শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

অলোকপর্ণা

ধারাবাহিক উপন্যাস


তাহার নামটি




(সাত)  

কচকচ আওয়াজ আসছে খাঁচার ভিতর থেকে, পিমকে আজ গাজর দেওয়া হয়েছে। একটু দূরে খাঁচার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে রঞ্জনা।
তোর কি মনে হয়, পিমের চোখগুলো একটু বেশিই লাল?”
রঞ্জনার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকায় ঋতম, “পিমের চোখ?... কই না তো...
ভালো করে দেখ...
ঋতম খাঁচার কাছে গিয়ে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে দেখে পিমকে, “উঁহু, অন্য খরগোশদের মতই তো
তুই স্যিওর?”
হ্যাঁ!... কেন?”
না এমনিই”, নিজের তর্জনীর দিকে তাকিয়ে রঞ্জনা চুপ হয়ে যায়।
ঋতম বিছানার কাছে ফিরে এসে বসে পড়ে। তারপর পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজগুলো বের করে বিছানার এক প্রান্তে রাখে।
পড়েছিস?” নিস্পৃহভাবে জানতে চায় রঞ্জনা।
হুম
কিছু বুঝেছিস?” রঞ্জনা জানতে চায়।
বোঝার মত তেমন কিছু তো নেই...
আচ্ছা
তুই তোর জ্যেঠুকে জানিয়েছিস?”
কি?”
কি মানে... এই চিঠিগুলো...ঋতমের মুখে কিছু প্রশ্ন ভেসে ওঠে।
নাহ্‌রঞ্জনা আবার পিমকে দেখতে শুরু করে।
না মানে? তোর জানানো উচিৎ!রঞ্জনার নিস্পৃহতায় ঋতম খানিক উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
কি জানাবো?” শান্ত স্বরে রঞ্জনা জানতে চায়।
সাব্বিরের কথা অবভিয়াসলি!
রঞ্জনা আবার চুপ করে পিমকে দেখতে থাকে, ঋতম খানিক অপেক্ষা করে, কিন্তু রঞ্জনা কোনো জবাব দেয় না।
রঞ্জনা...
কি?”
আমরা বড় হয়ে গেছি, ছোটবেলার মত আর নেই
হ্যাঁ, তো?”
তোর সব কথা তোর মা বা জ্যেঠুকে বলে দেওয়া উচিৎ। ওনারা অন্যরকম কিছু ভেবে রেখেছেন তোর জন্য,”
কি হবে বললে? কি লাভ?”
ঋতম বেশ অবাক হয়, “লাভ মানে?... সাব্বির কি... ইন্টারেস্টেড নয়?”
রঞ্জনা ঋতমের দিকে ফেরে, “ঋতম, সাব্বির কে?”

ছাদের পাঁচিলে হেলান দিয়ে বসে অঞ্জন। কখন যেন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, খেয়াল নেই। মশার মধ্যেই বসে আছে সে, তার চোখের সামনে একটা তিল। তলপেটে। গরিমার। তলপেট শব্দটা মনে আসতেই অঞ্জন আসতে থাকে, গরিমার তলপেট, গরিমার সাদা কাগজের মত তলপেট, তলপেট ভরা গল্প! যা ইচ্ছে লিখে ফেলা যায় যেন সেখানে, যা ইচ্ছে। তাই! উফ! অঞ্জন আবার আসতে শুরু করে। এবং প্রবল ভাবে আসে।
শীতের ছাদে বসে ঘেমে ওঠে অঞ্জন, চোখ বুজে চুপ করে বসে থাকে খানিক। আর সেই মুহূর্তে তার মনে হয়, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য একমাত্র গরিমাকে তার প্রয়োজন। অক্সিজেনের থেকেও বেশি প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহূর্তে, এই সন্ধেবেলায় কোনো উপায় নেই তার কাছে যাওয়ার, কি করছে মেয়েটা এখন? পড়তে বসেছে? না অঞ্জনের কথা ভাবছে? কি করছে গরিমা! গরিমাকে প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন! অঞ্জনের দম বন্ধ হয়ে আসে। নিজেকে নেশাগ্রস্থ বলে মনে হতে থাকে। তাকে তাড়িয়ে বেরাচ্ছে একটা তিল, তলপেটের কোনো এক নামহীন অংশে লুকিয়ে থাকা একরত্তি একটা নামহীন তিল। আচ্ছা, তিলটার নাম কি?
দূরে অনেক দূরে একটা নির্মানের কাজ চলছে, ছাদ থেকে তার বিরাট যন্ত্রাংশগুলো নজরে আসে। অঞ্জন সেই দিকে তাকায়, একটা বিরাট ক্যান্টিলিভার নেমে যাচ্ছে কিছু ভারী অংশ নিয়ে, কিছু পরে আবার হাল্কা হয়ে উঠে আসছে। অন্যমনস্ক চোখে অঞ্জন সেই ওঠা নামা দেখতে থাকে, একসময় সেই ওঠানামায় অঞ্জন মশগুল হয়ে যায়। লাল আলো লাগানো ক্যান্টিলিভার দূরে, অনেক দূরে, কখনও ওপরে ওঠে, কখনও নীচে নেমে যায়।

ছোটোবেলায় বাবাকে গল্প বলতে বললে বাবা সাব্বিরের গল্প শোনাতো”, রঞ্জনা বলে ওঠে।
সাব্বির?”
বাবা বলত, বাবার ক্লাসমেট।
ও আচ্ছা”, ঋতম চুপ হয়ে যায়।
বাবার ক্লাসে কিন্তু কোনো মুসলিম পড়ত না
তবে?”
সেটাই তো
কি?”
মানে সাব্বির বলে কেউ নেই
মানে... বুঝলাম না... তুই যে চিঠি লিখিস ওকে?”
লিখি তো, পোস্ট করিনা, কোথায় পোস্ট করবো? সাব্বির বলে কেউ নেই
ঋতম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “কবে থেকে লিখছিস তুই সাব্বিরকে?”
বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই...
তাও কত বছর হবে?”
ন বছর প্রায়...
হুম
দুজনে চুপ করে থাকে, তারপর ঋতম বলে ওঠে, “তাহলে এতদিনে সাব্বির তোর অভ্যাস বনে গেছে
বলতে পারিস...
তুই কি এই কারণেই, মানে... সাব্বিরের জন্যই কি তুই আমায় রিজেক্ট করলি?”
রঞ্জনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “জানিনা।
আমার কিন্তু কোনো অসুবিধা নেই...
পিমের খাঁচায় চোখ রেখে ঋতমের কথার মধ্যেই রঞ্জনা বলে ওঠে, “আমার আছে।




ঋতম চলে গেলে কাবেরী ঘরে ঢোকেন, “কিচু বললো না কি রে?”
কি বলবে?”
ওর মা তো একোনো ফোন করলেন না...
আমি জিজ্ঞেস করিনি
ওহ, আবার কবে আসবে?”
জানিনা
আচ্চা। দাদা তোকে একবার দেকা করতে বলেচেন
মা, তুমি পিমকে আর আমার ঘরে রাখবে না
কেন? কি করেচে ও?”
রাখবে না ব্যাস
কি যে হয় তোর, দুদিন আগে খরগোশ খরগোশ করে মাথা খারাপ করলি, একন আবার তাকেই ঘরে রাকতে চাইচিস না! চলরে পিম...”, বিলাপ করতে করতে কাবেরী পিমের খাঁচা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যান।

রঞ্জনা খাটের এক কোণে রাখা চিঠিগুলো দেখে কিছুক্ষণ। তারপর দ্রুত সেগুলো মুঠোয় ভরে ঠাকুরের আসন থেকে দেশালাই নিয়ে ছাদে চলে আসে। ছাদের এক প্রান্তে কাগজগুলো জড়ো করে তাতে আগুন জ্বালায়। আগুন জ্বলে উঠলে দূরের দিকে তাকায় রঞ্জনা। বহুদূরে কোনো নির্মিয়মান বাড়ির কাঠামোর সামনে সমানে ওঠানামা করছে লাল আলো লাগানো ক্যান্টি লিভার। রঞ্জনার চোখ তাতে আটকে যায়।

ছাদের পাঁচিলে হেলান দিয়ে বসা অঞ্জন আলোর আভাসে পাঁচিলের উপর দিয়ে মাথা বাড়িয়ে দেখে রাজীবের দিদি, আগুনের সামনে দাঁড়ানো। আগুনের হল্কা এসে তার চোখ মুখ জ্বলজ্বল করছে। অঞ্জনের চোখে রঞ্জনা ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। বদলাতে বদলাতে একসময় আগুনের সামনে কোনো মানুষ নয়, অঞ্জনের চোখে চকচকে লালচে সাপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রঞ্জনা, দুলতে থাকে। সাপের গায়ে আগুন লেগে যায়, অঞ্জনের চোখে অন্ধকারেও সে আগুন জ্বলে ওঠে।

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন