আভিজাত্যকে ছাপিয়ে গেল প্রাণের স্পর্শ
শহরের পুজো নিয়ে কোনও কথা না বলাই ভাল। যুগের সঙ্গে তাল
মেলাতে গিয়ে মা দুর্গার জিরো ফিগার আর কালার চুল দেখে মন বড়ই ক্লান্ত। গোটা শহর
জুড়ে শুধু থিমের টেক্কা। রাতের বাহারি আলোয় রূপের বাহার, চুলের ফ্যাশন, আর দেশি মুখে
বিদেশি ক্রিমের ঝলক দেখতে দেখতে আমরা দুর্গাপুজোর সেই সাবেকি রূপটাই ভুলে গেছি।
ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল জমিদার বাড়ির পুজো দেখব। মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন লালন
করতাম। কেমন হয় জমিদার বাড়ির পুজো? তাদের বাড়ির লোকের কেমন লাগে যখন সবাই এসে
মিলিত হয়? সেখানে মা দুর্গার সাবেকি রূপটাই বা কেমন? দুর্গাপুজো মানেই তো প্রথম
প্রেমে পড়া। বনেদি বাড়ির সেই পুজোর নেপথ্যেই হয়তো তৈরি হয়-
‘হৃদয়ের কাছাকাছি
প্রেমের
সেই প্রথম আনাগোনা
সেই
হাতে হাত রাখা
সেই
আধো চোখে চাওয়া
চুপিচুপি
প্রাণের প্রথম জানাশোনা’।
কী মুশকিল! দুর্গাপুজো নিয়ে লিখতে গিয়েও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে
টানাটানি। যদিও
এটা আমাদের জন্মগত অধিকারের মধ্যেই পড়ে।
যাইহোক, লতা মঙ্গেশকারের গানের
ভাষাতেই বলি – ‘আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল...’ আজ নয়, বেশ কয়েকবছর আগে। সুযোগ এল
আমারই এক দূর সম্পর্কের দিদির শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার।
গ্রামের নাম ইখড়া। জেলা বর্ধমান। জামুড়িয়ার কাছাকাছি। বেশ
ভোরবেলায় দুর্গাপুর থেকে আমি, দিদি, আর জামাইবাবু রওনা দিলাম। অল্টো, লেটস গো। মনের
মধ্যে অদ্ভুত সব কল্পনা। মন জানালাও খুলে দিয়েছে, আর প্রাণেও বাতাস লাগছে। আমরা এগিয়ে চলেছি। নীল আকাশ, কাশফুল, সবুজ ধান
ক্ষেতের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী - এর চেয়ে ভাল দুর্গাপুজোর আবহ সঙ্গীত আর কী হতে
পারে! গ্রামে ঢোকার মুখেই এক বিশাল দীঘি।
সেখানে পদ্মফুল আপনমনে নৃত্য পরিবেশনে ব্যস্ত। আর-
কিছু
দস্যি ছেলের দল
তোলপাড় করে জল।
আরেকদিকে সারি সারি ইউক্যালিপটাস গাছের অপূর্ব সমারোহ।
গ্রামটা মোটেই ঘিঞ্জি নয়। বেশ খোলামেলা। দূর থেকে ঢাক আর শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছে।
এক অজানা আনন্দে মন ভরে গেল। আকাশে তখন শরতের মেঘ, আর বাতাসে শিউলির গন্ধ। আর সাদা
কাশ ফুলের মিছিল তো আছেই। ছোট্ট সেই গ্রামের কাউকেই চিনি না। চেনার কথাও নয়। আগে তো
কখনও যাইনি। তাদের বাড়ি ‘বাবুদের বাড়ি’
নামে পরিচিত। অবশেষে সেই বিরাট দোমহলা বাড়ির সামনে এসে আমাদের গাড়ি থামল।
তখন কাঠা-বিঘা এসব মাপ বুঝতাম না। তাই, আয়তন কত, এসব প্রশ্ন
মাথাতেও আসেনি। তবে বাড়িটা যে বিশাল, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুপ্রাচীন এক বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটা অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। প্রতিটি দেওয়ালে যেন না
বলা অনেক কথা। দেখেই মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি একে হেরিটেজ বিল্ডিং আখ্যা দেওয়া উচিত। চারিদিকে
প্রচুর ফুল ও ফলের গাছ। সেগুলি যে নিয়মিত পরিচর্যা হয়, তাও বোঝা গেল। বাড়ির একপাশে
এক বিশাল ইঁদারা। তার পাশে সারি দিয়ে টালির ঘর। এখানে বাড়ির কাজের লোকরা থাকে।
বাগানের ভেতরেই রয়েছে পাড় বাঁধানো এক বিশাল পুকুর।
ইতিমধ্যেই বাড়ির পরিচারকবৃন্দ এসে আমাদের ব্যাগপত্তর বার
করতে লাগল। হঠাৎ দেখি বছর ষাট-বাষট্টির এক ছোটখাটো মানুষ, পরনে অর্ধেক ধুতি আর
ফতুয়া; হাতজোড় করে এসে বলে উঠল-
-‘ভালো আছেন তো, হে হে! বাড়ির সব ভালো তো, হে হে! পথে আসতে অসুবিধে
হয়নি তো, হে হে!’
আমরাও সব হে হে করে
ভেতর ঢুকলাম। দিদি কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে না। কেমন যেন ভয়ে ভয়ে
রয়েছে। এমনিতেই সকাল থেকে দিদিকে চেনা যাচ্ছিল না। কারণ বাড়িতে রাত্রিদিনই
আলখাল্লা পরে থাকে। আর বাইরে বেরোলে লেগিংস, সঙ্গে কুর্তি। সেই দিদি আজ গুচ্ছেক
ভারি ভারি গয়না, রেললাইনের মত সিঁদুর, শাড়ি, আর একমাথা ঘোমটা টেনে ভেতরে ঢুকল। আমি
তো তখন চারিদিক দেখতেই ব্যাস্ত। হঠাৎ কনুইয়ের গুঁতো। সামনে তাকিয়ে দেখি দিদির
সালংকারা শাশুড়ি পানের বাটা নিয়ে পান সাজছেন। যেমনি দেখতে সুন্দর, তেমনি রাশভারী তাঁর চেহারা। আর পাশে আরাম কেদারায় বসে জমিদারি
স্টাইলে হুঁকো টানছেন দিদির শ্বশুরমশাই। দেখলেই ভয় লাগবে। আমরা গিয়ে প্রণাম করতেই
আকাশে রোদ উঠল। বাজখাঁই গলায় হাঁকডাক শুরু করলেন-
-‘ওরে কে কোথায় আছিস! দেখ কারা এসেছে।’
-‘আর এই ধনঞ্জয়টাও যে কোথায় যায় না’।
বলতে না বলতেই একথালা মিষ্টি আর সরবত নিয়ে সে হাজির।
-‘এই যে কত্তাবাবু সরবত আনতে গেছ্লুম’।
জীবনে প্রথমবার খেলাম। জার্মান সিলভারের গ্লাসে মুচ্কুন্দ
ফুলের সরবত। আহা। কী স্বাদ!
দিদির নির্দেশে স্নান টান করার পর শাড়ি পরতেই হল। আমরা
গিয়েছিলাম ষষ্ঠীর দিন। বাড়ির অন্য সকলের সঙ্গে দিদি পরিচয় করিয়ে দিতে লাগল।
জামাইবাবুরা দুই ভাই হলেও এদের প্রচুর আত্মীয় স্বজন। দিদির শ্বশুররা চার ভাই। তার মধ্যে
তিনজন জীবিত। কিন্তু তাদের ছেলে মেয়ে সন্তান সন্ততি নাতি নাতনি নিয়ে সে এক বিরাট
ব্যাপার। পারিবারিক পুজো বলে সবাই এসেছে। নদিদি, ফুলপিসি, রাঙ্গামা, কাম্মা, কে যে
কার মা! উহ্! আর নেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি তার সঙ্গেই এখনও দেখা হল না।
এই সব করতে করতেই দুপুরে খাবার সময় হয়ে গেল। বাড়ির ছোট ছোট
ছেলে মেয়েরা একদিকে আর বাড়ির ছেলেরা একদিকে লাইন দিয়ে খেতে বসে গেল। বাড়ির বউরা
পরে বসবে। আমিও নাকি ছোটদের দলেই পড়ি। অগত্যা, আমাকেও খাবার জন্য কলাপাতা দেওয়া
হল।
দিদিগণ একমাথা ঘোমটা সহকারে পরিবেশন করতে লাগল। প্রথমেই গরম
ভাত সঙ্গে গব্যঘৃত। শাকভাজা, মিষ্টি শুক্তো, ভাজা মুগের ডাল, চিড়ে দিয়ে পটলের
তরকারি, রুই কালিয়া... থাক বাকিটা পরে বলব। এই খাবারগুলো আগেও খেয়েছি। পটল থেকে
আমি বরাবর একটা keep safe distance। কিন্তু চিড়ে
দিয়ে পটল খেয়ে আমি পটলের প্রেমে পড়ে গেলাম। একটু গবেষণা করতেই জানা গেল পদটি এ বাড়ির
গিন্নিমা স্বহস্তে রান্না করেছেন। নিন্দুকেরা পদ্মহস্ত বলবেন। কিন্তু আমি জেনেছি
অন্য কথা। পেতলের কড়াইয়ে, কাঠের উনুন সহযোগে তিনি এই অপূর্ব খাদ্য বস্তুটি প্রস্তুত
করিয়াছেন, যাহা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়।
খাবার পর গেলে কিন্তু কেসটা জন্ডিস হয়ে যাবে। মন উচাটন। চুপিচুপি
পালিয়ে এলাম ঠাকুর দালানে। দেখি দেবী দুর্গা দাঁড়িয়ে আছেন। কী সুন্দর লাগছে মা কে এমন রূপ তো আগে কখনও দেখিনি। এই তাহলে
মায়ের সনাতন রূপ। লাল রঙের বেনারসি, মাথায় সোনার মুকুট, সোনার টিপ, গলায় সাতনরি
হার, বাজুবন্ধ আরও কত সব গয়না যে মা কে পরানো হয়েছে। লক্ষ্মী স্বরস্বতীও বাদ
যায়নি। তবে দেখলাম তাদের মুখটা একটু ভার। মনের ওয়াই-ফাই কানেকশন চালু আমার র্যাডারে
ধরা পড়ল তাদের মুখভারের কারণ। তারা আসলে এইসব ওল্ড ফ্যাশনের গয়না ঠিক পরতে চাইছে না।
তারা দেবতা বলে কি মানুষ নয়! অঞ্জলির গয়নায় সাজতে এবং সাজাতে কার না ভাল লাগে! কিন্তু কী আর
করা যায়! মা দুর্গা ওদের বারবার বোঝাচ্ছেন
-‘দ্যাখ, ওল্ড ইস গোল্ড’।
কিন্তু ওরা না শোনে কাহারো কথা!
ইতিমধ্যেই সন্ধ্যে হয়ে গেল। দেবীর বোধন শুরু হবে। সবাই নতুন
শাড়ি গয়না পরে চলে এসেছে ঠাকুর দালানে। বাইরে বেশ বড় করে প্যাণ্ডেল করা হয়েছে।
গ্রামের মানুষরা যাতে নির্বিঘ্নে সুষ্ঠভাবে পুজোয় অংশগ্রহণ করতে পারে। সমগ্র ইখরা গ্রামটিতে এই একটি মাত্রই পুজো হয়। পুজোর এই
চারটে দিনেই উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ফারাক ভুলে সকলেই এক আনন্দ উৎসবে
মেতে ওঠে। তবে পুজোর যাবতীয় জোগাড়ের দায়িত্ব থাকে বাড়ির বউদের ওপরেই। গিন্নিমা
সবদিকটা পরিচালনা করেন।
অন্যদিকে কর্তাবাবু ও বাড়ির ছেলেরা অন্নভোগের আয়োজনে
ব্যাস্ত থাকেন। পুজোর
চারদিন গ্রামের বউদের রান্নার ঝামেলা থেকে মুক্তি। সবাইকার ঠিকানা তখন বাবুদের
বাড়ি। তাই এই চারটি দিনের জন্য তারা সারাবছর অপেক্ষা করে থাকে। সমগ্র গ্রাম তখন
হয়ে ওঠে একটাই পরিবার। জমিদারি বাড়ির আভিজাত্যের অহংকারকে খুব সহজেই অবহেলা করে, গ্রামের
দীন দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষগুলির সঙ্গে একসারিতে বসে খেতে গেলে একটু বড় মন লাগে
বৈকি!
পরের দিন খুব ভোরবেলায় উঠে পড়লাম। সকাল আটটায় বারি আনতে
যেতে হবে। তার আগে গ্রামের চারপাশটা একটু ঘুরে দেখা দরকার। বেরিয়ে পড়লাম। শরৎ
আকাশে তখন আগমনির সুর। হিমেল হাওয়া। আধো আলো, আধো অন্ধকার। কী ভালই না লাগছিল! সোজা চলে গেলাম দীঘির ধারে।
চারিদিকে কাশফুল। শিউলির গন্ধ ভেসে আসছে।
পূব আকাশ একটু একটু করে লাল হচ্ছে। এমন সময়
-‘আপনি এত ভোরে উঠেছেন?’
চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি হালকা আকাশি রঙের পাঞ্জাবী পরিহিত
এক সূদর্শন যুবক। এর আগে তাকে দেখেছি বলে মনে হল না। আমিও পাল্টা প্রশ্ন-
- ‘আপনি?’
-‘আপনি আমাকে
চিনবেন না। আমি গতকাল রাতে এসেছি।’
পরিচয় দিতেই জানতে পারলাম এই ছোকরা দিদির জা-এর ভাই। থাকে ব্যাঙ্গালোরে। কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি করলেও
চেহারায় বেশ একটা কবি কবি ভাব। আলাপ জমতে লাগল। হাঁটতে লাগলাম দীঘির ধার ধরে।
সামনেই একটা শিউলি গাছ। সবুজ ঘাসে একথালা ভাতের মত শিউলি ফুল পড়ে রয়েছে। নির্মল,
নিষ্পাপ। শিশির ভেজা পায়ে গিয়ে আমি তাদের স্পর্শ করলাম। আঁচল ভরে শিউলি ফুল
কুড়োচ্ছি। এমন সময় দেখি তিনি গোটা কয়েক পলাশপাতা নিয়ে এলেন। আমি সেই পলাশ পাতায়
ফুল নিয়ে মন্দিরে গেলাম।
বারি আনতে যাবার সময় হয়ে গেছে। বিশাল এক পালকি। সঙ্গে
অলংকারে সুসজ্জিত একটি ছাতা। সবাই স্নান করে গয়না পরে রেডি। বাড়ির ছেলেগুলোও কম
যায় না। তারাও দু চারটে হার আংটি পরে নিয়েছে। অত সকালেও দেখি বাড়ির বউরা গা ভর্তি
গয়না পরেছে। নাকে টানা টানা নথ। বোঝাই যাচ্ছে এগুলো সেকেলে গয়না। এখন আর এই ডিজাইন চলে না। প্রত্যেকে
আটপৌরে ভাবে লালপাড় শাড়ি পরেছে। কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ। চুল খোলা। অসা ধারণ লাগছে।
এখানেই সাধারণ পরিবারের বউ-ঝি দের থেকে তারা আলাদা। আভিজাত্যটা গয়না বা শাড়িতে
থাকেনা। থাকে রক্তে।
এই বাড়িতে অষ্টধাতুর মূর্তি পূজা করা হয়। তার ওপরে থাকে
দুর্গার প্রতিমা। জনশ্রুতি এই যে এই জামাইবাবুদের পূর্বপুরষ ওই দীঘিতে স্নান করতে
গিয়ে মা দুর্গার এই অষ্টধাতুর মূর্তিটি পান, এবং সেই রাত্রেই তিনি ওই মূর্তি পুজো
করার স্বপ্নাদেশ পান। প্রায় তিনশ বছরের প্রাচীন পুজো এটি। এখানে মায়ের ডাকের সাজ।
দুর্গা থাকবে আর শিব থাকবে না, তা কি হয়! তাই মায়ের পাশেই বাঘছাল পরে বসে আছেন ভোলা
মহেশ্বর। মহেশ্বর বরাবরই বাঘছালের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। ডেনিম জিন্সের ফাঁদে
তিনি কখনও পা দেননি। তবে ইদানিং তিনি তাঁর জটায় একটু ট্রিম করাচ্ছেন বলে শোনা
যাচ্ছে।
সারাদিনই হই হই করছে সবাই। এই পুজোকে কেন্দ্র করে বেশ বড়সড়
মেলাও বসে গেছে। পাশের গ্রাম থেকেও লোক আসছে পুজো দেখতে। তবে যা বুঝলাম, মা দুর্গা
এখানে খুব একটা দর্শনীয় বস্তু নন। দর্শনীয় হচ্ছে জমিদার বাড়ির বউ-ঝিরা। তাদেরকে
নিয়ে গ্রামের লোকের আদিখ্যেতা ও কৌতূহল দেখার মত।
তবে আর পাঁচটা সাধারণ দুর্গাপুজোর
থেকে বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর বেশ পার্থক্য আছে। মাকে বিভিন্ন ভোগ নিবেদন করা
হয়েছে, কিন্তু স্টেইনলেস স্টিল এখানে ঠিক সুবিধে করতে পারেনি। তার বদলে বিশাল
কাঁসার থালা, রূপোর কসাকুশি, রূপোর থালা, বাটি, গ্লাসে মাকে ভোগ নিবেদন করা হয়েছে।
গ্রামের সাধারণ মানুষ কাঠের বারকোষে ভোগ দিয়েছে। কিন্তু একটি ভোগের থালাতেও বাজার
চলতি কোন মিষ্টি নেই। সবই বাড়িতে তৈরি গ্রাম্য মিষ্টি। যেমন টানা মিঠাই, বোঁদের
নাড়ু, নারকেল নাড়ু, আড়সা, ছানার সন্দেশ, গজা প্রভৃতি। রাতদিন এই মিষ্টি খেয়ে মা
দুর্গার পরিবারের খুব করুণ অবস্থা।
আবার মনের ওয়াই-ফাই কানেকশন চালু করে দিলাম। বুঝলাম মা দুর্গাও তার মেয়েদের
পাল্লায় পড়ে ফিগার কনশাস হয়ে গেছেন। মিষ্টি খেয়ে যদি ফ্যাট বাড়ে, তাহলে ওই
মন্ত্রটাই নাকি বৃথা হয়ে যাবে-‘নবযৌবন সম্পন্ন্যাং...’। তাই তিনি সত্যজিৎকেই
জীবনের ধ্রুবতারা বানিয়েছেন-
অনাহারে নাহি ক্ষেদ
বেশি খেলে বাড়ে মেদ।
আমি বললাম-
‘চাপ নিও না। সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই তোমাদের গরম গরম গ্রিন টি দিয়ে যাব।
কারণ ওটা অ্যাণ্টি ফ্যাট।
সন্ধেবেলায় আরেকপ্রস্থ সাজের বাহার। আরতি হবার পরই
শুরু হল
‘ঢাকের তালে কোমর দোলে’। গানটা তখন সবে বাজারে
এসেছে। তবে এই বাড়িতে ওই গান বাজলে আর রক্ষে নেই।
ধুনুচি নাচে সবাই যখন মেতে উঠেছি, তখনও দেখি সেই ছোকরার মুখে মৃদু মৃদু হাসি।
মাঝে মাঝে ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’।
পরের দিন অষ্টমী। একশ আট পদ্মের মালা পরে নিয়েছেন মা দুর্গা। তারপর শুধুই
লুচি। সকালে লুচি বিকেলে লুচি। দিনে লুচি রাতে লুচি। লুচি লুচি আর লুচি-
লুচি ধ্যান লুচি জ্ঞান লুচি চিন্তামণি
লুচি ছাড়া সবাই যেন মণিহারা
ফণি।
এরপর এল সেই বহু প্রতিক্ষিত সন্ধিপুজো। জীবনে বহু দুর্গাপুজো দেখেছি। কিন্তু এমনটি আর কখনও দেখিনি।
শহরে ফটকা আর লাড়েলাপ্পা গানের আওয়াজে চাপা পড়ে যায় পুরুত মশাইয়ের উদাত্ত
কণ্ঠস্বর। এখানে দেখলাম উল্টো ছবি। যে জায়গায় বলি হবে তার পুরোটাই গোবর দিয়ে
সুন্দর করে নিকোনো। তার চারপাশটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। যেন কেউ ওই জায়গায় ঢুকে পড়তে না
পারে। পুরোহিতমশাই সবাইকে বসতে বললেন। প্রত্যেকে একেবারে চুপ। ফটকা তো দূরের কথা,
খুব ছোট ছেলে-মেয়েরাও সেসময় যেন কোলাহল
করতে ভুলে গেছে। শহরের মত মাইকের ব্যবস্থা সেখানে নেই। পুরোহিতমশাই উদাত্ত কণ্ঠে
একাগ্র চিত্তে সন্ধিপুজোর মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছেন। দরদর করে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সকলেই
মনে মনে মাকে ডাকছে। ঘাতকের কপালে রুধির ধারা। কী তীব্র প্রতীক্ষা ওই সন্ধিক্ষণের।
অবশেষে মানুষের ভেতরের অসুরত্বকে বলি দেওয়া হল আখ ও চালকুমড়োর প্রতীকে। হুলুধ্বনি,
শাঁখ, কাঁসর আর ঢাকের আওয়াজে মুখরিত তখন বাবুদের বাড়ি, মুখরিত সমগ্র প্রকৃতি।
পরের দিন ইচ্ছে হল একটু
গ্রামটা ঘুরে দেখি। পায়ে হেঁটে গ্রামটা ঘুরতে মন্দ লাগছিল না। একাই ঘুরছিলাম। দোকা
নয়। যদিও
গ্রামের মানুষ অকারণ কৌতূহলেই তাকিয়ে ছিল
এই তথাকথিত শহুরে মেয়েটির দিকে। তবুও তাদের গ্রাম্য সরলতা আর আন্তরিকতায় মুগ্ধ
হলাম। খুব সহজেই তারা আমাকে আপন করে নিল। মুহূর্তেই তৈরি করে ফেললাম নতুন সম্পর্ক।
গেলাম নতুন খুড়োর বাড়ি। খড়ের চাল আর মাটি দিয়ে নিকোনো তাদের ঝকঝকে উঠোন। দরজায়
সিঁদুর দিয়ে লেখা –‘এসো মা দুর্গা’। তারা যে কোথায় আমায় বসতে দেবে আর কি খেতে দেবে এই নিয়ে শুরু
হল খুড়ো আর খুড়িমার মধ্যে কার্গিল যুদ্ধ। অবশেষে খুড়ি দিল কাঁসার থালায় মুড়িতে গুড়
মাখিয়ে অদ্ভুত একপ্রকার মিষ্টি। সঙ্গে আগের দিনের বাসি লুচি আর ডিংলার ঝাল। কিন্তু
আমার একটামাত্র পৈতৃক পাকস্থলির পক্ষে এতটা অত্যাচার সহ্য করা কঠিন। তাই যৎসামান্য।
খুড়োর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম এই গ্রামের মানুষদের প্রধান জীবিকা চাষবাস।
কেউ কেউ সরকারি চাকরি করে। আধুনিক প্রজন্ম আর চাষবাস করতে চাইছে না। শহরের ঝলমলে
জীবনের জৌলুসেই তাদের আকর্ষণবেশি। তবে অধিকাংশ লোকজন এখন একশো দিনের কাজ পাচ্ছে
বলে আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে বাবুদের বাড়ির পুজোকে ঘিরে রয়েছে
তাদের আত্মিক টান। খুড়োর কথায়- ‘কত্তাবাবু আর গিন্নিমার মত মানুষ হয় না। যে কোনও বিপদে
আপদে তেনারাই আমাদের সম্বল। আমাদেরকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন’। শ্রদ্ধাটা
নিছক সৌজন্যমূলক নয়, বেশ আন্তরিক বলেই মনে হল।
পুজোর এই চারটে দিন আরতির পর কিছু না কিছু
অনুষ্ঠান হতই। অর্থাৎ নিজের পরিবারের তেরটা এঁড়িগেঁড়ি ছানা-পোনার প্রতিভা বিকশিত
করার সুযোগ। সব কিছুর মাঝেও কিন্তু ধনঞ্জয়দা হে হে, মানে সকলে ঠিকঠাক খাচ্ছে কিনা,
সবাই ঠিকমত বিছানা বালিশ পাচ্ছে কিনা সেদিকেও তার হে হে।
এবার সেই বিজয়া। সকালে ঘট বিসর্জন আর
সিঁদুর খেলা। তারপর একরাউন্ড দই চিড়ে। দুপুরে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে টেনে ঘুম। বিকেলে
মা যাবেন কৈলাশে। তারই প্রস্তুতি। অবশেষে মা-কে বরণ করে বিদায় দেওয়ার পালা। শেষ
মুহূর্তের মায়ের কানে চুপিচুপি- ‘আবার এসো মা’। বড় বিষণ্ন এই
পটভূমি। কেমন যেন মন কেমন করা এক আবহ।
শূন্য হয়ে যায় ঠাকুরদালান। শূন্য হতে থাকে
বাবুর বাড়ি। চারদিনের কর্মচঞ্চলতার পর আবার এক বছরের অখণ্ড অবসর। ঘরের খোঁজে ঘরের
মানুষ ঘর ছেড়ে যায়। থেকে যায় শুধু বাবুদের বাড়ি। কর্তাবাবু আর গিন্নিমা। পথ চেয়ে দিন
কাটে। গল্পটা
এখানেই শেষ হলে পারত। কিন্তু পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত!
ভাবছেন তো আমার সেই শরৎ শিউলি
প্রেমের কি হলো? নাকি তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল? বলতেই পারি। কিন্তু কেন বলব?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন