা, চুল ধরে আছড়ে ফেলা, গায়ে গরম
জল ঢেলে দেওয়া, এরকম অকথ্য অত্যাচারের শিকার হয় এই রুগীরা। অত্যাচারের ফলে রুগী
যখন মৃতপ্রায়, অচেতন হয়ে পড়ে, তখন এরা ঘোষণা করে – ভূত ছেড়ে গেছে।
এখন যদি ভূত শব্দের অর্থ খুঁজতে যাই, তাহলে দেখব প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, ভূত হলো মৃত ব্যক্তির আত্মা যা জীবিত ব্যক্তিদের সামনে দৃশ্য, আকার গ্রহণ বা অন্য কোনো উপায়ে আত্মপ্রকাশ করতে
সক্ষম। আর আত্মা প্রকৃত পক্ষে কী? আত্মা হচ্ছে জীবনী শক্তির এক
চিন্ময় স্ফুলিঙ্গ যা প্রত্যেকটি দেহকে ক্রিয়াশীল করে, সেটিকে
বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনে সক্ষম করে, ঠিক যেমন ইলেক্ট্রন কণার স্রোত
তামার তারের মধ্যে প্রবাহিত হবার সময় শক-এর সৃষ্টি করে।
দেহকে একটি গাড়ির সঙ্গে আর আত্মাকে তুলনা করা যায় গাড়িটির চালকের সংগে।
আত্মা সেই জীবনের এক স্ফুলিঙ্গ, যার উপস্থিতির ফলে দেহকে জীবন্ত বলে মনে হয়, আর যখন
আত্মা দেহটি ছেড়ে চলে যায়, তখন আমরা বলি যে লোকটি ‘মৃত’। জীবন্ত দেহে রয়েছে চেতনা। ঠিক যেমন সূর্য তার চতুর্দিকে তাপ ও আলোকরশ্মি
বিকিরণ করে, তেমনি আত্মাও সমগ্র দেহে
চেতনা পরিব্যাপ্ত করে। পায়ের ডগা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত – সর্বত্র। দেহে
পরিব্যাপ্ত এই চেতনাই আমাদেরকে চিন্তা, অনুভব বা চলাফেরা করতে সক্ষম করে। অতএব চেতনা হচ্ছে আত্মার লক্ষণ। টমাস হাক্সলি যেমন বলেছেন, “এই বিশ্বে একটি তৃতীয় পদার্থ রয়েছে, অর্থাৎ চেতনা, যাকে আমি আদপেই কোনো জড়
পদার্থ বা শক্তি বলে মনে করি না।” এই চেতনার
অস্তিত্ব আত্মার অস্তিত্বকেই প্রমাণ করে।
তেমনই ভগবদগীতা অনুসারে, আপনি এই দেহ নন। আপনি মন নন। আপনি বুদ্ধিও নন, আপনি মিথ্যা অহঙ্কারও নন। আপনি এই জড় দেহের সমস্ত জড় পদার্থের
অতীত বস্তু। আপনি হচ্ছেন সেই চেতনা, সারা দেহে যা পরিব্যাপ্ত রয়েছে। আপনি হচ্ছেন চির অবিনাশী আত্মা। দেহকে একটি
গাড়ির সংগে তুলনা করা হয়, আত্মাকে তুলনা করা হয়
চালকের সংগে। যদি একটি বোধশক্তিহীন কুকুরের ছানা রাস্তায় কোনো একটি বড় গাড়িকে
আসতে দেখে, তাহলে সে এই ভেবে ভয় পেতে
পারে যে ওটি একটি চার চাকার চলমান বড় কোনো জন্তু। কিন্তু বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ
বুঝতে পারে যে ওটি জন্তু নয়। এক চেতন চালকের হাতে নিয়ন্ত্রিত এক ব্যক্তিত্বহীন
গাড়ি।
গাড়ি হর্ণের সাহায্যে আওয়াজ করে, আপনি মুখের সাহায্যে। গাড়ির চারটি চাকা রয়েছে, আপনার দেহটির দুটি হাত ও দুটি পা রয়েছে। গাড়িটি এক জায়গা
থেকে অন্যত্র চলাফেরা করে, আপনিও সেটাই করেন। কিন্তু গাড়ি থেকে চালক নেমে যাওয়ার পর
ঐ গাড়িটি এমনকি দশ লক্ষ বছরেও এক ইঞ্চি চলতে পারে না। ঠিক তেমনি, যখন একজন মানুষ মারা যায়, শরীরটি তখন পুরোপুরিই
ওই চালক বিহীন গাড়িটির মতো – নিশ্চল, অনড়। সুতরাং
আমরা যে দেহটিকে দেখি তা সবসময়ই মৃত।
আত্মার উপস্থিতির জন্যই দেহকে জীবন্ত বলে মনে হয়। আত্মা যখন দেহ ত্যাগ করে, তখন দেহটি সম্পূর্ণ চলচ্ছক্তিহীন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
শরীরকে একটি খাঁচার সংগেও তুলনা করা হয়, আর খাঁচার টিয়া পাখিকে তুলনা করা হয় শরীরস্থ আত্মার সংগে। ধরুন কেউ খাঁচায় এইভাবে
একটি পাখি পুষে কেবল খাঁচাটিকে সুন্দরভাবে
তদ্বির করছে – যেমন বিশেষ ডিজাইনের
সুন্দর সোনার খাঁচায় পাখিটিকে রেখে প্রতিদিন খাঁচাটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, খাঁচাটিকে ভালোভাবে ঘষমেজে পালিশ করে ঝকঝকে করা
ইত্যাদি। সকলে খাঁচাটিকে দেখে বিমুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করে, এবং তাতে উৎসাহিত হয়ে সে আরো ভালোভাবে খাঁচাটির যত্ন নিতে থাকে।
কিন্তু এসব করতে গিয়ে সে পাখিটির কথা বেমালুম ভুলে যায়। পাখিটিকে দেয় না খাদ্য জল। আত্মা অবিনশ্বর। আত্মা
একজন ব্যক্তি। প্রত্যেক আত্মাই পৃথক পৃথক চেত-সমন্বিত এক একজন ব্যক্তি। আপনি আপনার দেহ, মন, বুদ্ধি ও মিথ্যা অহঙ্কার
সম্বন্ধে সচেতন। আপনার মাথাব্যথা আমি অনুভব করতে পারি না, আবার আমি কি চিন্তা করছি আপনি তা জানেন না। আত্মার রূপ আছে। আত্মা ‘নিরাকার
নির্গুণ জ্যোতি’ বা ‘শূন্য’ কিছু মানুষ
যেমন ভুল করে ভেবে থাকেন। আত্মা হচ্ছে এক সুন্দর ব্যক্তিত্ব, যার দেহ সৎ- চিৎ-আনন্দময়। আত্মা কেবল শক্তি মাত্র নয়, আত্মা একজন পূর্ণচেতন ব্যক্তি। আত্মা শাশ্বত। আত্মার একটি
শরীর রয়েছে, আত্মার
অবস্থান হৃদয-প্রদেশে। আত্মা সারা দেহকে চেতনা
দ্বারা পরিব্যাপ্ত করে,
ঠিক যেমন একটি বাতি সারা ঘরকে আলোয় ভরে দেয়। সারা ঘরকে যে
বাতিটি আলোকোজ্জ্বল করে তুলছে, সেই বাতিটি ঘরের একটি কোণে থাকতে পারে। ঠিক
তেমনি আত্মা হৃদয়-প্রদেশে
(হৃৎ-পিণ্ডে) অবস্থান করেও সারা দেহে চেতনা পরিব্যাপ্ত করে। হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের সময়
আত্মাকে দেহ থেকে সরানো যায় না, কেননা আত্মা চিন্ময় (অ-জড়)। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যখন একটি গাড়ী থেকে স্টেপনী কিংবা রেডিয়েটর সরিয়ে নেওয়া হয়, তখন ঐ
গাড়ীতে বসে থাকা চালকের কিছুই হয় না। আত্মা দেহ-পরিবর্তন করে। ‘বাসাংসি
জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি। তথা শরীরাণি বিহায়
জীর্ণান্য- ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ॥২২॥’ “মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, দেহীও
তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করেন। ” (ভ. গী.-
২/২২)। আত্মা অচিন্ত্য। চুলের অগ্রভাগের
দশ হাজার ভাগের এক ভাগ এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে এমনকি বর্তমানের সবচেয়ে
শক্তিশালী ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপেও তা দেখা অসম্ভব। কিন্তু আমরা যদি এই ইলেক্ট্রন
মাইক্রোস্কোপের থেকেও অনেক শক্তিশালী কোনো অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারেও সক্ষম হই, এবং তার মধ্য দিয়ে আত্মাকে দেখার চেষ্টা করি, তবুও আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। আমরা এমনকি আমাদের
চিন্তাকেও দর্শন করতে পারি না, তা পরিমাপ
করতে পারি না। এমনকি মনও- যা হচ্ছে জড়ের সূক্ষ্ম রূপ- আমাদের কাছে অদৃশ্য, দৃষ্টির অগোচর, অব্যক্ত। সংজ্ঞানুযায়ী আত্মা মনেরও অতীত। এটি কেবল অব্যক্তই নয়, আত্মা আচিন্ত্য, অচিন্তনীয়। আপনি এমনকি এর- চিন্তাও করতে পারেন না।
আর আমি ভূত মানে বুঝি অতীত। যে সত্যিই তাড়া করে ফেরে। মারে
না, কামরায় না, ঘাড় মটকায় না, শুধু তাড়া করে যায় আজীবন। বর্তমানের ঘষে যাওয়ার
সঙ্গে, ভবিষ্যতের হাতছানির সঙ্গে এই ভূতের তাড়াও অব্যর্থ ফল দেয়। অতীতের
ভুলভ্রান্তি থেকেই আমরা শুধরে নিই, নতুন ভাবে শুরু করার সাহস পাই। আবার অতীতের
হারানো সুখকর যা কিছু, তার নস্টালজিয়ায় আমরা আচ্ছন্ন হই। এই অতীতচারণটুকু হলো এক
ধরনের রোমন্থন সুখ, যা চিবোতে গেলে আমাদের চোয়াল ব্যথা হয় না। আর অতীতের যা কিছু বিয়োগ
ব্যথা থেকে যায় মনে, তাদের ক্রমশ ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে একটা সুতোর মত ঝুলে থাকা
দেখি। এই ভূতকে আমরা কেউই কোন ওঝা বা গুণিন ডেকে তাড়াতে চাই না। এই ভূতই না হয়
থাকুক অদৃশ্য হয়ে আমাদের পিছনে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন