লড়াকু ফ্রিদা কাহলো
সৃজনশীল জগতের এক বিস্ময় ফ্রিদা কাহলো। জন্মেছিলেন বিংশ শতাব্দীর
সূচনালগ্নে (৬ জুলাই ১৯০৭) এক বৃষ্টিস্নাত দিনে। সেই সময়টা ছিল নারীর জন্য
উপেক্ষা ও স্বীকৃতির দোলাচলের এক
সন্ধিক্ষণ। তাঁর ঘটনা সংক্ষুব্ধ বর্ণীল জীবন, আত্মসম্মোহনের ব্যাখ্যাতীত
শিল্পকর্ম ও রহস্যময়তার আবরণ যা শিল্পামোদী মহলে ভীষণভাবে আকর্ষিত ও আলোচিত হয়ে আসছে ।
কিংবদন্তী প্রতিবাদী সংগ্রামী ও অকুতোভয় নারী চিত্রশিল্পী
ফ্রিদা কাহলো! জীবনভর যাকে নানা অঘটন আর আকস্মিকতায় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার বেদনায়
নীল হয়ে কাটাতে হয়েছে। তার
স্যুররিয়ালিস্ট ছবিগুলো পরাবাস্তববাদী রূপান্তরের সঙ্গে ক্লাসিক
মেক্সিকান ধর্মীয় ঐতিহ্যের উপাদান সংযুক্ত করেছে যা বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলার জগতের
মানুষের মনকে ভীষণভাবে বিস্মিত ও চিন্তিত করেছে।
মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলের এক শহরতলি কইওয়াকানের ব্লু নামক
বাড়িটিতে জন্মেছিলেন ম্যাগদালেনা
কারমেন ফ্রিদা কাহলো কালদেরন। দুঃখ ও দূর্ঘটনা যেন
ফ্রিদার নিয়তি। ১৯২৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এক ভয়ঙ্কর এক বাস দুর্ঘটনা তার জীবনকে
ওলটপালট করে দেয়। দিনের পর দিন বিছানায়
শুয়ে ছটফট করতে করতেই তিনি হাতে
তুলে নেন রং তুলি ও ক্যানভাস।
নিজের কাজ সম্পর্কে দিয়েগো রিভেরার মতামত জানার ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন ফ্রিদা। তিনি
নিজের আঁকা চারটি ছবি নিয়ে মিনিস্ট্রি বিল্ডিংয়ে যান তিনি যেখানে
ম্যুরাল আঁকার কাজ করছিলেন দিয়েগো । যে ছবিগুলো তিনি দেখাতে নিয়ে
গিয়েছিলেন তার মধ্যে তাঁর আঁকা প্রথম আত্মপ্রতিকৃতি ‘সেল্ফ
পোর্ট্রেট ইন আ ভেলভেট ড্রেস’ ছবিটি ছিল। ফ্রিদার আঁকা ছবি দেখে
রিভেরা বললেন,
‘তোমার প্রতিভা আছে...’। তাঁকে তিনি ছবি আঁকা
চালিয়ে যেতে বললেন।
ফ্রিদা এবং দিয়েগো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯২৯ সালের ২১
আগস্ট। প্রকৃতপক্ষে দিয়েগোর একাধিক নারীর প্রতি আকর্ষণ, পরবর্তী
সময়ে ফ্রিদার বারবার পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়া, তাদের
স্বল্পকালীন বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ এবং সর্বোপরি দিয়েগোর প্রতি প্রবল দৈহিক ও
আত্মিক প্রেমের গভীর অনুভূতি তাদের দাম্পত্যজীবনে এক অনন্য ব্যঞ্জনা তৈরি করেছিলো।
পরে জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফ্রিদা মন্তব্য করেছিলেন, “আমার
জীবনে দুটো মারাত্মক দুর্ঘটনা, একটি বাসের দুর্ঘটনা, অপরটি দিয়েগো।”
১৯৩১ সালের জুন মাসে দিয়েগো দম্পতি মেক্সিকোতে ফিরে আসে।
কিন্তু একবছর পর ১৯৩২ আবারও ডেট্রয়েটে ইন্সটিটিউট অফ আর্টসের আভ্যন্তরীণ কোর্ট
ইয়ার্ডে ফ্রেসকো করার আমন্ত্রণ পানইউলিয়াম ভেলেন্তিনার কাছ থেকে। এসময় ফ্রিদা
অন্তসত্তা হয়ে পড়েন। যদিও ১৯৩২ সালের ৪ জুলাই তার গর্ভপাত হয়ে যায়। এতে ফ্রিদা
অত্যন্ত মুষড়ে পড়েন। এসময় তিনি ‘হেনরিফোরড হাসপাতাল’, ‘ফ্রিদা এন্ড এবরশন’ ইত্যাদি বিখ্যাত ছবিগুলো আঁকেন।
১৯৩৩ সালের মার্চ মাসের ১৩ তারিখে দিয়েগো আনুষ্ঠানিকভাবে
ডেট্রয়েটের ম্যুরালের কাজ শেষ করেন এবং ডিসেম্বরের ২০ তারিখে মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে
নিউইয়র্ক ত্যাগ করেন। ১৯৩৪ সাল থেকে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে
থাকে আর একসময় তা সহ্যের বাইরে চলে গেলে ফ্রিদা ১৯৩৫ সালের প্রথমদিকে সান এঞ্জেলের
বাড়িটি ত্যাগ করে মেক্সিকো শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি আধুনিক ফ্ল্যাটে উঠে যান। এসময়
তিনি মানসিকভাবে ভীষণ একা হয়ে পড়েন এবং নানা সম্পর্কে জড়াতে থাকেন। এমনকি তিনি
সমকামী সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। ফ্রিদার প্রেমের
সম্পর্কগুলোর মধ্যে ট্রটস্কির মতো বিখ্যাত ব্যাক্তির সঙ্গে প্রেমটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তাঁর আরেকজন বিখ্যাত
প্রেমিক ছিলেন ভাস্কর ইশামু নগুশি। নগুশি মেক্সিকো এসেছিলেন ম্যুরালের কাজ করতে
১৯৩৬ সালে এবং এসময় তিনি ফ্রিদা ও তাঁর কাজের প্রেমে পড়ে যান।
১৯৩৮ সালের ১ নভেম্বর ফ্রিদার একক প্রদর্শনীর উদ্বোধনলগ্নে
নিউইয়র্কের জুলিয়েন লেভি গ্যালারী ছিল দর্শক সমাগমে পরিপূর্ণ। এককথায় এই প্রদর্শনী
ছিল অত্যন্ত সফল। এই সময়েই তিনি আলোকচিত্রী নিকোলাস মারের সাথে প্রণয়ঘটিত সম্পর্কে
আবারও জড়িয়ে পড়েন।
১৯৩৯ সালের জানুয়ারিতে ফ্রিদা একটি প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার
জন্য প্যারি আসেন। নানা প্রতিকুলতা ও বাঁধা কাটিয়ে শেষে মার্চের ১০ তারিখে প্যারির
পিয়্যের কোল গ্যালারিতে প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। ল্যুভর জাদুঘরের জন্য সেখান থেকে
তাঁর ‘দি ফ্রেম’ ছবিটি কেনা হয়।
হতাশার চরমলগ্নে ফ্রিদা একসময় নিজের চুল কেটে প্রতিবাদ
জানান এবং ১৯৪০ সালে তার ভীষণ বিখ্যাত ছবি
‘সেলফ
পোরট্রেড উইথ ক্রপড হেয়ার’ আঁকেন। দিয়েগো রিভেরা থেকে
বিচ্ছিন্ন ফ্রিদা, ছবিতে তার প্রিয় মেক্সিকান গাউন নেই,
দৃষ্টিতে কোন জীবনের ছোঁয়া নেই, তাঁর প্রিয়
কেশগুচ্ছ পুরুষের মতো করে কাটা আর পুরুষের পোশাকে ফাঁকা চেয়ারে একা
বসে থাকা বিষণ্ণ ফ্রিদা,
নিজের নারীত্ব সমূলে উৎপাটিত। পরস্পরের কাছ থেকে বেশিদিন
দূরে থাকতে পারেননি তারা;
১৯৪০ সালের ৮ ডিসেম্বর, দিয়েগোর ৫৩তম
জন্মদিনে দ্বিতীয়বারের মত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
একাধারে কয়েক বছর ইউরোপ এবং আমেরিকায় তার একাধিক প্রদর্শনী
শেষে ১৯৪৩ সালে এডুকেশন মিনিস্ট্রিস্ স্কুল অব ফাইন আর্টসে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন
ফ্রিদা।
১৯৫১ সালে ফ্রিদার স্বাস্থ্য এতই খারাপ হলো যে কিছুদিন তার ছবি আঁকা
সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। জীবনের শেষ বছরগুলোতে প্রধানত স্টিল লাইফ আঁকেন ফ্রিদা। এসময়
তার ছবিগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৫৪ সালে আঁকা তার সর্বশেষ
আত্মপ্রতিকৃতিগুলোর একটি ‘মার্ক্সইজম উইল গিভ হেলথ টু দ্য
সিক’ পিসিএম-এর পক্ষে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক বক্তব্য। কমিউনিস্ট থিমের
উপর পরে আঁকা একটি ছবি ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট উইথ স্টালিন।’১৯৫৪-এর জুলাইয়ে যখন ফ্রিদা মারা যান তার
স্টুডিওতে ইজেলের উপর স্টালিনের একটি অসমাপ্ত প্রতিকৃতি পাওয়া যায়।
ফ্রিদার আঁকা ১৪৩টি পেইন্টিংয়ের মধ্যে ৫০টিই তাঁর নিজের প্রতিকৃতি, যার বেশিরভাগ ছবিতে প্রকাশিত হয়েছে তার শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতের দিকগুলি।
১৯৫৩-এর বসন্তে জীবিতাবস্থায় ফ্রিদার একমাত্র এবং বহু প্রত্যাশিত চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় মেক্সিকোতে। ফ্রিদার শরীর ভয়ংকারভাবে ভেঙে গেছে সেই সময়। ডাক্তারের মানা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই প্রদর্শনীতে পৌঁছালেন ফ্রিদা। মোটর সাইকেল শোভাযাত্রাসহ একটি এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালের স্ট্রেচারে শুয়ে হাজির হন তিনি। ফটোগ্রাফার এবং সাংবাদিকরা বিস্মিত হয়ে গেলো। তাকে নিয়ে রাখা হলো গ্যালারীর মাঝখানে। দর্শকরা একে একে তার সাথে সাক্ষাৎ করলো। ফ্রিদা দর্শকদের সাথে নানা ধরনের কৌতুক করলেন আর উচ্চহাসিতে উদ্ভাসিত করলেন হলরুম। গান গাইলেন তাদের সাথে আর পান করলেন সারাটি সন্ধ্যা ধরে। ভীষণ সফল একটি প্রদর্শনী হয়েছিলো সেটি। তবে সেটিই শেষ। ১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই ফ্রিদা মারা যান। ডায়েরিতে তিনি শেষ যে কথাটি ব্যক্ত করেন তা হচ্ছে, ‘আই হোপ দ্য লিভিং ইজ জয়ফুল, এন্ড আই হোপ নেভার টু রিটার্ন।’
কোইয়াকানের সেই ব্লু হাউস এখন ফ্রিদার জাদুঘর, যেখানে তিনি
জন্মেছিলেন এবং যে বাড়িতে কেটেছে তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটা সময় আর সেখানেই তার
মৃত্যুও হয়েছিলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন