বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

অদ্বয় চৌধুরী

ফ্রম জেমস বন্ড, উইথ ইডিওলজি





(ষষ্ঠ পর্ব)


মাস পর্নোগ্রাফি ও বন্ড-ইডিওলজি

 

“In an address to male spectators, the body of woman is constructed as a spectacle and the mise en scène of representations of women's bodies coded in various ways as both to be looked at by the spectator and, in the same process, to evoke sexual arousal in him.”

 

 

১৯৫৩ সালপ্রথম ‘প্লেবয়’ পত্রিকা প্রকাশিত; প্রথম বন্ড-কাহিনী ‘ক্যাসিনো রয়াল’ প্রকাশিত। এই দু’টি গ্রন্থই প্রথম ‘মাস পর্নোগ্রাফি’ হিসেবে অবিদিত। সেক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী ভাবে প্রশ্ন উঠবে পর্নোগ্রাফি বলতে কি বোঝানো হয়েছে? এক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি বলতে ‘মেল পাওয়ার’-কে বোঝানো হয়নি, কোনো যৌনক্রিয়ার পরিবেশনকেও না। বরং এক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি বলতে, ডেনিং-এর ভাষায়, বোঝানো হয়েছে “…first, a narrative structured around the look, the voyeuristic eye, coding woman as its object, and second, a culture whose very discourse is dominated by, indeed translated into, a code of sexual signifiers” পর্নোগ্রাফিকে ভয়ারিজম-এর প্রকারভেদ হিসাবে ধরে এগোলে বলাই যায় যে শুধুমাত্র কোনো যৌনক্রিয়ার প্রদর্শন পর্নোগ্রাফি নয়, বরং নগ্নতার বিভিন্ন স্তরে নারী-শরীরের পরিবেশনকেই পর্নোগ্রাফি বলা যায়। 


এই সূত্রেই নারী-শরীর এক পণ্যে পরিণত হয়; নারী-শরীর প্রদর্শনের কারণে ক্রেতারা আকৃষ্ট হয় পণ্যের প্রতি। এই সূত্রেই উপরে উদ্ধৃত অ্যানেট কান-এর উক্তিটি অর্থবহ হয়ে ওঠে। বিশেষত জেমস বন্ডের কাহিনীর নিরিখে। আসলে পর্নোগ্রাফি কোনো ব্যতিক্রমী বিষয় নয়। অন্য কোনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বিষয় পরিবেশনার থেকে পর্নোগ্রাফির পরিবেশন কোনোভাবেই আলাদা মাত্রা রাখে না। বরং পর্নোগ্রাফি দখল করে, কান-এর ভাষায়, “one point in a continuum of representations of women, a continuum along which are also situated such commonly available and highly socially visible representations as advertisements”নারী-শরীরের বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা— এই আঙ্গিক থেকে বিচার করলে বন্ডের গল্পগুলি অবশ্যই ‘মাস পর্নোগ্রাফির’ ভিন্ন রূপ হিসেবে পরিগণিত হবে। যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে পশ্চিম ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় তৈরি হওয়া বুর্জোয়া ভোগবাদী কনজিউমার সমাজের যৌন চাহিদাকে প্রকাশ করে এই বন্ড-কাহিনীগুলি।

 

বন্ডের কাহিনীতে, বিশেষত ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ উপন্যাসে, সেই অর্থে কোনো যৌনক্রিয়ার বর্ণনা নেই। আছে ভোগ্যপণ্য হিসেবে নারী-শরীরকে বিভিন্ন নিরিখে ও পদ্ধতিতে ‘দেখার’ বর্ণনা। এমনিতেই বন্ড ‘লাইসেন্স টু কিল’ ক্ষমতাপ্রাপ্তএক্ষেত্রে, ডেনিং-এর ভাষায়, ‘লাইসেন্স টু লুক’-ও অর্জন করেছে বন্ডএই ‘দেখার’ প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মাটির তলার টানেলের ভিতরে লুকানো একটি পেরিস্কোপের সাহায্যে যখন বন্ড ইস্তানবুলের রাশিয়ান এমবাসির ভিতরের দৃশ্য দেখে। সেখানেই সে প্রথম রুশ ক্লার্ক টাটিয়ানা রোমানোভাকে দেখতে পায়। তারপরে ‘স্ট্রং সেন্সেশন্স’ নামক ১৮ নম্বর চ্যাপ্টারে জোরা এবং ভিদা নামের দুই জিপসি মহিলার রোমাঞ্চকর লড়াইয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। এরা দু’জন জিপসি-প্রধানের ছেলের দখল নেবার জন্যে একে-অপরের সঙ্গে লড়ছে। এই লড়াই বন্ড ও কেরিম দু’জনে একসঙ্গে দেখে:

“Bond held his breath at the sight of the two glistening naked bodies, and he could feel Kerim’s body tense beside him. The ring of gypsies seemed to have come closer to the two fighters. The moon shown on the glittering eyes and there was the whisper of hot, panting breath.”

 

এই দুই যুদ্ধরত মহিলা লড়াইয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে তাদের অঙ্গের শেষ বস্ত্র-খণ্ডটিও দর্শকদের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এখানে দর্শক ও পাঠক একই সারিতে অধিষ্ঠান করে। দর্শক-পাঠকও ওই বস্ত্র-খণ্ডের ঘ্রাণ ও স্বাদ নেয়, এবং সরাসরি ওই অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে ওঠেকির্লেঙ্কো-হত্যার দৃশ্যে হত্যাকাণ্ডটি গুরুত্বহীন, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের স্থানটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ: mouth of Marilyn Monroe’—

“Bond rested his forearm against the door jamb and raised the tube to his right eye…The outline of a huge woman’s face and some lettering appeared…Bond inched the glass down the vast pile of Marilyn Monroe’s hair, and the cliff of forehead, and down the two feet of nose to the cavernous nostrils. A faint square showed in the poster. It ran from below the nose into the great alluring curve of the lips…Out of the mouth of the huge, shadowed poster, between the great violet lips, half open in ecstasy, the dark shape of a man emerged and hung down like a worm from the mouth of a corpse.”



 

কির্লেঙ্কোর মৃত্যু এবং সেই মৃত্যুর দৃশ্যটি ভীষণ তুচ্ছ ও ছোটো হয়ে পড়ে মনরোর পোস্টারে আঁকা আকারের দিক থেকে বিশাল বেঢপ হলেও ভীষণ লোভনীয় ঠোঁটের ছবির পাশে। অদ্ভুত ভাবে এখানে ‘দেখার’ বিষয় কোনো নারী-শরীর নয়, বরং এক ‘কমোডিফায়েড ইমেজ’। অ্যানেট কান নারী-শরীর ও বিজ্ঞাপনের যে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন তত্ত্বের মাধ্যমে তার বাস্তব দৃষ্টান্ত। এ হল কনজিউমার ক্যাপিটালিজম-এর চূড়ান্ত প্রতীক। কির্লেঙ্কোর হত্যাস্থল থেকে হোটেলের ঘরে ফিরে বন্ড দেখে নগ্ন টাটিয়ানা তার বিছানায় অপেক্ষারতা। তারা প্রথা-মাফিক যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি অদ্ভুত মোচড় অপেক্ষা করছে: গুপ্তচর বন্ড নিজে এখানে গুপ্তচরবৃত্তির শিকার হয়বন্ড এবং টাটিয়ানার শরীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের বিশদ বর্ণনা না দিয়ে ফ্লেমিং এখানে পাঠকদের ও রুশ গুপ্তচর বাহিনীর মাঝে এক অদ্ভুত সমীকরণ আঁকেনসমান্তরাল অবস্থানের ভিত্তিতে তাদের সমগোত্রীয় করে তোলেনএখানে রুশ গুপ্তচর ও পাঠক দু’ পক্ষই একসঙ্গে কিছু দৃশ্যের ও অভিজ্ঞতার অংশীদার হয়:

“Above them, and unknown to both of them, behind the gold-framed false mirror on the wall over the bed, the two photographers from SMERSH sat close together in the cramped cabinet de voyeur, as, before them, so many friends of the proprietor had sat on a honeymoon night in the stareroom of the Kristal Palas. And the viewfinders gazed coldly down on the passionate arabesques the two bodies formed and broke and formed again, and the clockwork mechanism of the cine-cameras whirred softly on and on as the breath rasped out of the open mouths of the two men and the sweat of excitement trickled down their bulging faces into their cheap collars.”


রুশ গুপ্তচররা এই ভিডিওটি তৈরি করেছিল বন্ডের সম্মান ও জনপ্রিয়তাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। এখানে পাঠক-দর্শকরাও এক প্রকারের ফটোগ্রাফারের ভূমিকা পালন করে। ফ্লেমিং-এর বর্ণনা তাদের চোখে ফটোগ্রাফে অনূদিত হতে থাকে

 

বন্ডের গল্পে পর্নোগ্রাফির জন্যে আলাদা করে স্থান ও সময় রাখা হয়নি। বন্ডের নিজস্ব বৃত্তির মধ্যে, এবং তার সাধারণ জীবন-প্রণালীর পরতে পরতে পর্নোগ্রাফিক বিষয় স্থান করে নিয়েছে। এটাই কনজিউমার ক্যাপিটালিজম-এ যৌনতার নতুন মাত্রা। কনজিউমার ক্যাপিটালিজম-এর বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, হার্বার্ট মার্কাস-এর যুক্তি অনুযায়ী, “the libidinalization of the workplace and daily life” মার্কাস এই ঘটনাটিকে ‘repressive desublimation’ নামে অভিহিত করেন। এই পরিস্থিতিতে যৌনতা পরিণত হয় ‘মাস্টার কোড’-এ। এই ‘মাস্টার কোড’-এ অন্যান্য সমস্ত ডিসকোর্স— কমার্শিয়াল, পলিটিকাল, ফিলোজফিকাল, এমনকি রিলিজিয়াস— অনূদিত হয়ে যায়। এখানে, এই সেক্সুয়াল ডিসকোর্সে, ‘লিবারেশন’ এবং ‘রিপ্রেশন’-এর মধ্যে কোনো সংঘর্ষ ঘটে না। ডেনিং এই বিষয়ে বেশ বিশদে আলোকপাত করেছেন:

“The apparent liberation of sexuality from patriarchal norms— the so-called ‘sexual revolution’— is both a genuine change in sexual practices and a reconstitution of sexuality in a fetishized mode that continues to subordinate and oppress women.”

 

মেয়েদের প্রতি দমনমূলক ও নিপীড়নমূলক আচরণ ও ব্যবহারের প্রত্যক্ষ প্রমাণ বন্ড নিজেই; মহিলাদের প্রতি বন্ডের বুর্জোয়া ‘মেল শভিনিস্টিক’ মানসিকতা—

“He sighed. Women were for recreation. On a job they got in the way and fogged things up with sex and hurt feelings and all the emotional baggage they carried around. One had to look out for them and take care of them. ‘Bitch’, said Bond…”

 

মহিলাদের প্রতি বন্ডের এই দৃষ্টিভঙ্গি ভীষণভাবে গতানুগতিক‘ব্রিটিশ সুপ্রিমেসি’ বজায় রাখার থেকেও ‘মেল সুপ্রিমেসি’ বজায় রাখার ক্ষেত্রে লেখক ফ্লেমিং বেশি আগ্রহী। সেই কারণে কেরিমের তুর্কীয় বাবার দ্বারা তার ব্রিটিশ মা ‘বশ’ হয়। কেরিমও একইভাবে ‘বেসার্বিয়ান হেল-ক্যাট’ মহিলাকে ‘বশ’ করে। পুরুষতান্ত্রিকতার বৃহত্তম নমুনা হচ্ছে এই কেরিম: ইস্তানবুলের সমস্ত ব্রিটিশ গুপ্তচর, যারা কেরিমের হয়ে কাজ করে, তাদের সবারই বাবা কেরিম নিজে। এছাড়াও জিপসি-প্রধানের ছেলেকে ‘জয়’ করার জন্যে তারই হুকুমে দুই মহিলা প্রাণঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধ এককপ্রকারের রিচুয়াল, এক ধর্মীয় আচার, এবং অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিকতার উপাসনা। এখানেও ফ্লেমিং-সৃষ্ট চরিত্র বন্ড বুর্জোয়া ঔপনিবেশিকতাবাদী ইডিওলজির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিক প্রবন্ধের পঞ্চম পর্বের শুরুতে এবং শেষে টোনি বেনেট-এর ‘ideologies of sexism and imperialism’ বিষয়ক পর্যবেক্ষণের সামান্য একটু উল্লেখ আছে। এখানে সেই পর্যবেক্ষণটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। ফলস্বরূপ বিশদ বিবরণের দাবি রাখে:

“…the ideologies of sexism and imperialism are inscribed within the very form of the Bond novels…As the relations between Bond and the villain and between Bond and the girl develop and move toward their resolution, a series of collateral ideological tension is thus simultaneously worked through and resolved. It is in this way that the Bond novels achieve their ‘ideological effect’— the effect, figuratively speaking, of placing women back in position beneath men and putting England back on top.”

 

এই পর্যবেক্ষণটি বন্ড-বাহিত সমস্ত ইডিওলজিকে একত্রে প্রকাশ করে, এবং যথাযথ ভাবেবিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায়, সম্পর্কের ওঠা-নামায়, গল্পের গতিবেগের প্রতিটি পরতে বন্ড নির্দিষ্ট ইডিওলজির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে, প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ওঠে। তবে এই ইডিওলজিগুলো পরোক্ষ উপায়ে পরিবেশিত হয়; রঙ্গিন মোড়কে, রোমাঞ্চের আবরণে পেশ করা হয়। এই পরোক্ষ ইডিওলজি বাদে ফ্লেমিং ও বন্ডের একটি প্রত্যক্ষ ইডিওলজিও আছে: রাশিয়া-বিরোধিতা, রাশিয়া-কুৎসা।

 

 

 

সূত্র ও ঋণ

1)  Michael Denning. ‘Licensed to Look’.
2)  Annette Kuhn. ‘The Body in the Machine’. p. 115.
3)   Herbertt Marcuse. One-Dimensional Man. Beacon Press. Boston, 1964.
4)  Ian Fleming, Casino Royale. Hodder and Stoughton. London, 1988), p. 33.
5)  Tony Bennet. ‘James Bond as Popular Hero. U203 Popular Culture: Unit 21. Milton Keynes: Open University Press, 1982.
6)  Jerry Palmer. Thrillers: the deviant behind the consensus’. Politics and Deviance. ed. I. Taylor and J. Taylor. Harmondsworth: Penguin, 1973.
Quoted in ‘Figures of Bond’. Tony Bennet and Janet Woollacott. Popular Fiction: technology, ideology, production, reading. Routledge. London and New York, 1990.


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন