শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

অচিন্ত্য দাস

রজতনগর


তা প্রায় সোয়া শ বছর আগে এখানে একটা রূপোর খনি ছিল বছর পনেরো- কুড়ি বেশ রমরমা চলেছিল –  ছোটখাটো শহর গড়ে উঠেছিল চারপাশে তার কিছু পড়ে থাকা ঘরবাড়ি, দোকানপাট, খনির মেশিনপত্র, রেললাইনএসব মেরামত করে পুরনো দিনের লোকালয়ের চেহারা দেওয়া হয়েছে জায়গাটার নাম রেখেছেভূতুড়ে শহর বড় রাস্তা দিয়ে অনেক ট্যুরিস্টের আনাগোনা যাদের  হাতে সময় থাকে, তারা কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে যায়  

দুএকটা মিউজিয়ম, দোকান বেশ কয়েকটা সেখানে সেই পুরনো দিনের খনি মজুরদের কোদাল-গাঁইতি থেকে শুরু করে দেওয়ালে টাঙ্গানো যায় এমন ঘর সাজাবার জিনিস, নানা চেহারার পুতুল, চিনে মাটির ঈগল পাখি, তামার ফলকে যীশুর বাণী এসব সাজানো রয়েছে লাল কালিতে আসল দাম কেটে অর্ধেক দাম লিখেও তেমন খুব একটা বিক্রি হচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না!

আমার কেনাকাটায় আগ্রহ নেই একটা টিলার ওপর সরাইখানা ধরনের  রেস্তোরাঁ সেখানেই গিয়ে বসলাম একথালা মাছ ভাজার সঙ্গে বিয়ার নিলাম   গেলাসে মাছটা ভারি সুস্বাদু, আর ঠাণ্ডা বিয়ারে চুমুক দিয়ে মনে হলো, এ তো তরল অমৃত! এখান থেকে পুরো এলাকাটা দেখা যায় দেখছিলাম আর  ভাবছিলাম, আজ থেকে সোয়া শ বছর আগে ছোট ছোট দলে লোকজন এসে  বসতি করেছে, খনির কাজ শুরু হয়েছে পাথর থেকে রূপো বার করা হতো তা গালিয়ে তৈরি হতো রূপোর চকচকে পাত, রূপোর চৌকো চৌকো ইঁট ঘোড়ার  গাড়িতে পাঠানো হতো দূর প্রদেশে পাশে পাশে চলত অশ্বারোহী পাহারাদার  কিছু যেত রেল গাড়িতে এদিকে শহর জমজমাট হচ্ছে দিনকে দিন জামাকাপড়ের দোকান, জুতোর দোকান, সৌখিন আসবাবপত্র ইসকুল, হাসপাতাল পানশালা, জুয়ারিদের ঠেক, রঙ্গমঞ্চ, নাচঘর, দেহব্যবসা লোকালয় যখন গড়ে ওঠে তখন তার প্রত্যেকটা ইঁট-কাঠের ফাঁকেফোকরে সুখের ছাপ লেগে থাকে থাকে ঘর বাঁধার মেজাজ আর সঙ্গে কয়েক ছটাক আশা তো বটেই

সূর্য হেলে পড়েছে। একটা দোকান বন্ধ করে দুই মহিলা ঘরে ফিরছে। লোকজন কমে এসেছে গোটা কয়েক চিল ধরনের পাখি উঁচুতে চক্কর মারছে। গীটার  বাজিয়ে গান করছিল যে লোকটা সে গীটার শুইয়ে রেখে সারাদিন কত রোজগার হলো গুণছে। মোটকথা বেলাশেষের খালি খালি গোছের পরিবেশ

কী হলো কে জানে, কেমন একটা মন-খারাপ করা অবসন্ন ভাব আমাকে ছেয়ে  ফেলল। আমি যেন অনেক দিন পিছিয়ে গিয়ে এই রূপো শহরের শেষ দিনটা দেখছি। রাস্তার মোড়ে নোটিস ঝোলানো – ব্যবসা  ফেল করে গেছে, খনির কাজ বন্ধ। লোকেরা কেউ বোঁচকা-বুঁচকি কাঁধে, কেউ বা খালি হাতে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

যারা সে সময় চলে গেছিল তারা এখন কোথায়? সেই কতদিন আগের ঘটনা, তাদের তো আর বেঁচে থাকার কথা নয়! তবে আমার মনে হলো তারা সকলে  আসে সন্ধ্যের পর। গাছের ডালে, বাড়ির কার্নিশে, গলিতে, রাস্তায় তাদের সাড়া পাওয়া যায়।

অর্ধেক বিয়ার তখনও বাকি। আমি ঠক্ করে গেলাসটা টেবিলে রেখে বললাম – আমি ভাই ভিনদেশের অতি সাধারণ এক মানুষ। তোমাদের এই রজত নগর দেখে উতলা হয়ে পড়েছিলাম। কী আর দেব তোমাদের, এইটুকু পানীয় রেখে গেলাম... যদি পারো আজ রাতে এর চারপাশে সবাই ঘিরে বসে উৎসব কোরো



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন