উত্তরকথা
(১৬)
আষাঢ়ের আকাশ জুড়ে থরে থরে সাজানো মেঘের দলা। সেই মেঘ ও
হাওয়াভরা আকাশের প্রেক্ষিতে কেমন এসে পড়ে বক্করের ঘোড়ার গাড়ি। আর সেই সজল চোখের
সাদা কেশর ও তামাটে বর্ণ ঘোড়াটির ছুটে চলা আপনমনে, এ এক মায়ামেদুর দৃশ্যপট রচনা
করে ফেলেই বা যেন। শালকুমার নাথুয়া কালপানি দেবির হাট আরো কত কত হাটগঞ্জের
ধুলো ওড়াতে ওড়াতে বক্কর তার তামাটে ঘোড়াটিকে নিয়ে পরিক্রমণ করতে থাকে। এ এক চিরায়ত
দৃশ্যখণ্ডই তৈরী করে ফেলে যা অগনণ মিথের সায়রে প্রান্তিক জনমানুষের ঘুম ও জাগরণে
মিশে যেতে থাকে। মেঘলা আকাশের নিচ দিয়ে যেতে যেতে বক্করের শরীরে দুলুনি চলে আসলে
সে তো আর নিজেকে গোলমরিচের বস্তার আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে পারে না! সর্বঅঙ্গে তাই গান
জড়িয়ে নিতে থাকে বক্কর, নিজেকে গানের খুব ভিতরে প্রবেশ করাতেই থাকে বুঝি বা-
‘চলে রে মোর ঘোড়ার গাড়ি রে
ফাঁকা রাস্তা দিয়া
আরে নউদারি নাইয়রিগুলান
দেখি থাকে চায়া রে’
(১৭)
জটিলার কথা খুব মনে পড়ে
সোমেশ্বরীর। তার বাল্যসখী। একসাথে কত কত মুহূর্তযাপন তাদের। সেজবিলের বিস্তীর্ণ
প্রান্তর, বাওকুমটা বাতাসের মধ্য দিয়ে অন্তহীন ছুটে চলা, অন্তেবুড়ির বাটা থেকে
চুরি করে আনা মজা গুয়া, শশীবালাদের দলের সাথে বৈরাতী ও কুশানের নাচে পা মেলানো আর
স্বপ্নে স্বপ্নে দেখে ফেলা মইষাল বন্ধুর বাবড়ি চুল আর বাঁশীর ফুঁ। তারপর জীবন কোথায় যে নিয়ে গেল সবকিছু! জটিলা চলে গেল ময়নাতলি। সোমেশ্বরীও জুড়ে
গেল কইকান্তর জীবনে। ধান পাট তামাকের উজ্জ্বল এক ভুবনমায়ায়। কিন্তু বাল্যের সেই সব
দিনের কথা তাকে অন্যমনষ্ক করে তুললেও সে কি আর ফিরে যেতে পারে পুর্বজন্মের দিকে! হয়
না। উত্তরের খোলানে খোলানে হলখল করে খেতের ধান। ধানের বুকে দুধ জমলে সোমেশ্বরী
কার্তিক মাসের পৃথিবীতে কেমন রহস্যের মতন মেলে দিতে থাকে তার হলুদ মাখা দু হাতের
করতল। এগিনায় ঘুরে বেড়াতে থাকা মোরোগেরা সমস্বরে ডেকে ওঠে আর হাঁসেরা নেমে পড়ে
পুকুরের স্নিগ্ধ জলের সান্নিধ্যে। সুখের এক ঘোর বুঝি এইসব। আর প্লাবনের মতন ভিজে
যেতে থাকে দুই চোখ তার। বুঝি বাবার দ্যাশের এক কুরুয়া পাখি তাকে গান শোনাতে আসে, তাকে
উদাসীনতা শেখাতে আসে, আবহমানতায় ঘুরিয়ে মারতে মারতে জীবনের পরতে পরতে দার্শনিকতার
বিস্তার দেখাবার তীব্র প্রয়াস তাকে জনমভর এক শূন্যপুরাণের গ্রন্থির দিকে, গানবাড়ির
দিকে এগিয়ে দিতে থাকে রাত্রির রহস্যান্ধারের সঙ্গনৈকট্যের দিকে, খুব চুপিসারেই
বুঝি বা। এখানেই তো জীবনের মহামহিম হয়ে ওঠা আট নদী দশ ফরেষ্টের ব্যপ্ততর কুহকের
অছিলায়!
(১৮)
‘গদাধরের পারে পারে রে
ও তোর মাহুতে চড়ায় হাতি
কি মায়া নাগাইলেন মাহুত রে’
হাটের মায়ায় জড়ানো জীবনের ফাঁকে ফোঁকড়ে রাধাকান্ত আর
কইকান্ত নিজেদের সীমাপরিসীমার কোন তলই
হয়তো পায় না। তাই তারা হাটের গমগম বিস্তারে নিজেদেরকে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর চারপাশের
চেনা অচেনার নিগরে বৃত্ত ভাঙ্গার গানের
সাজানো সিজিলমিছিল যেন চক্রাকারে পাক খেতে খেতে নদীর চরের দিকে ছুটে চলা বাতাসের
প্রবাহে জায়মানতার এক আবহ রচনা করে ফেলে। আর এর পরে তো বলার থাকে না কিছু! কেবল শামুকতলার হাট থাকে। কুপির
আলোর রহস্যের কিনারে কিনারে ভাসতে থাকে পাইকার আর দালালদের উচ্চকিত গান-
‘হাটের মধ্যে শামুকতলা
হালুয়া গরুর নাগছে মেলা
আরে মেচ গারো সাওতাল
নাগেয়া দিল কাউটাল
ওরে ছেউটি গরুর নেখায় ঝোখায় ভার’
জীবন জমে ওঠে এভাবেই। উত্তরের
মাঠে মাঠে ধানের গন্ধের মতন আন্ধারাতিতে জোনাই জ্বলে। আবহমানের সব মানুষজনের জীবন
ও শূন্যতা আশ্চর্য এক দর্শন ছড়িয়ে দিতে
থাকলে আর কিছুই করার থাকে না। প্রবাহিত নদীর জলে তখন ব্রতকথা ও শোলার মুটুক ভাসে, ভেসেই
যায় তারা নিয়তিতাড়িত, বুঝি বা হালাউ হালাউ দুধের ঘটির মতন। আর জঙ্গলবাড়ির বাঘ ডেকে
ওঠে, গানের পিঠে গানের মতন; কথার পরে কথার মতন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন