বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭

জিনাত রেহেনা ইসলাম

মেয়েখেলা  (পর্ব - ১২)





কর্মক্ষেত্রে যাতায়ত নিয়ে ইন সারভিস ওম্যানদের ও স্থানীয় মহিলাদের অভিজ্ঞতায় বড় ফারাক থেকে যায়। যে সমাজকে খুব কাছ থেকে চেনা তা নিয়ে আবার মুখ ফোটে। দেবী আরাধনার ও পুতুল মুখের সামনে বসে সিগারেটের ধোয়া, অশালীন ভাষায় কথা বলা, নিজের শরীর অন্যপ্রান্তে বসে থাকা মহিলার দিকে ছেড়ে দেওয়ার চেনা চিত্রের বাইরেও আছে কিছু ব্যতিক্রম যা মেয়েরা  মুখে আনতে স্পর্ধা করে না। হয়ত শালীনতায় আটকায়। ট্রেনে পা ছড়িয়ে তাস খেলা, গুপ্ত স্ল্যাং সহ চেনা ভাষা যা মূলত মহিলাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া চলতেই থাকে। মেয়ে ব্যাপারটা যেন আনন্দের এক পুটলি। যেমন করে খুশী এদের দেখা যায়, বলা যায়, ভয় দেখানো যায়। কোথাও বড় কোনো রেজিস্ট্যান্স নেই।



পাবলিক প্লেসে প্রকাশ্যেই সরকারী-অসরকারী কর্মীদের গল্প হয়, এই যাবি ওইখানে!  আরে ঐখানে! বয়স্ক কিছু লোক বলে ওঠে, আমাদের মাজায় দম নেই ভায়া! আমরা পাহাড়া দেব তোমাদের! তারপর চোরাচোখে মেয়েদের দিকে তাকায়! ভাষাটা এমন আরে এত্ত কিসের অহংকার আপনাদের! মহিলাদের আমরা চাইলেই কিনতে পারি! জাষ্ট কিছু পয়সায়! হিরোর মত আমরা সেখানে যেতে পারি! কে রোখে আমাদের! সত্যি এদের ঠাটিয়ে চড় মারে না কেউ! ঘৃণা করে না কেউ। এরা খুব একটা আইসোলেটেড  নয় বরং পপুলার। একজন ভয়ানক সংসারী ও ভদ্র লোকও দারুণভাবে উপভোগ করে সেই গল্প। ট্রেন বা বাস থেকে নামার আগে বলে, আজ ভায়া ক্লান্তি দূর হয়ে গেল!    
অনেক পুরুষ কিশোরকালে মনে করে মেয়েদের বিরক্ত করা তাদের জন্মগত অধিকার অনেকে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বলে, মেয়েরা তো ঢাকতেই ব্যস্ত! দুটি স্তনের উত্তরাধিকার মেয়েদের গর্বের চেয়ে হয়রানী হয় বেশী। আমি তাই পোশাকের বাইরে যে কোনো অতিরিক্ত ঢাকনা বা চাদরের বিরোধী। দৃষ্টি সংযত হোক অসৎ ও অস্বচ্ছ মনের মানুষদের। নারীদেহ নিয়ে বাড়তি রাখঢাক বন্ধ খুব জরুরী। পুরুষের এক আশ্চর্য বিশ্বাস, মেয়েদের মানুষ হিসেবে না দেখে মেয়ে হিসেবে দেখাটা তাদের ধর্মের মত। একটি মেয়ে কিছুতেই তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে মানুষ হয়ে ওঠে না। নারী শরীর তার একটা এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালু বহন করে চলে। বিনোদন এত আদিম হয় ভাবলে শিউরে উঠি!  


না, বয়স্ক মানুষ। এই মেনে নেওয়ার শিক্ষা মেয়েদের মিক সোশ্যাল এনিম্যালে ধীরে  ধীরে বিবর্তিত করে। বাসে খোঁচা খেয়ে সাবালিকা ও নাবালিকা সহ ম্যাচিউর মহিলা চুপ করে থাকেন। এই সহনশীলতার অনুশীলনে কোথাও না কোথাও মেয়েদের প্রাণ  যাচ্ছে তারা হয়রান হচ্ছে এ কথা মহিলারা সচেতনভাবে ভাবেন না। তাদের সেই প্রাচীন উক্তি, ভালো মেয়েরা কি থানায় যায়? সেখানকার লোকজনও সুবিধের নয়! সেজন্যই যে সমাজের অচলায়তন পাথরে ধাক্কা দেওয়া জরুরী এমনটা মেয়েরা বিশ্বাসের জায়গায় আনতে চান না! ভালো তাবিজের ফাঁসে বাধা পড়ে বাঁচতে গিয়ে মেয়েরা কত সহযোদ্ধা ও সহমর্মীদের হারিয়েছে তার হিসেব অনেক জটিল। অন্যায়ের বিচার ৫/৭ বছর পরে পেলেও চলে। সেখানেও প্রাপ্তির উল্লাস। কোনো বিদ্বেষ নেই। না পাওয়ার অভ্যাস এত শক্ত যেখানে অধিকার বুঝে নেবার বদলে দীর্ঘকাল পরে পাওয়াটাও পরম প্রাপ্তি।


হেনস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া কখনো শুভ হয়নি, হবার কথাও নয়। ব্যক্তি আমি ভালো মেয়ে হতে পারার ছলে সর্বনাশ করে চলেছি পরবর্তী প্রজন্মের। মেয়েদের রক্ষাকবচ তৈরী নিয়ে কোনো মঞ্চ বাঁধা হয়নি আজও মহিলাদের একটা ষ্ট্রং প্ল‍্যাটফর্ম  গড়ে ওঠেনি স্বাধীনতার এত বছর পরেও মেয়েদের সমস্যা যখন অনেক ক্ষেত্রেই শুধু  মেয়েদের ও তার পরিবারকে বুঝে নেওয়ার উপর ছেড়ে দেওয়া হয় তখন প্রতিবাদের ধরনটাও তাদের উপরেই ছাড়া উচিৎ। নামমাত্র কমিশনেরর ঢালে আটকে থেকে গেছে বঞ্চনার স্বাক্ষর মাটিতে মিশে থাকা রাশি রাশি ধূলিকণার মত অবহেলা আজ ইতিহাস।    

লজ্জার সাথে আজও বলতে হয় বায়োলজিক্যালি মেয়েদের নিগৃহীত হতে দেখে পাল্টা কোনো বিকল্প রাস্তা দেখাতে পারেনি এই সমাজ, দেশ তথা রাষ্ট্র। আইনের গণ্ডী টপকাতে অনিচ্ছুক মুখচোরা মেয়েদের সামনে অন্য কোনো বিকল্প খোলা নেই। বরং এখন পুরুষও অত্যাচারিত, এই প্যারাল্যাল একটি লাইন ক্রমশ কলেবর বাড়াচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে কি করে মেয়েদের ৭ বছর থেকে জীবনের শেষদিন  পর্যন্ত হেনস্থার ডাইমেন্সনের সাথে পা মেলায় এই তত্ত্ব। বলতে ইচ্ছা করে প্রতি সেকেন্ডে কজন পুরুষ হ্যারাসড হন মহিলাদের হাতে, কজন মৃত্যুবরণ করেন? এমন  কি কটা অভিযোগ জমা পড়ে তাদের বিরুদ্ধে সেটাও অজানা নয়। তবু বৈষম্যের খাতায় পুরুষ নথিভুক্ত করতে সমাজ মরীয়া।                

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন