বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭

ব্রততী সান্যাল

সহধর্মিনী


(১)

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে সনাতন, চায়ের গ্লাসটা পায়ের কাছে ঠিক তেমনিই রাখা। প্রায় সারাটা দিনই এমনি করেই হাঁ করে বসে থাকে সে, কাজকর্মের পাট তো কবেই চুকে গেছে। বোনের ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত মৃতদেহের দৃশ্যটা আজও প্রায়ই স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে, কিন্তু চোখটা ভেজে কই?

দাদা, একটা গোলাপি সালোয়ার দেখে এসেছি মোড়ের মাথার দোকানে, পরের মাসে কিনে দিবি প্লিজ?”, দুষ্টুমিমাখা হাসিটা আজও ভুলতে পারে না সনাতন। নাঃ কেনা হয় নি আর, তার আগেই তো... প্রথম দিকটায় প্রাণপণে লড়েছিল সনাতন, কিন্তু শয়তানগুলো তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি তো জামিন পেয়ে গেল। সেই থেকেই তার পাষাণ হওয়ার শুরু সনাতন বোঝে সবই, শোনে সবই, কিন্তু  প্রতিক্রিয়া দেখানো বন্ধ করেছে বহুদিন, যেন কলের পুতুল!  


(২)

কেন পড়ে আছে পূর্ণিমা এই জীবন্ত লাশটার কাছে? কেন পাঁচবাড়ি রান্নার কাজ করে দুজনের পেট চালানোর দায় পড়ে ওর প্রতিদিন? কেন সযত্নে আগলে রাখে ও সনাতনকে? কোন দায়িত্ব পালন না করা, কোন কথা পর্যন্ত না উচ্চারণ করা, ঘরের এক কোণে ভাবলেশহীন হয়ে বসে থাকা অর্ধপাগল মানুষটাকে কি আর স্বামী বলা যায়?
তবু পূর্ণিমা থেকে যায়, যেন অসহায়, অনাথ এক অবোধ শিশুকে প্রতিপালন করা তারই এক মস্ত দায়িত্ব। একদা কালো রঙের জন্য খোঁটা দেওয়া মানুষটাকে আজও সে একা ছেড়ে যেতে পারলো না সত্যিই মেয়েদের মন বড় অদ্ভুত!

পূর্ণিমা খবরের কাগজটা মেলে ধরে সনাতনের সামনে জোর গলায় পড়ে শোনায়,  কুখ্যাত দুই মস্তান ভোলা ও কালুকে রাতের অন্ধকারে দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে এক অজানা আততায়ী!সনাতনের সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে যায়। চায়ের গ্লাস তেমনিই পড়ে থাকে, ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে যেন আজ অন্যরকম একটা চমক ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে এই অনুভূতিটাকেই বুঝি আনন্দ বলে? প্রায় ভুলতেই বসেছে সে...


(৩)

সূর্য প্রায় মধ্যগগণে, পূর্ণিমা রান্নার কাজে গেছে, ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। সনাতন আজ আর একভাবে জীর্ণ ঘরের কোণায় বসে নেই, যেন অদ্ভুত এক অস্থিরতা তাকে গ্রাস করেছে, কি যেন একটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। পূর্ণিমার ঘরে ঢোকে সে, প্রায় এক যুগ পরে বোধহয়।
খাটের তলায় মস্ত পুটুলির মধ্যে কি যেন একটা বাঁধা আস্তে করে পুটুলিটা খুলেই  ফেলে সে। একখানা রাম-দা, ডগায় বেশ খানিকটা রক্ত লেগে আছে! স্তম্ভিত হয়ে যায় সে! হঠাৎ মনে পড়ে, দুদিন আগে মাঝরাতে যখন সে দাওয়ায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল, একবার মাঝে ঘুমটা ভেঙেছিল, আবছা অন্ধকারে পূর্ণিমাকে সে হাতে বিরাট কিছু নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখেছিল, পরের দিন স্বপ্ন ভেবে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল! এটাই বুঝি এতক্ষণ ধরে কিছুতেই মনে পড়তে চাইছিল না!


সকালে খবরের কাগজটা পড়ার সময় পূর্ণিমার ঠোঁটে খেলে যাওয়া সেই অর্থপূর্ণ হাসিটা তার চোখের সামনে হঠাৎ যেন ভেসে ওঠে কে জানে কতদিন পর তার  দুচোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়তে থাকে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে সে।  ফুলশয্যার রাতের স্মৃতিটা ভেসে ওঠে হঠাৎ, চরম বিরক্তি নিয়ে সে বলেছিল, “আয়নায় কখনো দেখেছিস নিজেকে, আদৌ আমার যোগ্য হয়ে উঠতে পারবি কোনদিন?”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন