উত্তরকথা
(১৩)
বাপের বাড়ি থেকে ফেরবার পথে ঢোল দেওয়ানীর জোতের পাশে যে
বিশাল প্রান্তর, যে পাথারবাড়ি সেখানে পল্টু গাড়িয়াল নামিয়ে দিল তার গরুর গাড়ি। গাড়ির
ঝাঁকুনিতে সোমেশ্বরীর তন্দ্রা চটকে গেলে সে দেখতে পেল আকাশ জুড়ে থর থর সাজানো
‘হাড়িয়া ম্যাঘ’। বৈশাখের শেষ এখন। এই তো কালবৈশা্খীর সময়। ভাবতে ভাবতেই বিশাল বেগে
ঝড় এসে গেলো। সুপারিতালগাছের সে কি প্রলয়নাচন শুরু। এদিকে পল্টু গান ধরেছে-
‘তোক না দেখিলে / মনটায় মোর উড়াং বাইরাং করে’
সোমেশ্বরীর চোখের সামনে কত কত পুরাতন দিনকালের দৃশ্য ভেসে
ওঠে। গাভুর বেলার দিনগুলি, রঙ্গরসের দিনগুলি। কইকান্ত রাধাকান্ত, দোলাবাড়ির মাগুর
মাছ, দলবেঁধে করতোয়ায় মাছ ধরতে যাওয়া। শীতের রাতের জাড়ে কইকান্তর বুকে মুখ ঘসতে
ঘসতে সে তো শুনতেই থাকতো দূরান্তর থেকে ভেসে আসা কাজল ভোমোরার গান-
‘ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমোরা রে
কুনদিন আসিবেন বন্ধু কয়া যান কয়া যান রে’
তামারহাটের বন্দরে সে একবার হাতির পিঠে শিকারে যেতে দেখেছিল
লালজি রাজাকে। একবার হাতিমাহুতের গানও শুনেছিল সে গোলোকগঞ্জের চড়ক মেলাতে। কি সব
বুক কাঁপিয়ে দেওয়া গান! মায়ামরম জাগানিয়া সেই গানের সুর, ঢোল দোতোরার বাইজন-
‘মোক ছাড়িয়া কেমনে যাইবেন হস্তীর শিকারে’
জীবনের দিন পেরোতে পেরোতে আজ কোথায় সোমেশ্বরী। ফুরিয়ে যাওয়া
ভবনদীর ধারে বসে সে কি বাকি আয়ুষ্কাল জুড়ে শেষুয়া বেটার কান্দনের মতন নিজেকে
সমর্পণ করবে! আর নাচে নাচে গানে গানে রচনা করতে থাকবে জীবনের পর্ব ও পর্বান্তর!
(১৪)
ধনীবাড়ির শূন্য খোলানে হাহাকারের মতোন বাতাস ছুটে যায়। আগিলা
ধনীরা আজ আর কেউ নেই। ফোকলা দাঁতের দুই বুড়ি যত্নেশ্বরী আর রত্নেশ্বরী সারাদিন পান
খায় আর লাঠি ঠুকে ঠুকে এই মস্ত বাড়ি আর জোত পাহারা দেয়। বাসুসাপের লেজের খসখস, শালিক
চড়ুই কাউয়ারা তাদের ঘিরে রাখে। চার কুড়ি সাড়ে চার কুড়ির মস্ত জীবন যেন রূপকথার
মতন, জন্মমরণের মতন। সেই লালমুখো জার্মান সাহেব, হাডসন সাহেব যার নাম; ঘোড়ার পিঠে
চেপে আসতো বড়ধনীর কাছে। সাহেবের কুতকুতে চোখ আর মজার বাংলা শুনে যত্নেশ্বরী আর
রত্নেশ্বরীর সে কি হাসি পেতো। বাঁশের আড়াল থেকে সাহেবের কীর্তীকলাপ দেখতো তারা। বড়ধনীর
হুঁকোতে একদিন তামাক টানতে গিয়ে হাডসনের সে কি হাল! হাঁচি কাশি আর লাল হয়ে ওঠা
মুখমণ্ডল বেয়ে ঘাম আর ঘাম। মনে পড়ে, বেশ মনে পড়ে রাজবাড়িতে রাজাবাবুর বোনের বিয়ের
কথা। সারা রাজধানীতে আলো আর বাজির রোশনাই। সে কি মোচ্ছব রে বাপু!এ ই বাড়ির এগিনা
থেকে এক হেমন্তের ভোরে ডোরাকাটা চিতাবাঘ এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপরেই বাড়িতে
বুড়াধনী বসিয়েছিল সোনারায়ের গানের পালা। মেঘেন গীদালের ঘরের সে কি উথালপাথাল গান-
‘হামার দ্যাশত বড় বাঘের ভয় রে সোনা রায়
ফান্দে পড়িয়া বুড়া বাঘা কান্দে রে রূপা রায়’
চারপাশে গভীর জঙ্গল তখন। জঙ্গল টঙ্গল ঝাড়টার পেরিয়ে তিন
পাথার সাত নদী পেরিয়ে ধনীদের হাটটাট ব্যাপার স্যাপার।সবাই দল বেঁধে চলতো। শীতের
রাতে মশালের আলো জ্বালিয়ে বসত যাত্রাগান, পালাগান, কুষাণের আসর। ভাঁজ করা চামড়ার
কুঞ্চনে আজো জেগে আছে বুঝি শীতের বিকেলে কুষান নাচের সেই সব সেয়ানা ছুকরিদের কোমর
ঝাঁকানো নাচগানগুলি-
‘ঘুর ঘুর ঘুর ঘুর ঘুর ঘুর উড়ানী কইতর রে
ও কইতর উড়িয়া পড়িল চালতে’।
(১৫)
উত্তরাঞ্চলের হাওয়া ও বাতাসের ভিতর কেমন এক মায়া ময়তা! বাতাসে
ভাসে হরেকরকম সব পিঠেভাজার ঘ্রাণ। আর পিঠেভাজা বল, মাছধরা বল, শিকারবাড়ি বল, সবই
তো সমবেত ভাবেই হয়। যেমন নাচ হয়, গান বাজে। জলিল চোরা অদ্ভূত তাপ্পিমারা পোষাক পরে
শরীর ঝুঁকিয়ে নেচে ওঠে, গেয়েও ফেলে-
‘ও কি হায় রে হায়
আজি মনকোনা মোর
পিঠা খাবার চায়
ও কি মাই গে মাই
বাহ মারিবার যাং হামরা
খলুই জাঁকই নিয়া
ট্যাংরা ধরিম খলিসা ধরিম
আরো ধরিম ও রে
রুই আরো কাতেলা’
সোনার হেমন্ত আসে উত্তরে। বাতাসে উদাসীনতা। রোদের উজ্জলতায়
চারপাশ ভেসে যায়। পাকা ধানের খেতে খেতে সাদা বক, প্রজাপতি, ফড়িং। ন্যাম্ফোর আলোর
রহস্যে আন্ধনঘরের নির্জনতা থেকে মেয়েলী গলায় করুণ সুরের এক গানের কলি ভেসে আসে, ছড়িয়ে
পড়তে থাকে পাথার-টাথার নদী-টদীর দিকে-
‘আয়রে হাড়িয়া ম্যাঘ আয় পর্বত ধায়য়া
তোক ম্যাঘক বান্ধী থুইম ক্যাশের
আগাল দিয়া’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন