এককালে প্রবাসী বাঙালিদের কিছু চারিত্র্য ছিলো। হয়তো এখনও আছে। তবে অন্যরকম। বিশেষত যাঁরা সেকালে বড়সড় পদের অধিকারী, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাহেবগিরি করতেন, সেরকম জবরদস্ত টাইপ বাঙালিরা। এর সঙ্গে ছিলেন সর্বশক্তিমান ধরনের ডাক্তার বা আইনজীবীর দল। দিল্লি বা হায়দরাবাদ, বম্বে বা কটক, ম্যাড্রাস বা দেহরাদুন, পাটনা বা পুনে, কোথায় ছিলেন না তাঁরা? একালের মানুষদের সহজভাবে বোঝাতে গেলে বলা যায় বিধান রায়,
কমল মিত্র ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিবিধ অনুপানের পাঞ্চ মিশিয়ে তৈরি হতেন সেই সব রাশভারি মানুষেরা। বাংলার বাইরে বাঙালির ভাবমূর্তি তাঁরাই ধরে রাখতেন। পুরা হিম্মত সে। আজ যে সর্বত্র বাঙালিদের টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নেওয়ার সর্বভারতীয় 'ষড়যন্ত্র' চোখে পড়ে সেসব তাঁদের আমলে কেউ করার সাহস করতো না। এরকম শেষ বিখ্যাত বাঙালি,
যাঁর সর্বভারতীয় ভাবমূর্তি অবাঙালিদের কাছে এরকম
awesome ছিলো, তিনি
কিন্তু বাঙালিদের নিজভূমে বহু মানুষের কাছে রীতিমতো নিন্দিত হতেন সময়ে অসময়ে। হ্যাঁ, তিনি জ্যোতিবাবু। 'দলে'র আদেশে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ হলেও তিনি যে প্রধানমন্ত্রিত্ব অস্বীকার করেছিলেন,
তা দেশের বাকি অংশের মানুষের কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিলো। মনে পড়ে আমার পাটনার অফিসে তখন একমাত্র 'বঙ্গালি' হিসেবে বহু মানুষের সশ্রদ্ধ,
বিস্মিত অভিনন্দন আমার কাছে পৌঁছেছিলো। সেই উষ্ণতা কখনও ভোলা যায় না। এই বিস্ময়ের পুনরাবৃত্তি দেখেছি শ্রীনগরের ট্যাক্সিচালক, হায়দরাবাদের দর্জি অথবা বম্বের লোক্যাল ট্রেনের সহযাত্রীদের মধ্যে। আজকে যখন দেখি সারাদেশে বিপুল পরিমাণ মানুষের মনে 'বাঙালি' মানে ক্ষীণপ্রাণ, কলহপ্রবণ, আলস্যপ্রিয় কিছু মানুষের ভাবমূর্তি,
যারা নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি, বোমাবাজি করা ছাড়া আর কিছুতে রুচি রাখে না। কষ্ট হয়। অবশ্য এই ছবিটি দু'চার দশক ধরেই পাবলিক খায়। কিন্তু হল অফ ফেমে সাম্প্রতিক যোগ হয়েছে নিপুণভাবে তোয়ালে মুড়ে পাপের টাকাকে বাঙালিরাও আদিগঙ্গায় ধোয়া 'মায়ে'র চরণের ফুলের মতো পবিত্র করে দিতে পারছে। পিসি সোরকারের ওয়াটার অফ ইণ্ডিয়ার মতো'ই সেই ম্যাজিক নিয়ে শাবাশির অন্তহীন ঢেউ। বঙ্গসংস্কৃতিতে পাপের টাকা চিরকালই ছিলো। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মানুষের সচেতন-অবচেতন প্রতিরোধ প্রয়াস বাকি দেশে বাঙালিদের 'সততা'
বিষয়ে একটা ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছিলো। চারপুরুষের প্রবাসী বাঙালি হিসেবে তা নিয়ে শ্লাঘাও বোধ করতুম। কিন্তু সেই মূর্খতা থেকে বাঙালি আজ মুক্ত। এ মাটি সোনার মাটি।
যাকগে। এখন প্রশ্ন হলো লেখাটির শীর্ষকের সঙ্গে এই সব প্রসঙ্গের সম্পর্ক কোথায়? আসলে সকালবেলা একটা গান শুনে ঘুম ভেঙেছিলো, আজ। "কে আবার বাজায় বাঁশি, এ ভাঙা কুঞ্জবনে।" আমার এক প্রিয় শিল্পী শিখা বসুর কণ্ঠে। লোকপ্রিয় এই গানটির যে শৈলীটি তিনি গাইছিলেন সেটি অপেক্ষাকৃত চেনা ফর্ম্যাট, যেমন সুচিত্রা মিত্র বা কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের থেকে আলাদা। কিন্তু অতুলপ্রসাদের সীমায়িত ভাণ্ডার থেকে তুলে আনা এই রত্নটি বহুযুগের ওপার থেকে একটি সন্ধ্যা ফিরিয়ে নিয়ে এলো। একজন মানুষের সূত্রে। একজন সেকালের বাঙালি। আমি তখন নিতান্তই স্কুল পড়ুয়া বালক।
যাকগে। এখন প্রশ্ন হলো লেখাটির শীর্ষকের সঙ্গে এই সব প্রসঙ্গের সম্পর্ক কোথায়? আসলে সকালবেলা একটা গান শুনে ঘুম ভেঙেছিলো, আজ। "কে আবার বাজায় বাঁশি, এ ভাঙা কুঞ্জবনে।" আমার এক প্রিয় শিল্পী শিখা বসুর কণ্ঠে। লোকপ্রিয় এই গানটির যে শৈলীটি তিনি গাইছিলেন সেটি অপেক্ষাকৃত চেনা ফর্ম্যাট, যেমন সুচিত্রা মিত্র বা কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের থেকে আলাদা। কিন্তু অতুলপ্রসাদের সীমায়িত ভাণ্ডার থেকে তুলে আনা এই রত্নটি বহুযুগের ওপার থেকে একটি সন্ধ্যা ফিরিয়ে নিয়ে এলো। একজন মানুষের সূত্রে। একজন সেকালের বাঙালি। আমি তখন নিতান্তই স্কুল পড়ুয়া বালক।
দুজনকে নিয়ে একটা আড্ডা জমেছিলো সেই সন্ধ্যায়। আমার পিতৃদেব ও শহরের অন্যান্য সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষদের। তাঁদের একজন দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল এবং অন্যজন ডাঃ কালীকিংকর সেনগুপ্ত। ডাঃ কালীকিংকর সেনগুপ্ত পেশায় ছিলেন একজন প্রবীণ চিকিৎসক,
কিন্তু নেশায় ছিলেন একজন কবি, প্রাবন্ধিক,
সারস্বত সাধক। সেকালে তাঁর সম্বন্ধে অনেকেই জানতেন একজন শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তি হিসেবে। তবে তিনি মোকাম কলকাতার মানুষ। আর অন্যজন দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল ছিলেন সেকালের প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে একজন অতি পরিচিত, প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। তাঁর ব্যক্তিপরিচয় সম্বন্ধে তিনি বলতেন যে, তাঁর বাবার নামে লখনউতে একটি রাজপথ আছে,
কিন্তু সেখানে তিনি থাকেন না। তিনি থাকেন তাঁর মায়ের সঙ্গে। মানে তাঁর মায়ের নামে রাস্তাটি তত চওড়া না হলেও সেখানেই তাঁরা স্বচ্ছন্দ। সেই সরোজিনী দেবী মার্গেই ছিলো তাঁদের ভদ্রাসন।
সেই বিরলকেশ, শালপ্রাংশু মানুষটি প্রথম জীবনে অতুলপ্রসাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সঙ্গী ছিলেন। কবির প্রতি শ্রদ্ধাবশে সেকালে লখনউ শহরে বিভিন্ন সেবামূলক কাজকর্মে নিয়োজিত
'অতুল সেবাদলে'র কর্ণধার ছিলেন। পড়াশোনা করেছিলেন দেশের প্রথম কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র রুড়কি'তে। স্বাধীনতার আগে থেকেই অবিভক্ত উত্তর প্রদেশ পূর্ত বিভাগের মুখ্য অধিকর্তা ছিলেন। বিংশ শতকের শুরুতে তিনি গ্ল্যাসগো ও ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনেক ডিগ্রি হাসিল করেন । একজন দুঁদে উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা হিসেবে বাঘ ও গরুকে একঘাটে জল খাওয়াতেন
(লখনউয়ের লোকেদের কাছে শুনেছি)।
তাঁরই ছোটভাই পাহাড়ি সান্যাল ছিলেন ম্যরিস কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। লখনউয়ের ম্যরিস কলেজ (ভারতের প্রথম সঙ্গীত কলেজ)
স্থাপনার পিছনে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন,
এই সান্যাল পরিবার তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাঁর কথাবার্তার মধ্যে ধূর্জটিপ্রসাদ, রতনজনকার,
ফ্যয়েজ খান, দিলীপকুমার বা রবীন্দ্রলাল রায় অনায়াসে আসা যাওয়া করতেন রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ,
এমন কি জবাহরলালের সঙ্গে। ভারি গুম্ফ ও ভরাট কণ্ঠস্বর, আশি পেরোনো একজন ব্যক্তিত্বের পরাকাষ্ঠা।
সেদিন আড্ডার তেমন কোনও বিষয় ছিলো না। কিন্তু অতুলপ্রসাদকে নিয়ে দ্বিজুবাবুর ( দুটো নাম ছিলো তাঁর সম্বোধন পদে; দ্বিজুবাবু আর সান্যালসাহব) স্মৃতিচারণ ও গানই ছিলো মুখ্য আলোচ্য। এই গানের সূত্রেই তিনি আমার মা'কে বিশেষ স্নেহ করতেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরেই তিনি মা'কে আদেশ করলেন গান শোনাতে। আমার মনে আছে মা যখন 'কে আবার বাজায় বাঁশি' গাইছিলেন তখন কালীকিংকর মুগ্ধ হয়ে তারিফ করছিলেন। কিন্তু দ্বিজুবাবু চুপ করে শুনছিলেন। গান সারা হলে তিনি মাকে বললেন যে,
গান তাঁর খুব ভালো লেগেছে, কিন্তু এত উঁচু স্কেলে বেশি গাইলে গলার ক্ষতি হতে পারে। টিম্বার নষ্ট হবার ঝুঁকি আছে। ওনার ব্যক্তিত্ব এমন জাঁদরেল ছিলো যে তার উপর কথা বলার মতো কেউ ঐ আসরে ছিলো না। তিনি সব তর্কের শেষ কথা বলার জন্যই যেন জন্মেছিলেন। কিন্তু যেই তিনি থামলেন,
কালীকিংকর মাকে বললেন,
আমি ডাক্তার হিসেবে তোমাকে বলছি তুমি তোমার স্কেল পাল্টাবে না। তোমার গলায় এই স্কেলটি খুব মানাচ্ছে,
কোনও ক্ষতি হবে না। সভাস্থ সবাই হেসে উঠলেন। দ্বিজুবাবুও।
মনে আছে দ্বিজুবাবু সেই সভায় কয়েকটি আলটপকা মন্তব্য করেছিলেন। সেকালের গ্রাম্ভারি মানুষদের মতো তাঁর কিছু নিজস্ব সীমাবদ্ধ ভাবনা ছিলো। সামন্ততান্ত্রিক কৌণিকতা তার একটি অংশ। একটি মজার মন্তব্য করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ নাকি লাগামছাড়া অনেক অনেক লেখার জন্য ( গান) গুণমানের ক্ষেত্রে নানা সময় আপোস করেছিলেন। কিন্তু অতুলপ্রসাদ কখনও আপোস করেননি। ঐ বালক বয়েসেও এই উক্তিটি আমার 'কুছ হজম নহি হুয়া'। কিন্তু ঐ সভায় শহরের যে মুখ্য ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা ঐ প্রবীণ মানুষটির প্রতি সাবেক প্রবাসী বাঙালিয়ানার সৌজন্যবোধে কোনও তর্কের অবতারণা করেননি। আরও কয়েক বছর পরে হলে এই শর্মা হয়তো 'এক হাত দেখে নিতো'।
মনে আছে দ্বিজুবাবু সেই সভায় কয়েকটি আলটপকা মন্তব্য করেছিলেন। সেকালের গ্রাম্ভারি মানুষদের মতো তাঁর কিছু নিজস্ব সীমাবদ্ধ ভাবনা ছিলো। সামন্ততান্ত্রিক কৌণিকতা তার একটি অংশ। একটি মজার মন্তব্য করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ নাকি লাগামছাড়া অনেক অনেক লেখার জন্য ( গান) গুণমানের ক্ষেত্রে নানা সময় আপোস করেছিলেন। কিন্তু অতুলপ্রসাদ কখনও আপোস করেননি। ঐ বালক বয়েসেও এই উক্তিটি আমার 'কুছ হজম নহি হুয়া'। কিন্তু ঐ সভায় শহরের যে মুখ্য ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা ঐ প্রবীণ মানুষটির প্রতি সাবেক প্রবাসী বাঙালিয়ানার সৌজন্যবোধে কোনও তর্কের অবতারণা করেননি। আরও কয়েক বছর পরে হলে এই শর্মা হয়তো 'এক হাত দেখে নিতো'।
আসলে 'গান' ব্যাপারটা নিয়ে তাঁর কিছু সহজাত অধিকার ছিলো। সাবেক লখনউয়ের বনেদি সাংগীতিক বোধ,
সঙ্গে নিজস্ব তইয়ারি এবং দীর্ঘকাল বিদেশবাসে সেদেশের সঙ্গীত নিয়ে চর্চা তাঁকে একটা অন্য ধরনের পরিণতি দিয়েছিলো। রবীন্দ্রসঙ্গীতে গায়কের স্বাধীনতা বা রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং অতুলপ্রসাদীর সুরপ্রয়োগের স্ট্রাকচার,
মঞ্জু গুপ্ত ও কৃষ্ণা চট্টোর গায়নশৈলী,
অতুলপ্রসাদীতে সুরের শুদ্ধতা বিষয়ে তাঁর মতামত ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। সব আলোচনারই উপভোগ্য অংশটি ছিলো তাঁর স্বকণ্ঠে গীত গানের টুকরোগুলি।
সেই অশীতিপর সুররসিক মানুষটির আসর জমানোর বৈঠকী দক্ষতা ছিলো অনস্বীকার্য।কণ্ঠস্বর ছিলো মেঘমন্দ্র। 'কে আবার বাজায় বাঁশি'তে সংলাপধর্মী বাণী, যেমন
'হয় তুমি থামাও বাঁশি, নয় আমায় লওগো আসি' কীভাবে উচ্চারণ করতে হবে,
তার কিছু প্রয়োগ গেয়ে শুনিয়েছিলেন, মনে আছে। সেই ভঙ্গি হয়তো বাংলাগানে প্রয়োগের ব্যাপারে আমাদের আপত্তি থাকতে পারে। কারণ সেগুলি মূল হিন্দি সুরের কাঠামোর সঙ্গে ওতপ্রোত। কিন্তু তারও একটা পৃথক ফ্লেবার আছে। তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা উদাহরণ দেখেছিলুম আমাদের ক্লাবে ( সবুজ কল্যাণ সঙ্ঘ)
অত্যন্ত বিশৃঙ্খল ছেলেছোকরাদের চ্যাংড়ামি আর হইচইয়ের মধ্যে গভীর কণ্ঠস্বরে 'এতো হাসি আছে জগতে তোমার'
গেয়ে সবাইকে স্তব্ধ করে
দিয়েছিলেন। ভৈরবিতে বাঁধা এই গানটির প্যাথোস অতুলপ্রসাদের অনেক গানের মধ্যেও অনন্য। এই গানটির পিছনে একটি ছোট্টো গল্প আছে। একদিন বিকেলবেলা আদালত থেকে ফেরার পথে অতুলপ্রসাদ রাস্তার মোড়ে তাঁর জুড়িগাড়ি দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেন,
গাড়ির জানালা দিয়ে একজন মহিলা হাত বাড়িয়ে সাহায্য প্রার্থনা করছেন। অবগুণ্ঠনের ফাঁক দিয়ে একপলক তাঁর মুখটি দেখেই অতুলপ্রসাদ স্তম্ভিত হয়ে যা'ন। সেই মহিলা একসময় ছিলেন লখনউয়ের সঙ্গীতজগতের একছত্র অধীশ্বরী। বিখ্যাত বাইজি। ধনেজনে প্রাসাদে ঘেরা তাঁর ভুবন অতুলপ্রসাদ দেখেছেন বহুবার। মহিলাও সেনসাহবকে চিনতেন ভালোভাবে। গাড়ির মধ্যে তাঁকে বসে থাকতে দেখে তিনি পলকের মধ্যে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। গাড়ি থেকে নেমে অতুলপ্রসাদ খুঁজলেন তাঁকে। কিন্তু পেলেন না। বিষণ্ন কবি সেদিন বাড়ি ফিরেই এই গানটি বাঁধলেন। এই সব গল্পকথা আমরা কিছুই জানতুম না তখন। কিন্তু ঐ অসহিষ্ণু অনগ্রসর শ্রোতাসমূহের কলরবকে
গানটির বিষাদমুখ সুরের টানে মৌনতায় ঢেকে ফেলার জন্য একজন গায়কের যে এলেম লাগে তা কিছু অনুভব করেছিলুম সেদিন। বাহ্যিকভাবে একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তিত্বের মনের গভীরে যে একটি কোমলতম, সংবেদী রোমান্টিক শিল্পীসত্ত্বা এভাবে লুকিয়ে থাকে তা বুঝতে অবশ্য সময় লেগেছিলো অনেক।
'বলিহারি বিধি, বলিহারি যাই তোরে' এই আর্ত ধুয়োটি যেভাবে বারবার ঘুরে আসে এই গানে তাকে ধরা কী অতো সহজ?
এই মানসিক গড়ন,
মনোজগতের ব্যপ্তিটিই ছিলো সেকালের বাঙালির ট্রেডমার্ক। আবার এখন যেটা বেমানান লাগে সেটি ছিলো তাঁর চিন্তার রক্ষণশীলতা। লখনউতে সঙ্গীত অনুষ্ঠানে দেখেছি তাঁর নির্দেশনায় শিল্পীরা গান শোনাচ্ছেন। মহিলারা অকারণে অতি অবগুণ্ঠিত ও আবৃত। যদিও তার সঙ্গে গানের কোনও যোগ নেই। তবু কৈশোরে এই লৌকিকতাটি রাবীন্দ্রিক রুচিবোধের নিরিখে প্রতিবন্ধক বোধ হয়েছিলো। তিনি যখন মাঝে মাঝে জামশেদপুরে আসতেন, আমার মাকে ডেকে কিছু কিছু অতুলপ্রসাদী গান তাঁর নিজস্ব ধরনে শিখিয়ে যেতেন। মাকে স্নেহ করতেন খুব। বাবাকেও। অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ছিলো অসীম আর গল্পকথা ফুরোতো না কখনও। নিষ্ঠাবান বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ গোটা শ্রীশ্রী চণ্ডী ও শ্রীমদ্ভগতগীতা স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে আবৃত্তি করতে পারতেন। অধ্যাত্মবোধের এই নৈষ্ঠিকতা হয়তো ব্যক্তি আমার কাছে তেমন তাৎপর্য রাখে না। কিন্তু গীতা হোক বা গেওর্গি লুকাচ,
বাঙালির সেরিব্রাল জগতে কেউই অপাংক্তেয় ছিলেন না। কেউ না কেউ তো বাঙালির নিষ্ঠা আকর্ষণ করেই নিতেন। আজ সব চুলোয় গেছে। বাঙালির বাসরঘরের রন্ধ্রপথে অবিরত
'গো'সাপের হানা। আমাদেরও কি সেই সব সেকেলে বাঙালিকে অনুসরণ করে
'ঘরেতে পরবাসী থাকিতে আর পারিনে' গাইতে গাইতে
'গো'লোক যাত্রা করতে হবে? কে জানে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন