ফেরা
কি হয়
তুমি কোথাও চলে যাবে
একথা শোনার পরে আর্তনাদের তীব্রশব্দে ঝরে পড়লো আকাশ
মুহুর্মুহু বজ্রপাতে জানিয়ে দিল তার প্রতিবাদের কথা।
তোমার সাথে নির্বাসনে চলে যাচ্ছে তোমার প্রিয় শহর;
কীনব্রীজের নিচে
সুরমাতীরের স্নিগ্ধবাতাস বয়ে চলা বিকেলগুলো,
ব্যালকনির রকিং চেয়ার,
চায়ের টেবিল,
রাস্তার পাশের ঝাঁকড়া নিমগাছ,
দেওয়াল বেয়ে ওঠা মালতীর ঝাড়
তোমার কথা ভেবে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে অনেকগুলো দিন ধরে,
টবের ক্রিসেন্থিমাম
তোমার জলস্পর্শের অপেক্ষায় ব্যাকুল হয়ে থাকবে বহুদিন।
আবার কবে পাতা উল্টাবে
এই উদগ্রীব অপেক্ষায় থাকতে থাকতে
ধুলোয় মাখামাখি হবে বুকশেলফে,
প্রিয় বইগুলো তোমার।
দেওয়ালের ছবিগুলো
প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে থাকবে কামরার শূন্যতার দিকে।
জানালার বন্ধ কাচে ধাক্কা খেতে খেতে
বাতাসেরা ফিসফিস করে
একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করবে -
‘কেন গেল?
একেবারেই কি গেল?
আর ফিরবে না?’
গেলে কি আর ফেরা হয়?
জানি
এই প্রিয় শহরের কথা ভেবে ভেবে
তোমারও মন কেমন করবে যখন তখন
আঁটসাঁট অস্বস্তিকর পোশাকের মতো
একটা প্রবল বিষণ্নতা
জড়িয়ে ধরবে তোমাকে অবিরাম।
বিকেলের ব্যালকনি,
পাড়ার গলিটা
স্বেচ্ছাচারী-দস্যুর মতো ছিনিয়ে নিয়ে
খেলার মাঠ বানিয়ে ফেলা
কিশোর-কিশোরীর প্রাণবন্ত হৈ চৈ-কোলাহল,
মাঠে নেমে আসা শালিকের ঝাঁক,
বারান্দায় ছড়িয়ে দেওয়া দানা খুঁটে তোলা চড়ুই,
খোলা প্রান্তরের শিরীষ-জারুলের অপরূপ মেলা,
হুডখোলা রিকশায়
শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়ানো খুচরো সময়,
চেনা-আধোচেনা মুখগুলো
পিছু থেকে বারবার ডেকে যাবে।
ডেকে যাবে
এ শহরের আচমকা হুট করে নেমে আসা
বৃষ্টিদিন,
মন আকুল করা সোঁদাগন্ধ,
ভেজা কদম-বকুলের ঘ্রাণ।
তখন কি তুমি ভাববে আবার ফেরার কথা?
একবার কোথাও চলে গেলে
ফেরা যায়?
একবার চলে গেলে
ফিরে এসে অবিকল পাওয়া যায়
এমন ঠিকানা কোথাও হয়তো নেই;
তবু ফেরার আকুতি তো মিথ্যে নয়!
চলে গিয়েও পিছুটান
চলে গিয়েও বারবার
ফিরে আসার আশাটুকু...
ক্যারিকেচার
এক ঢেউসমুদ্রের খুব মন কেমন করা অন্ধকারে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে,
ইচ্ছে করে নিষিদ্ধ করে দিতে
জানালার ফাঁক গলে অনাহুত ঢুকে পড়া
আবছা চাঁদের ছড়ানো ছিটানো পাপড়িগুলো।
দূরে কোথাও একটি 'পিউ কাহা'র কুহুতান
থেকে থেকে না হয় ডেকেই গেলো অনিবার।
যখন আগাপাছতলা দেখে নিলাম একটি সম্পূর্ণ জীবন;
মনে হলো এই দিনযাপনের ছবিটা
উদভ্রান্ত কাঁপা হাতে আঁকা এক ক্যারিকেচার।
ঈর্ষাতুর তাকিয়ে থাকি অনিমেষ
কোথাও আঁকা হয়নি সেই অসম্ভব ছবিটির দিকে।
কত কী যে বদলায়!
নিজস্ব অবয়ব দ্বিধাহীন উহ্য ফেলে রেখে
মহুয়ামাতাল ঘোরে
ভিন্ন কোনো জীবনের ছায়াপাঠে মগ্ন হই।
চিহ্নিত হবার আগেই শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রামক-দুরারোগ্য রোগের কণিকা।
প্রতিচ্ছবি বদলে যায়, রোগাক্রান্ত এক আকৃতি ভেসে ওঠে
তবু প্রতিদিন হাসপাতালের রাস্তার এক ফার্লং দূরপথ দিয়ে হেঁটে গেছি।
জীবন ফুরিয়ে যায় যেমন তেমন;
খোলামকুচির মতো অবজ্ঞায় ফেলে দেওয়া সময়ের হাহাকার তবু বেঁচে থাকে,
গোধূলির রংয়ে বেজে ওঠা বিদায়ী সানাইয়ের ধুনে
জেগে ওঠে শেষ ঘন্টার হা-হুতাশ;
অস্তরাগের আবীরে মাখামাখি কিছু প্রত্যাশাও
বাকি থাকে যেন।
মানচিত্রের বাইরে থেকে পৃথিবীটাকে একবার দেখে নিতে চেয়েছিলাম;
জ্বলজ্বলে লাল দাগের বাইরে যেতে পারলো না চোখ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন