কালিমাটি অনলাইন
/ ৪৮
সম্প্রতি কলকাতায় আয়োজিত একটি
সাহিত্য সভায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, যেখানে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট
সাহিত্যিক ও কবি উপস্থিত ছিলেন। ‘আরাত্রিক’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক
শ্রীদুর্গাদাস মিদ্যা মহাশয় এবং তাঁর সহযোগিরা এই সভার আয়োজন করেছিলেন। বিশিষ্ট
বক্তাদের মধ্যে কবি ও কথাসাহিত্যিক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, কথাসাহিত্যিক নলিনী বেরা,
কবি শ্যামলকান্তি দাশ, কবি অংশুমান কর, লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরীর প্রাণপুরুষ
সন্দীপ দত্ত এবং আরও অনেকে ছিলেন। প্রত্যেক বক্তাই সমসময় ও সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে
সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্য ও কবিতা সম্পর্কে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। আলোচনা প্রসঙ্গে কবি ও অধ্যাপক
অংশুমান কর বলেছিলেন যে, সাহিত্যচর্চায় পরস্পর পরস্পরের যে সমালোচনা ও নিন্দামন্দ আমরা
করি, তা কাম্য নয়। এক গোষ্ঠির লেখকেরা অন্যান্য গোষ্ঠির লেখকদের লেখা পছন্দ করেন
না, লেখার মানের প্রশ্ন তুলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন, এটা ঠিক নয়। বিশেষত সমকালে সব
লেখকের সব লেখার মূল্যায়ন করাও সম্ভব হয় না, বরং বিচারের জন্য তা ছেড়ে দিতে হয়
মহাকালের হাতে। কিন্তু তাতেও একটা মুশকিল আছে। আমরা, এই পৃথিবী নামের গ্রহের অবুঝ
বাসিন্দারা, যে সব বীভৎস ও ভয়ংকর অত্যাচার করে চলেছি আমাদের গ্রহের ওপর, প্রাজ্ঞ
বিজ্ঞানী স্যার স্টিফেন হকিংস আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আর হয়তো মেরেকেটে একশ বছর এই
গ্রহের অস্তিত্ব থাকবে, তারপর তার ধ্বংস প্রায় নিশ্চিত। সুতরাং মহাকালের বিচারের
আশা করাও নিরর্থক। আর তাই, কে ভালো লিখছেন আর কে ভালো লিখছেন না, তা নিয়ে বিবাদ
করে কী লাভ! সাহিত্যসভায় আমাকে যখন কিছু বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়, তখন
আমি আমার বক্তব্যে অংশুমানের বক্তব্যের রেশ টেনে বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি
কবিতায়, সেই কবিতা লেখার একশ বছর পরের তাঁর কবিতার এক পাঠিকার সঙ্গে দিব্যি আড্ডা
মেরেছেন নিজের লেখা নিয়ে। কিন্তু আমরা যারা একটু আধটু লেখালেখি করি, আমাদের কী দশা
হবে একশ বছর পরে! পৃথিবীটাই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তো কোনো পাঠিকাও জীবিত থাকবে
না! তাহলে আর এত কষ্ট করে লিখে কী লাভ! কার জন্য লিখব! ধরে নিলাম সমকালে আমার
লেখার কোনো আদর বা সমাদর নেই, কিন্তু মনে তো একটা দুরাশা ছিল যে, মহাকাল আমার
লেখার সঠিক বিচার করবে এবং শতবর্ষ পরে কোনো এক পাঠিকা তা পড়বে! কিন্তু এখন তো
দেখছি সেই আশাতেও সেগুড়ে বালি! বিশিষ্ট কবি শ্যামলকান্তি দাশ অবশ্য তাঁর বক্তব্যে
ইদানীং তাঁর কবিতা লেখার অনিচ্ছার কথা জানাতে গিয়ে বলেন যে, তিনি এই সময় ও সমাজের
বিভিন্ন ঘটনা ও পরিস্থিতি দেখে মনে মনে খুব কষ্ট পান। খবরের কাগজ খুললেই শুধু
ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণার খবর। সমাজ ও সময়ের এই
সংকটকালে তাই তিনি আর কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পান না। বলা বাহুল্য, কবি
শ্যামলকান্তির এই ক্রোধ ও ক্ষোভ অত্যন্ত সঙ্গত এবং তা আমাদের মনেও আছে। বহুদিন আগে
শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন যে, সাহিত্যসৃষ্টি করে
যদি সমাজের মঙ্গল করা না যায়, তবে সেই সাহিত্য সৃষ্টি না করাই ভালো। স্বয়ং
রবীন্দ্রনাথ যদিও এমন কোনো ফরমান জারি করেননি, কিন্তু তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টির মধ্যে
ছড়িয়ে আছে শুভবোধ, যা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। এবং একথা তো বলাই যায় যে, প্রত্যেক
কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী যা কিছু সৃষ্টি করেন তা শুভবোধ থেকেই করেন, কোনো অশুভবোধের দ্বারা তাঁরা
পরিচালিত হন না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সমসময় ও সমাজ যে প্রতিদিন বিপর্যয় ও ধ্বংসের
দিকে ছুটে চলেছে, আমাদের শুভবোধ তাকে রক্ষা করতে পারছে না কেন? এত এত
সাহিত্য-শিল্প সৃষ্ট হয়েও অশুভবোধের গলায় শেকল পরাতে পারছে না কেন? মূল্যবোধ
মানবিকতা এভাবে উধাও হয়ে যাচ্ছে কেন? আমি অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রসঙ্গে এখানে যেতে
চাইছি না। শুধুমাত্র এটুকুই উল্লেখ করতে চাইছি যে, আমাদের সাহিত্য ও শিল্পচর্চা এই
সময় ও সমাজকে আদৌ প্রভাবিত করতে পারছে না। আর
তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে তো এই সংশয়ও জাগে, লিখে কী লাভ! একশ বছর পরের কথা
তো সুদূর ভবিষ্যতের ব্যাপার, বর্তমানেই বা তার কতটা প্রয়োজন!
সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। সবাই ভালো থাকবেন। শারদ
শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন।
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com /
kalimationline100@gmail.com
দূরভাষ যোগাযোগ :
08789040217 / 09835544675
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal
Sen, Flat 301,
Phase 2,
Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar,
Jamshedpur 831002,
Jharkhand, India
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন