শাদা বাড়ি
এলিফ্যান্ট রোডের দু’পাশে যেখানে মার্কেটের গা ঘেঁষে মার্কেট দাঁড়িয়ে, একটু এগিয়ে গেলেই বাটার সিগন্যাল। অজস্র গাড়ি, লোকাল বাস বুকে নিয়ে রাস্তা চলে গেছে শাহবাগের দিকে। এর আগেই ডানে বেঁকে গেলে কাঁটাবন ঢাল। দুপুর শেষ হলো কি হয়নি। বিকেল এসে পৌঁছল বলে। এমন চকচকে আয়না হয়ে আছে আকাশটা, রোদ দাঁড়াতে পারছে না, পিছলে যাচ্ছে। লু হাওয়ায় ভেসে মিশে যাচ্ছে ঘাম, ধুলো, ধোঁয়ায়। বাঁ হাতের ঘড়িতে সময় দেখে টিয়া। কিন্তু হাঁটা থামায় না।
ওর নাকের ডগায় কয়েকটি বিন্দু রোদে ঝলকায়। গলা শুকিয়ে কাঠ। বিবিধ ভাঁজে-খাঁজে ঘাম বয়ে যায়। ডান হাতে ওড়নার প্রান্ত দিয়ে কানের নিচে গলাটা মুছে নিল সে। বিলবোর্ডের বাষ্পমাখা বরফ শীতল কোকাকোলা তেষ্টা বাড়ায়। সোজা বরাবর হাঁটছে টিয়া। ফুটপাথ ধরে। আসলে ঠিক মন খারাপ না, একটা অস্বাভাবিক অনুভূতির রেশ কাটাতেই হনহনিয়ে চলছে ও। তবে থামতে হচ্ছে প্রায়ই। দুপুর হেলছে তবু লোকজনের কমতি নেই। পাখির কিচিরমিচির। ঘুমন্ত-জাগন্ত কুকুর, বিড়াল, খরগোশের খাঁচা দোকান ছেড়ে ফুটপাথে দখল নিয়েছে। গন্ধটা ওর তুমুল অপছন্দের আর বন্দীত্বটুকুও। অস্বস্তি আর অপরিচিত এক শিরশিরে অনুভব ভেতরটা সম্পূর্ণ দখল করে নেবার আগেই সে পৌঁছতে চায়। পৌঁছে যাওয়াটা নাকি জরুরী, তা সে যে কোনো গন্তব্যে হোক। কিন্তু জীবনে গন্তব্যকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে, যাত্রার অভিজ্ঞতাকে কম ন্যায্যতা দেবে, টিয়া এমন ধাতের মানুষ নয়। পৌঁছনোর কথা হচ্ছিল সেই বাড়িটাতে।
বিশাল তিনতলা সাদা বাড়ি। উঁচু প্রাচীরে চারদিক ঘেরা। দোতলা জুড়ে টানা বারান্দা। সিনেমায় যেমন দেখা যায়। এত পুরনো বনেদী বাড়ি এই এলাকায় চিন্তাই করা যায় না। দুপাশের লনে বড় বড় গোলাপ হাসছে। বাতাসে দুটি নারকেল গাছের পাতা আলুথালু। নতুন টিউশন শুরু করেছে টিয়া। আজ তৃতীয় দিন।
ছেলেটা মেধাবী, শান্ত, ক্লাস থ্রিতে পড়ে। অর্ণব। অপূর্ব লাবণ্যকান্তি চেহারায় এমন ছলছলে গভীর বিষণ্ণ চোখ টিয়া আগে কখনও দেখেনি। বিশাল বাড়িতে অর্ণব ছাড়া সে আরো তিনজনকে চেনে। অর্ণবের বাবা তৈমুর হাসান, ব্যবসায়ী। প্রথম দিনই কথা হয়েছে। নিরীহ গোছের মানুষ। ‘বুড়িখালা’ বলে অর্ণব ডাকছিল একজন বৃদ্ধাকে। জানা গেল বাড়ির রাঁধুনি। আর একজন কুকুর পালক আয়নাল। সেই লোকই দুদিন গেট খুলে দিয়েছিল। এ্যালসেশিয়ান, জার্মান শেফার্ড, গ্রে হাউন্ডসহ আধ ডজন প্রকাণ্ড কুকুর আছে। এসব তথ্য অর্ণবের দেয়া। শুনশান, নির্জন বাড়ি বলেই কি? টিয়া ঠিক বুঝতে পারে না। বিশালত্বের একটা প্রভাব আছে। বাড়িটার চত্বরে পা রাখলেই মেরুদণ্ড বেয়ে অস্বস্তির বুদবুদ করোটি ফুঁড়ে মিলিয়ন মিলিয়ন নিউরণে ছড়িয়ে যায়। সারা শরীর বেয়ে শিরশিরে ভয়ের কুয়াশা ঝরায়।
দু’পাশের লন পেরিয়ে টিয়া যখন হেঁটে যাচ্ছে, পোর্চের একপ্রান্তে বসে আয়নাল। ওর দিকে তাকিয়ে এমন বিচ্ছিরি করে হাসলো, টিয়ার গা রিরি করে উঠল। ড্রয়িং রুমে ঢুকেই অচেনা বোটকা গা গোলানো গন্ধটা পেল। তীব্র নয়। এখানেই অর্ণবকে পড়ায় সে। সোফায় বসে ঠাণ্ডা পানি চাইল বুড়িখালার কাছে। নির্বিকার মুখে সে পরিষ্কার কাচের গ্লাস টেবিলে রেখে গেল। স্ফটিকের মতো চার টুকরো বরফ ভাসছে পানিতে। শেষ বিন্দুটুকুও শুষে নিল টিয়ার রুখাশুখা ঠোঁট, জিভ, গলা সত্যি বলতে কি পুরো শরীরের রোমকূপ। অর্ণব এসে টিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। টিয়া বই হাতে তুলে বলল - আজ ম্যাথস আর জিওগ্রাফি। অর্ণবের ঠোঁটে তখনও একচিলতে মিহি হাসির পরত লেগে আছে।
বেরিয়েই টিয়া দেখল তীব্র লালের মাঝে বেগুনী কমলায় আকাশ খুনরাঙা। আলোয় চারপাশটা নরম হয়ে আছে। তৈমুর কুকুরগুলোর মাথায় গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আয়নাল বেল্ট টেনে ধরে আছে। গেটের কাছেই এক বুড়োলোক খুরপি হাতে দাঁড়িয়ে। গালে পাকা দাঁড়ি।
গেটের বাইরে বাম পা দিতেই লোকটি হঠাৎ ঝুঁকে বলল - অর্ণব এ বাড়ির ছেলে না। চমকে পা ভেতরে টেনে আনল টিয়া। পেছনে তাকালো, তৈমুরকে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেছে।
- মানে?
- সাহেবের এক ভাইয়ের ছেলে ও। ওনার নিজের সন্তান নাই।
-আপনি কে?
-আমি খালেক। এই বাড়িতে দারোয়ান আর মালির কাজ করি চল্লিশ বছর। ওনার তিন স্ত্রী ছিল।
তারপর সে যা বলল, প্রথম স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে, দ্বিতীয়জন ছাদ থেকে হঠাৎ পড়ে গিয়ে ঘাড় ভেঙে ওখানেই মরেছে। তৃতীয়জন পাগল হয়ে গেছে। শেষ স্ত্রী অর্ণবের টিউশনের টিচার ছিল।
হিংস্র কুকুরগুলোর চাপা গরগর শব্দ ততক্ষণে ভয়ানক চিৎকারে পরিণত হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন