ভীমগড়খেড়ী
“Man doesn’t exit prior to
language either as a species or as an individual” (Roland
Barthes)
এক বুড়ি ছিল। এক্কেবারে থুথ্থুড়ি। বয়স? তা প্রায় শ’খানেক বা
তারও বেশি। কিন্তু
পুরনো গাল্পগল্প করতে পেলে বুড়ি আর কিচ্ছু চায় না। বুড়ির কতক
নিকটজন নাকি সে আমলের দেশ বিখ্যাত সেলিব্রিটি। খুব ছোট ছিল যখন, সেইসব
নামী ব্যক্তিত্বদের সে চাক্ষুস করেছিল। কিন্তু এ গল্প এমনই একঘেয়ে যে আজকাল কেউ আর বুড়ির
ধারকাছ ঘেঁসে না। তাছাড়া চাষী আর মেষপালকদের এত সময়ই বা কোথায়? হাঙরের দাঁতের মতো খাঁজকাটা পর্বতশৃঙ্গ। বারোমাস ধবধবে বরফে ঢাকা। গড়ানে ঢালের মাঝে তাদের ছোটখাটো
জনবসতি। এরা হচ্ছে এক ধরনের পাহাড়ী উপজাতি, তজ্জিক। এসব জায়গায় সচরাচর কেউ আসে
না। আগন্তুক কিশোরটি কিন্তু দু’একদিনেই এদের সঙ্গে ঘুলেমিলে গেল। সারাদিন সে উপত্যকা জুড়ে ঘুরে বেড়ায় আর রাতে বুড়ির মুখে পুরনো গল্প শোনে। খুঙ্খুনে বুড়ি এক সুরে কোনো এক বহুদূর দেশের গল্প বলে চলে – সেখানে আদিগন্ত সমভূমি, গঙ্গা শতদ্রু সিন্ধুর
মতো উথালি নদী, ময়ূরকন্ঠী আকাশ, গাছে গাছে
হরেক প্রজাতির পাখপাখালি – দেশটার নাম ভারতবর্ষ।
বুড়ির প্রপিতামহ তৈমুরলঙ্গ জয় করেছিল সেই দেশ। শুনতে শুনতে স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায় পনেরো বছরের জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর। বিখ্যাত পীর হজরত নসীরুদ্দিন খাজা এই নামটিই রাখেন। তবে গোষ্ঠীর লোকেরা ডাকে ‘বাবুর’। বাবুর মনে মনে ঠিক করে সেও একদিন ওই ভারতবর্ষ
জয় করতে যাবে। এখন সন ১৪৯৮। তার কাছে প্রায় সাতশো সৈন্য
। দুশোর বেশি ঘোড়া এবং ছ’মাসের মতো সঞ্চয় করা বেশ কিছু শুকনো খাদ্য সামগ্রী। কিন্তু হিন্দুস্থানের বাদশা হবার
পথে প্রতিপক্ষ প্রচুর। পারস্যের শাহ ইসলাম, বড়মামা আহমদ মীর্জা, বদকশনের উলুগবেগ … অন্য সবকিছুর মতো গল্পেরও একজন প্রতিপক্ষ আছে। থাকতেই হবে। অথচ গল্পগুলো
লেখা হচ্ছিল বেশ সহজ সরল ও একটানা। তবু প্রতিপক্ষের শ্বাসরুদ্ধকর প্রাচুর্য ও বাকস্বাধীনতা সেই
প্রথম দিনেই গল্পকে ছিন্ন বিছিন্ন করে, প্রকারান্তরে গল্পকে নির্জন দ্বীপে পাঠানোর
চেষ্টায় ক্রমাগত, এবং শেষে, ‘না! গোল হলো না! বল চলে গেল গোল পোস্টের বাঁদিক ঘেঁষে’।
এদিকে গল্পের নায়ক নায়িকারা হরদম বলে যাচ্ছে, তাদের কিন্তু
সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা খুব দরকার। যেমন বর্ষাকালে ধান ও ব্যাকটেরিয়া, শীতঋতুতে পশ্চিমী ঝঙ্ঝাসহ বজ্রগর্ভ মেঘ এবং চুক্তি অনুযায়ী ভারত
বাংলাদেশ নদীজল বন্টনের গল্প ইত্যাদি বেঁচে থাকে যুগের পর যুগ। এদিকে
প্রতিপক্ষ ভীষণ শক্ত ঘুঁটি। গল্প যত গভীর ও সুন্দর হয়ে ওঠে, যত তার গ্ল্যামার বাড়ে,
গল্পের সৃজনশীলতা ততই যেন প্রতিপক্ষের আলোচ্য বিষয় – এই হয় নি, সেই হয় নি! অমুক
জায়গাটা ভালো জমে ওঠেনি ... মাঝখানটা ঝুলে গেছে ... ভাষাটা জোরালো নয়, এবং একদম
শেষে, এর তার থেকে টুকে মেরেছে।
কবি লেখকদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া উচিত। একটা প্রচলিত
কাহিনী এই রকম - বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো নিজে ভীষণই বড়মাপের কবি
ছিলেন। অথচ নগরের
যত বলিয়ে কইয়ে কবি সাহিত্যিক, ধরে ধরে তাদের নির্বাসনে পাঠাতেন। কবি লেখকরা
মানুষের মনে আবেগের সৃষ্টি করেন। তাঁদের চোখে প্রায় সবাই সমান। কোনো ধরনের
শ্রেণী বিভাজন তাঁরা মানেন না। কিন্তু এমনতর হলে তো সমাজ টিকবে না। রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস
হয়ে যাবে।
সুতরাং কিছু বৈষম্য স্বাস্থ্যকর।
আমরা রোজ নতুন নতুন গল্প শুনতে চাই। নতুন কবিতা শুনতে ভালোবাসি।
ভালোবাসি নিত্য নতুন কাহিনী গড়ে তুলতে। ১৪৯৮এর পর আরো কত যে সময় পার হয়ে গেছে ...
কতবার সূর্য উঠেছে আর অস্ত গেছে ... কেউ
কেউ হয়তো তার চূড়ান্ত হিসেব রেখেছেন। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়ে নিত্য কত কাহিনী ধরা দিয়েছে কিংবা এখনও দেয় ...
সময় হারিয়ে গিয়েছে,
সময়ের গল্প বেঁচে রয়েছে।
আমরা রোজ নতুন নতুন গল্প শুনতে চাই ।
উত্তরমুছুন