নৈঃশব্দ্যের
মতো ধ্যানমগ্নতার কবি
আবুল হাসান
কবে কখন প্রথম আবুল হাসান পড়া
শুরু করেছিলাম সেটা এখন আর মনে নেই। তবে জীবন যখন হতাশার যন্ত্রণায় নিমজ্জিত হয় তখন কবি হাসানের কবিতাই
একমাত্র ভরসার স্থল হয়ে ওঠে এখনো। আবুল হাসানের কবিতার কথা মনে পড়ে তা হচ্ছে কবি শেলীর সেই বিখ্যাত
উক্তি - সেই গানগুলিই হচ্ছে সুমধুর যা আমাদের দুঃখকাতর চিন্তার কথা প্রকাশ করে (Our sweetest songs are
those that tell of saddest thought)।
কীটসের কবিতায় যে তীব্র বেদনাবোধ অথবা র্যাঁবোর কবিতায়
জীবনের যে নিদারুণ যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি আমরা লক্ষ করেছি, কবি আবুল হাসানের
দ্যুতিময় কবিতায়ও সেইসব অনুষঙ্গ উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। আবুল হাসান তার
ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনযন্ত্রণার যে অভিজ্ঞান অর্জন করেছিলেন, সেটাই তার
কবিতাকে এক মহৎ শিল্পে মহিমান্বিত করেছে। তার কবিতা পড়তে পড়তে আমি তাই পাঠক হিসেবে
বিশেষ এক ঘোরের মাঝে ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। হাসানের কবিতা তখন আর তার নিজের থাকে না,
হয়ে ওঠে সর্বজনীন। তাঁর প্রতিটি কবিতাই রাত্রির নৈঃশব্দ্যের মতো ধ্যানমগ্ন। তিনি
ছিলেন এমনই এক আজন্ম বিশুদ্ধ কবি যিনি নিজের জীবনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেই
কবিতা লিখেছিলেন। অল্প বয়সেই একজন সৃজনশীল কবি হিসেবে তাই বিখ্যাত হয়ে
উঠেছিলেন হাসান। মাত্র এক দশকের
কাব্যসাধনায় আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে
অর্জন করেছিলেন বিশিষ্ট স্থান।
সময়, যুগ-যন্ত্রণার নানা ঘটনাপ্রবাহ কবিমানসে যে
অন্তরযাতনার সৃষ্টি করে, বিশেষ করে আধুনিক নগরজীবনের উন্মেষের ফলে ব্যাক্তিজীবনে
যে সামগ্রিক জটিলতার সৃষ্টি হয়. তাই
কবিমনকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। সময়, স্বদেশ, সংগ্রাম আবুল হাসানের মনের গভীরে যেমন
কম্পন সৃষ্টি করেছিল, একইভাবে ঢেউ তুলেছিল দুঃখ-বেদনা, নেতি-নৈরাজ্য, সংশয়,
আত্মক্লেশ আর আশাহীনতাও। হাসান এইসব ক্লেশ ও ক্লেদকে ধারন করে হয়ে উঠেছিলেন
আধুনিকতার ঋদ্ধ ঋষি। এসবই কবির অন্তর্গত বোধ ও উপলব্ধিতে কখনো যুগিয়েছে আনন্দ ও
সুখ, কখনো
বা অপার বেদনা। কবি আবুল হাসান এমন একসময়ের কবি যখন বাংলা কবিতায় নগরজীবনের নানা
দিকের উন্মেষ ঘটে চলেছে। এই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও ছিল চরম
উত্তাল। এই সময়কার কবিদের
মধ্যে বিশেষ করে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ইমামুর রশীদ, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক,
রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, সাযযাদ কাদির প্রমুখ কবির
কবিতায় অন্তর্গত ক্ষরণ ও রাজনীতির প্রত্যক্ষ উপস্থিতির সুস্পষ্ট ছাপ পরিলক্ষিত হয়।
মাত্র ঊনত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন হাসান। কিন্তু এই
স্বল্পজীবন পরিসরে রচিত অসংখ্য কবিতায় তার শাণিত বোধ, আবেগ
ও প্রজ্ঞার তীব্র সমন্বয় ঘটেছিল। আবুল হাসানের অধিকাংশ
কবিতা বাহ্যিক ও অন্তর্গত জীবনের টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্বের প্রত্যক্ষ সংশ্লেষে
অনবদ্য। এতে সার্থকভাবে ফুটে
উঠেছে প্রেম বিরহ রাজনীতি শোষণ বঞ্চনা তথা সমাজের যাবতীয় বিষয়-আশয়। অন্যায়
অত্যাচার নিপীড়ন বৈষম্য হতাশা অভাব অনটন নৈরাজ্য ইত্যাদি সমস্ত কিছুর সমন্বিত রূপ
হাসানের কবিতা। প্রকৃতপক্ষে, তার কবিতা জীবন ও সমাজের বিশাল
ক্যানভাসের প্রতিচ্ছবি। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ ও যন্ত্রণার উপস্থাপন তিনি এমনভাবে
করেছেন যা চুড়ান্ত পর্যায়ে নৈর্ব্যক্তিক ও সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে।
১৯৪৭ সালের ৪
আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপারার বর্নি গ্রামে নানার বাড়িতে কবি আবুল হাসান
জন্মগ্রহণ করেন। আবুল হাসানের ডাকনাম ছিল ‘টুকু’। প্রত্যেকটি
মানুষেরই মনোভূমি গঠনে তাঁর পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান
গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। কবি হাসান তার মাতৃ ও পিতৃ দুকূলেরই
শিক্ষা-সংস্কৃতি-সুরুচির উজ্জ্বল উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। উচ্চশিক্ষিত
সংস্কৃতিবান মার্জিত রুচির আত্মীয়দের অপত্য স্নেহ ও আদর, প্রগতিশীল চিন্তার আবহ ও
উদারনৈতিক সান্নিধ্য আবুল হাসানের অগ্রসর মানস নির্মাণে বিশেষ ভুমিকা পালন করেছিল। এভাবেই তাঁর সামাজিক ভাবনা, রাজনৈতিক
চিন্তা, জ্ঞানপিপাসু মানসিকতা ও শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ভাবনা গড়ে ওঠে।
হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত গোপালগঞ্জের বিস্তীর্ণ জনপদ, মধুমতি নদী, শ্যামল-সবুজ চর,
পাখা-পাখালির অবাধ বিচরণ, সাঁই বাবার সানাই – এরকম অনেক কিছু তাঁর কবিমানস গড়ে
তুলতে সাহায্য করেছিল। সারাবছর ধরে সেসব গ্রামে চলতো
পালা-পার্বণ, মেলা, যাত্রাগান, জারীগান, কবিগান, নাটক, কীর্তনের আসর। তাঁর আদর্শ শিক্ষাগুরু ছিলেন স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক
রুস্তম আলী মোল্লা। এরপর বাবার চাকরির সুবাদে আরমানিটোলা সরকারি
উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। আরমানিটোলা স্কুলে পড়ালেখার সময় থেকেই
আবুল হাসান নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেন।
আবৃত্তি,
অভিনয়, কবিতা লেখা, গান শোনা, কোরআন পাঠের মাধ্যমে সে-সময়েই তিনি সকলের দৃষ্টি
আকর্ষণ করেন। যৌবনের প্রথম ঋতুতেই তিনি জীবনানন্দের বরিশালে গিয়ে হাজির
হন। তখনই তার পরিচয় ঘটে ষাটের তরুণ কবি-লেখক হুমায়ুন কবির, শশাংক পাল,
মাহফুজুল হক খান, আবুল হাসনাত প্রমুখের সঙ্গে। বরিশাল ও ঢাকার নানা কাগজে তার অনেক কবিতা প্রকাশ
পেতে থাকে। এই সময়েই সময় তিনি বরিশালের
মেয়ে সুলতানা রাজিয়া খোন্দকারকে
ভালোবেসে ফেলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ব্রজমোহন মহাবিদ্যালয় থেকে যশোর শিক্ষা বোর্ডের
অধীনে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।
১৯৬৫ সালে আবুল
হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্জন
সম্পন্ন করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই হাসান সাহিত্যচর্চায় গভীরভাবে
মনোনিবেশ করেছিলেন। এই সময়টিতে তিনি ঢাকার তরুণ কবিদের
প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসেন এবং আস্তে আস্তে পদার্পণ করেন ‘উদ্বাস্তু-উন্মুল’
যৌবনে। পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেলে আবুল হাসান অর্থের প্রয়োজনে পত্রিকায় চাকরি
নেওয়ার কথা ভাবতে থাকেন।
শৈশব থেকেই
হাসান বাতজ্বরে ভুগছিলেন। যৌবনে উপনিত হওয়ামাত্রই তা ভাল্বজনিত হৃদরোগে পরিণত হয়। বাংলাদেশে তাঁর
হৃদরোগের উন্নত চিকিৎসা হয়নি ফলে তিনি চিকিৎসার জন্য পূর্ব জার্মানীতে যান।
তার হৃৎপিণ্ডের অসুখ প্রথম ধরা পড়ে ১৯৭০ সালে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে গুরুতর
অসুস্থ অবস্থায় তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে
পুনরায় অসুস্থ হয়ে ঢাকার হলিফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এখানেও
অবস্থার উন্নতি না হলে বন্ধুদের আন্তরিক সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে
উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে পূর্ব জার্মানি পাঠানো হয়। প্রথমিক চিকিৎসার পর তিনি
খানেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং হাসপাতালের বেডে শুয়েই আবার কবিতা লেখা শুরু করেন।
এসময় তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে
শিল্পী গ্যাব্রিয়েলার সাথে। গ্যাব্রিইয়েলার
সঙ্গেই তিনি বার্লিনের বহু জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছিলেন এবং একাধিকবার গ্যাব্রিয়েলার
বাসাতেও তিনি বেড়াতে গিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের শুরুতেই হাসান আবারও গুরুতর অসুস্থ হয়ে
পড়েন। জার্মান ডাক্তাররা তাদের সীমাবদ্ধতার কথা
ভেবে তাকে চেকোস্লোভাকিয়ায় চিকিৎসার জন্য পাঠান। কিন্তু ততদিনে তাঁর হৃৎপিণ্ড প্রায় অকেজো হয়ে গেছে, যা সারিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল জটিল অস্ত্রোপচারের।
কিন্তু সেই ধরনের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয় সুবিধা না থাকায় সে দেশের চিকিৎসকরা
অপারেশনের ঝুঁকি নিতে চাননি। এই জটিল পরিস্থিতিতে বার্লিনের চ্যারিটি হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ আবুল হাসানকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭৫
সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আবুল হাসান চ্যারিটি হাসপাতাল থেকে মুক্ত হয়ে
সপ্তাহখানেক তাঁর জার্মান বান্ধবী গ্যাব্রিয়েলার বাসায় ছিলেন। তারপর ১৯৭৫ সালের
২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে বার্লিন ত্যাগ করেন।
১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি
ঢাকা পৌঁছেন। পরবর্তী্তে ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর তিনি গুরুতর
অসুস্থ অবস্থায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। অবশেষে মাত্র ২৯ বছর
বয়সে পিজি হাসপাতালে ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান।
তার জীবনীকাররা বলছেন, আবুল হাসান ১৯৭০ সালে এশীয় কবিতা
প্রতিযোগীতায় প্রথম হন। ঐ একই সালে ভারতের কোলকাতা থেকে সমগ্র পৃথিবীর
প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের প্রকাশিত সংকলন “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা” গ্রন্থে তার লেখা
“শিকারী লোকটা” স্থান পায়।
১৯৭২ সালে “রাজা
যায় রাজা আসে” কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই আবুল হাসানের কবিখ্যাতি
ছড়িয়ে পড়ে। এরপর
অসুস্থ অবস্থাতেই ১৯৭৪ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “যে তুমি হরণ করো” প্রকাশিত
হয়। হাসপাতালের
বেডে শুয়ে শুয়েই তিনি তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ “পৃথক পালঙ্ক”র পাণ্ডুলিপি তৈরি করা
থেকে প্রুফ দেখা সব কাজই করেছেন। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ
“পৃথক পালঙ্ক”। এরপর ১৯৮৫ সালে তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর পর
নওরোজ সাহিত্য সংসদ “আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা” প্রকাশ করে। হাসান বেশ কিছু
সার্থক ছোটগল্পও রচনা করেছিলেন। ১৯৯০ সালে
মৃত্যুর ১৫ বছর পর প্রকাশিত হয় তার “আবুল হাসান গল্প সংগ্রহ”। কবিতা ও গল্প ছাড়াও তিনি জার্মানি থেকে ফিরে এসে “কুক্কুরধাম”
নামে একটি বৃহৎ কাব্য রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন। যদিও শারীরিক
অসুস্থতার কারণে তা শেষ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি এমন বেশকিছু কবিতা গ্রন্থিত
হয়েছে হাসানের ‘অগ্রন্থিত কবিতা’য়। কবি
হাসান ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই একজন বোহেমিয়ান ও উদ্বাস্তু মানুষ। রোগ-শোক, নিঃসঙ্গতা
আর সন্তের মাধুর্য মিলে-মিশে ছিল তার জীবনে।
আবুল হাসান গত হয়েছেন
বহুদিন, তবু আজও তাঁর বাজানো সানাইয়ের সুর শুনতে পাই আমাদের হৃদয় মন্দিরের
একতারায়। তিনি ছিলেন পূর্বাহ্ণে ফোঁটা অপরাহ্ণের এমনই এক ফুলকলি, যা পরিপূর্ণ
পরিস্ফুটনের আগেই ঝরে গেছে। তাঁর এই অকাল বিদায় আমাদের চিরকালই অভিভূত ও বিষণ্ণ করে
রাখবে। আমরা বার বার স্নাত হবো তাঁর কাব্যসলিলে আর মনে পড়বে সুকান্তর মতোই, তবে
ভিন্ন আরেক আধুনিক কবির কথা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন