ধারাবাহিক উপন্যাস
তাহার নামটি
(এগারো)
রাজীবদের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে অঞ্জন। দুপুর থেকেই। রঞ্জনা
আসেনি আজ, যে সময়ে সে আসে। দু’বার পিম এসে ঘুরে গেছে। রাজীব বা রাজীবের মা কেউই আসেননি। রাজীবের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে
হচ্ছে অঞ্জনের। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে কেন ওর দিদির কথা মনে পড়ল অঞ্জনের, ওই
সময়ে। কিন্তু গতকালের ঘটনার পর রাজীবের বাড়ি যেতে সাহসও হচ্ছে না। খালি ছাদের দিকে
তাকিয়ে থাকে অঞ্জন। সন্ধ্যেবেলার অদ্ভুত হাওয়া এসে এসে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে ফাঁকা
ছাদে। কতটা দূর, এক-দেড় হাত দূরের ছাদটা গতকালের পর যেন অনেকটা দূরে চলে গেছে
অঞ্জনের থেকে। অঞ্জন কিছুক্ষণ নিজেদের ছাদের পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে থাকল, হঠাৎ দু’হাতে
পাঁচিলটাকে ঠেলতে শুরু করল রাজীবদের ছাদের
দিকে। প্রাণপণে ঠেলে যেতে থাকল। বার বার চেষ্টা করতে থাকল দুটো ছাদকে এক করে
দেওয়ার। মিনিট দুই পর ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল অঞ্জন, পাঁচিলে হেলান দিয়ে হাঁফাতে
থাকল। ফের মাথা উঁচু করে দেখল, দূরত্ব একই আছে ছাদ দুটোর। চোখ বুজে ফেলল অঞ্জন।
মাথা থেকে ঘাম ঝরে পড়ছে তার কোলে। আবার মাথা তুলতে তার চোখ পড়ল দূরে থাকা ক্যান্টি
লিভারটার উপর। লাল আলো গায়ে ওটা একদিক থেকে অন্য দিকে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে, দূরে,
নির্মাণ কাজ চলছে।
খাতার দিকে তাকিয়ে বসে আছে রঞ্জনা, পিছন থেকে দেখলে মনে হবে,
বোধ হয় ঘুমিয়েই পড়েছে। তারপর হঠাৎ নড়ে উঠে খচ খচ করে কেটে দিতে থাকে যা লিখেছিল এতক্ষণ ধরে। তারপর পাতাটাকে দলা পাকিয়ে
ওয়েস্ট পেপার বক্সে ফেলে দেয়। এত অবধি দেখে অনীতা ঘরে ঢুকে আসেন, “তোমায় না বলেই
ঢুকে পড়লাম, এই নাও, চা।”
রঞ্জনা মনে মনে বিরক্ত হলেও কিছু বলে না, চায়ের কাপ হাতে
নেয়।
“তোমার কবিতা আমার খুব ভালো লাগে।”
“আমার কবিতা? কোথায় পান?”
“নন্দন বুক স্টলে যা লিটল ম্যাগাজিন আসে, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
কিনে পড়ি।”
“ও, আচ্ছা!”
“ঋতমের বাবাও কবিতা লেখেন, আমাকে নিয়ে তাঁর একটা গোটা সিরিজ
আছে।” অনীতা কথাটা শেষ করতে না করতে রঞ্জনাই বলে ওঠে,
“লাইট পোস্ট দেখেছো?
একলা মানুষের মত লাইট পোস্ট দাঁড়িয়ে থাকে।
একলা মানুষ, দেখেছো অনীতা?”
যেন কিছু আবিষ্কার করেছে, এমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রঞ্জনার মুখ।
“হ্যাঁ।” অনীতা সায় দেন।
“ঋতমের বাবা অরিণ রায়! মানে ‘কাঁচপোকা’-পত্রিকার অরিণ রায়!”
“হ্যাঁ।” অল্প হাসলেন অনীতা।
“আমি ওনার কবিতা পড়ে বড় হয়েছি বলতে পারেন। আমি জানতামই না
উনি ঋতমের বাবা, জানতামই না উনি এখানে থাকেন!”
“না, উনি এখানে থাকেননি, নাম করার অনেক আগেই চলে গিয়েছিলেন,
কলকাতায় - ওনার ফ্যামিলির কাছে।”
“ফ্যামিলি?”
“দ্বিতীয় স্ত্রী, মেয়ে আর উনি।”
“ওহ্, আমি জানতাম না!”
“কাগজে কলমে আমাদের বিয়ে হয়নি যে ডিভোর্সের মতো কাগজে কলমে ছাড়াছাড়ি করতে হবে। আমরা আলাদা হয়ে গেছি, আলাদা
আছি।”
“আর ঋতম?”
“ওর সাত বছর বয়স ছিল তখন। তখন না বুঝলেও পরে নিজের মতো করে
কিছু নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছে। আমি তাতে হস্তক্ষেপ করিনি।” অনীতা মাথা নিচু করলেন।
রঞ্জনা কিছুক্ষণ অনীতার দিকে তাকিয়ে থাকল। মনে মনে বলল,
আমি, একলা মানুষ দেখছি!
চায়ে চুমুক দিয়ে হাসিমুখে রঞ্জনার দিকে তাকালেন অনীতা।
রঞ্জনা বলল, “কাকিমা, আমি একটু লাইব্রেরী হয়ে আসি, ঘন্টা
দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসব।”
“সাবধানে যেও!”
রঞ্জনা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে অনীতা ওয়েস্টপেপার বক্স থেকে
কাগজের দলাটা তুলে এনে টেবিলে মেলে ধরেন, এলোমেলো ভাবে কেটে ফেলা লাইনগুলো পড়তে
থাকেন,
কাগজটা যত্ন করে ভাঁজ করে নিয়ে অনীতা চায়ের ট্রে হাতে ঘর
থেকে বেরিয়ে যান।
আয়নার সামনে বসে আছেন সুনীল মজুমদার। বন্ধ ঘরে খুব জোরে
পাখা ঘুরছে বলে আরাম বোধ করছেন তিনি। ব্যথাটা নেই আর। বুড়ো বয়সে ডাক্তার দেখাতে
হয়নি, এই অনেক ভাগ্যের! দেখাতে হলে কি ব্যাখ্যা দিতেন সুনীল, ভেবে পান না। “ভাইজি
লাতি মেরেচে”, এটা “আমি ভাইজিকে মলেস্ট করেচি”-র চেয়েও লজ্জাজনক সুনীল মজুমদারের কাছে। মেয়েটা এত বছর
পরেও ওই সামান্য জিনিসটা মনে পুষে রেখে দেবে, ভাবতে পারেননি সুনীল। আর কাবেরী,
কাবেরী সব জানত, জেনেশুনেও কিচু বলেনি,
কেন? কারণ বললে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে যে! শাল্লা, সব থেকে মানুষের বড় জিনিস হলো পেট।
কোন্ শুয়োরের বাচ্চা তার হাত থেকে বাঁচবে?
কেউ বাঁচবে না! এক ঢোকে হুইস্কিটা শেষ করে ড্রেসিং টেবিলে সশব্দে গ্লাস রাখেন সুনীল। তারপর উঠে এসে
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যান।
“কাবেরী! কাবেরী!”
“হ্যাঁ দাদা!” কাবেরী সিঁড়ির কাছে ছুটে আসতেই মদের গন্ধ
পান।
“জিজি কোতায়!”
“ইয়ে, মানে, দাদা কাল বিকেলের পর তেকেই তো বাইরে।”
“বাইরে মানে!”
“মানে বেরিয়ে যে গেল, এল তো না...”
“এল না মানে! একটা জলজ্যান্ত মেয়ে, যাবেটা কোতায়! এই
হারামির বাচ্চা টোটো!” চিৎকার করে ওঠেন সুনীল।
রাজীব ছুটে আসে বারান্দায়,
“তোর দিদি কোতায় জানিস?”
“না জ্যে!”
“সত্যিকতা বল, না হলে পিটের চামড়া গুটিয়ে দেবো!”
“সত্যিই জানি না জ্যে!”
“খোঁজ করেচিস কোতাও?”
“না...”
“শালা শুয়োরের বাচ্চা, নিজের দিদি একদিন হলো নিঁকোজ, ঘরে
বসে চুদোচ্চেন উনি! এক্কুনি যা, ওর সমস্ত
বন্দুদের বাড়ি গিয়ে খুঁজে আয়!”
কথা শেষ হতে না হতে রাজীব সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়।
“যাবে কোতায়! এই বাড়ি ছাড়া যাওয়ার জায়গা আচে নাকি! না,
কাবেরী তুমি চিন্তা কোরো না, সে ফিরবেই।”
“হুম দাদা।”
“আমি আসি, টোটো ফিরলে আমায় বোলো।”
সুনীল মজুমদার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকেন - গেল কোতায়!
জ্ঞাতি পরিজনদের বাড়ি গেলে সুনীল খবর পেয়ে যেতেন এতক্ষণে। কিচু হয়নি তো! কিংবা ওর বাবার মতন যদি! বুকটা কেঁপে ওঠে সুনীল
মজুমদারের। সিঁড়ির পাশের স্টোর রুমটার
দিকে চোখ চলে যায় তাঁর। ন’বছরে ক’বার স্টোর রুমের দরজা খোলা হয়েছে তা হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়।
সুনীল স্টোর রুমের দরজাটা হঠাৎ খুলে দেন। ঘরের ভিতর থেকে একরাশ পুরনো গন্ধ যেন
মুক্তি পেয়ে যায় হঠাৎই। সেই গন্ধতে সুনীল মজুমদারের চিন্তারা গুলিয়ে যায়। ছোট্ট স্টোর রুমের ভিতর দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন
সুনীল মজুমদার।
আওয়াজ শুনে সিঁড়ির নীচে এসে দাঁড়ান কাবেরী। কিছুক্ষণ পর
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিজের কাজে
ফিরে যান। সুনীল মজুমদারের কান্না সিঁড়িতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন