উত্তরকথা
(২৫)
সেই বড় বন্যার বছর ফুলমালার বাথানে চলে যাওয়া কুদ্দুস ও
ইয়াসিন এত এত দিন পরে আবার ফিরে এসেছে, এই সংবাদ দলদলীর ভরা হাটে ঠিক পৌঁছে গিয়েছিল কইকান্ত ও রাধাকান্তর কাছে। তারা
তখন এক অদ্ভুত উন্মাদনা টের পায় শরীরের পেশী ও স্নায়ুতে। ভরা হাট থেকে দ্রুত
বেরিয়ে এসে তারা গরুর গাড়ির ছই এর ভিতর প্রায় ঝাঁপিয়েই পড়লে, আশেপাশের হাটুয়াদের ভিতর বেশ কৌতুকের জোগান দেয়, যেন বড় শহরের টকিতে দেখে ফেলা কোনো হাসির না ভুলে যাওয়া
দৃশ্যখন্ড। রাধাকান্ত ও কইকান্তর চোখে স্মৃতির এক তুমুল ঘোর। কইকান্ত রাধাকান্তর
দিকে বাড়িয়ে দেয় তামকুহুঁকো। কত কত বছর আগের কুয়াশামাখা রাতের সময়গুলো যেন ফিরে
আসে। হ্যারিকেনের আলোয় পালাগানের আসর। মাঝখানে আসর। তাকে ঘিরে গোল হয়ে চারপাশে শত
শত মানুষ। ছোট ছাওয়া বুড়ির বেটি বুড়ার ঘর মাইয়োর মাও সবাই এসে জুটেছে। আর কুদ্দুস
ও ইয়াসিন ছুকরি সেজে কোমর দুলিয়ে নাচছে। আর রাতের কুয়াশায় রাতপাখিদের ডানায় গিয়ে
হামলে পড়ছে গানের পর গান-
"আরে শ্যাম কালা ও রে শ্যাম কালা
ছাড়িয়া দে মোর শাড়ির আঞ্চল যায় বেলা
বেলা ডুবিলে হইবে রে দেরি
দেরি হইলে মারিবে সোয়ামি রে"
রাধাকান্ত ও কইকান্তর তখন যৌবনকাল। শরীরে মনে উন্মাদনা। আসরে
আসরে ঘুরে বেড়ায়। জীবনের রঙ্গে রঙ্গে দিন কাটে।
(২৬)
কুদ্দুস ও ইয়াসিন ফিরে এসেছে প্রায় এক কুড়ি সাত বছর বাদে। বাপদাদার
ভিটা ছেড়ে কী এক খোঁজে তারা চলে গিয়েছিল চার নদী, ছয় ফরেস্ট, দশ পনেরো বিলপুকুর পেরিয়ে আসাম
দ্যাশের সেই এক মস্ত বাথানবাড়িতে। চারপাশে ঘন জঙ্গল। হাতি বাইসন ময়ূর চিতাবাঘ
বনবিড়াল জঙ্গলিয়া কুকুর বিষধর সব সাপ ভর্তি। মস্ত সেই বাথানে কত কত মহিষ। মহিষের
গলায় ঘন্টি বাজে। বাথানে কত মানুষ। মুনসী ইকবালচাচা, তরণীদা, ময়নামাসী, দিলরুবাখালা, যতন,
আলী, ফয়জল, চুরামনি ভগৎ, বাসন্তী আবো। ভালোয়া
ও টুনটুনি নামে দুই কুকুর সারা বাথান জুড়ে টহল দেয়। আরো আছে বাথান ভরা বেড়ালেরা। বেশ
কাটছিল বাথানের দিনগুলি। কুদ্দুস আর ইয়াসিনের ছিল ঘুরে বেড়াবার নেশা। নাচ ও গানের
পাকে পাকে জড়িয়ে মরার নেশা। বাথানের মহিষের পিঠের ওপর চিত হয়ে শুয়ে আকাশের চাঁদের
দিকে তাকিয়ে গান ধরতো-
"ও তুই একবার আসিয়া সোনার চান্দ
যাও মোকে দেখিয়া রে
অদিয়া অদিয়া যান রে বন্ধু
দাঁড়া না হন পার
ডাহুকির কানদনে আই মুই ছাড়িলং
বাপ ভাইয়ার দেশ রে"
নিশুতি রাতে গানের এই সুর, তরণীর দোতরার, আলীর
সারিন্দায় এক জাদুপৃথিবী নামিয়ে আনতো। জীবন মহার্ঘ্য এক জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দিত তাদের
সামনে, "আচ্ছা, মানুষ বেঁচে
থাকে কেন! আস্ত এক জীবন নিয়ে জনমভর কী করে মানুষ!” মাঝে মাঝে দল বেঁধে তারা চলে
যেত ধুবুড়ির মেলায়। একবার সেখানেই তো তারা শুনেছিল রাজার বেটির সেই সব দেওজিনের
আছর লাগা গান, সাথে কলুর কাঠি ঢোল, সীতানন্দ বুড়ার সারিন্দা। গান নেমে আসতো গদাধরের জল ছুঁয়ে
বালাবাড়িতে-
"ওরে দোন জনে যুক্তি করিয়া রে
ও জীবন আসিলং ভবের হাটে
তুই জীবন ছাড়িয়া গেলু মোকে
নিধুয়া পাথারে জীবন রে"
সে এক জীবন কেটেছিল বটে তাদের। বাথানের মহিষেরা জলে গা
ডুবিয়ে বসে থাকতো। আর কে যেন আড়াল থেকে উন্মনা হয়ে গাইতো-
"বাথান বাথান করেন মৈশাল ও
ও মৈশাল বাথান কইচছেন বাড়ি
যুবা নারী ঘরত থুইয়া
কায় করে চাকিরি মৈশাল ও"
(২৭)
দলদলির হাট থেকে ফেরার পথ যেন শেষ হয় না। কইকান্ত আর
রাধাকান্ত শরীর ভরা পুলক নিয়ে বেশ অনুমান করতে পারলো, কুদ্দুস ইয়াসিনরাও তো তবে বুড়ো হয়েছে। মাথাভরা পাকনা চুল। আচ্ছা
তারা কি আবার সরু কোমর দুলিয়ে ধলা
গিদালের কুশান পালার দলে নাচতে পারবে? এমত সম্ভাবনার
চুড়ান্ত সমাধানে না পৌঁছেও কইকান্তরা কুদ্দুসদের বিয়ে সাদী সংসার টংসার হলো কিনা
এতসবও কিন্তু ভেবেই ফেলে। ভাবনা চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে চলে হুঁকো আর সালাইবিড়ি। এই
যে ভরা কিংবা ভোরে ওঠা হাটের ভিতর থেকে তারা চলে এলো, এরপর তো তারা মুখোমুখি হবে ইয়াসিন ও কুদ্দুসের, আরো অনেকের মতন, অনেক অনেক বছর পরে। এরপরে কি নুতন কোনো আখ্যানের ভেতর আমরা সবাই গিয়ে প্রবেশ
করবো ভরা নদীর জলের মতন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন