বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

ঘটমান 

মাথা নিচু, কালো শক্ত মোষের মতো ঘাড়। বিড়বিড় করছে।
-বোকাচো-!
ওই বিচ্ছিরি গালিটা?
বাঁ-কান দীপের তর্জণী মধ্যমা বুড়ো আঙুলের ফাঁদে। কষিয়ে প্যাঁচাচ্ছে। ওয়ার্মিং-আপ। রাগলে গলা খাদে নেমে যায়হিসহিস। আমি দর্শক। কথা বলতে পারছি না। দীপ্তদীপ আমার ছেলে হলেও ভয় খাই ওকে। বোধহয় কাঁপছি। পাশে অঞ্জু আর মহাদেব বোবা। অঞ্জু আমার বাজু ছুঁয়ে। কেন রে অঞ্জু? তোর ছেলেকে আমার ছেলে ঠ্যাঙাচ্ছে আর তুই আমায়--? দীপ কী বলছে?
-কেন করেছিস বল? রাস্কেল! পুলিশে দিলে তিনবছর ঘানি টানিয়ে ছাড়বে। লেখাপড়া শিখছ?
শোনা যাচ্ছে না। দীপরে, ওকে যে পড়াচ্ছিলাম তিনবছর ধরে। তোর জন্যে অবশ্য টিচার--। আমি খুব মামুলি শিক্ষক। মহাদেব আমাদের লনের দিকে চোখ ফেলে রেখেছে। ঘাসের ডগায় দানাদানা শিশির। ঘন সবুজ, খুব। মহাদেবের হাতে ম্যাজিকশীতভর গোলাপ, গাঁদা, ঋতুফুল।

-পোকা-মারা ওষুধের বাকি টাকা ফেরৎ নিয়েন বড়দি।
-তুমি রেখে নাও মহাদেব--।

-না না, কী যে কন! লাগলে মেঙে নিব।
-বড়দি, মৌরিফোঁড়ন দিয়ে কাঁচা কলাইডাল আর পোস্তবড়া বানাই? দাদাভাইয়ের জন্যে বেশি পেঁয়াজ দিয়ে কষামাংস আর রুটি-।

দীপের ডানহাতটা অনেক ওপরে উঠছে। আমি পা বাড়াচ্ছিলাম আটকাতে। অঞ্জু টেনে রাখল। চোখ বেয়ে দুঃখ পড়ছে। অঞ্জুরে, তোর ছেলেটা মরে যাবে কিন্তু! দীপের ক্যারাটে-করা, টেনিস-র‍্যাকেট-ধরা থাবা। আই-আই-এম।
আমি বলতে পারছি না। অঞ্জু বোঝে, আঁচল তুলে গাল মোছে।
-ও বড়দি, অন্যেয় করলে মার খাবেনে? এতবড় সাহস পায় কোত্তেকে? বাপমার শিখ্যে বলতে পারবেনি কেউ।
-ছীছী অঞ্জু, একথা বলে নাকি? তুই আর মহাদেব আমার ঘরের লোক। তোরা সোনা পেলেও কুড়িয়েদীপের বাবা শেষদিন পর্যন্ত বলে গেছে
আমি অঞ্জুকে দেখি, অঞ্জু আমায় দেখে। আমি মহাদেবকে দেখি, দীপকে দেখি। গলার ভেতরে আঠা-আঠা, আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
-কবে থেকে এসব শুরু করেছিস?
বোমা পড়ার মতো সপাটে হাতটা পিঠে--? না, পড়েনি। চোখ বুজে আছি। কাউকে দেখতে চাইছি না। দীপ! দীপ! দুহপ্তা পরে জয়েন করতে যাচ্ছে গুরুগ্রাম। ছমাসের  মধ্যে ইউ-এস-এ মাস দুই ট্রেনিং। -চিকেনকষাজ ইয়াম্মি মাম্‌। জানি অঞ্জু-মহাদেবকে ছাড়া তোমার চলবে না। বাট্‌ দ্যাট্‌ ল্যাড্‌জ বিকামিং আ ক্রিমিন্যাল! ডেঞ্জারাস্‌। ওকে কন্ট্রোল করতে পারবে? কী সাহস! হাও ডেয়ারিং একটা চোদ্দো বছরের ছেলে? ভাব তুমি, গাড়ির জানালা খুলে মিউজিক সিস্টেমটা নিয়ে--! জাস্ট আনইম্যাজিনেব্ল। বিক্রি করে দিলে?

গাছের ফলটল, বাগানে জল দেবার পাইপ চুরি—! ইয়েস, জাস্ট আনইম্যাজিনেব্ল! গাড়ির কাচটা পুরো বন্ধ করার কথা ভুলে গেলি কি করে বাবু? মুখ খুলি না আমি।
ছেলেটা এত সহজে ধরে ফেলে নারে ম্যাথস্‌ প্রব্লেমস্‌--, তুইও পারতিস না দীপ। বাংলা মিডিয়ামের ইংলিশ হলেই বা! পটাপট করছে পার্টস-অব-স্পিচের কঠিন অনুশীলনীগুলো। তোর কিন্তু বাংলা শিখতে সময় লেগেছিল

চেপে রাখা শ্বাস বেখেয়ালে বেরিয়ে আসে। দীপ মুখের দিকে তাকিয়েছে,
-এনিওয়ে, চিন্তা করো না। ওরা চলে গেলেও অল্টারনেটিভ পেয়ে যাবে। সার্ভেন্টস্‌ রুমের জন্যে কতজন ওয়েট করে, দেখ না? দেখে নিও শুধু ওইবয়সী ছেলে না থাকে।
-হ্যাঁরে দীপ, দেখেই নেব। আমি, অফিস, বাড়ি। নিশ্চিন্ত থাক, আর প্রশ্রয় দেওয়া নেই।

 বড়দি
মহাদেবের হাতে আমার দেওয়া সুটকেশ। মাটিতে তাকিয়ে আছে। পাশে উদ্ধত ঘাড়, তেলতেলে মুখ, চোখ ফেরানো। পুজোয় দেওয়া নতুন টীশার্টটা পরেছে। গলা ঝাড়ি,
-কীরে শঙ্কর? মহাদেব, কী ব্যাপার?
বোকার মতো কথা আমার, যেন বুঝিনি কিছু। রাত্তিরে দীপ পরিষ্কার জানিয়েছে। অঞ্জু শাড়িতে গাহাত মুড়ে দাঁড়িয়ে।
-গেরামে রেখে আসতে যাচ্ছি বড়দি। অঞ্জু থাকল। আমার ফিরতে দুদিন দেরী হবে। চিন্তা করেন না যেন। ইশকুলে ভর্তি করে দেআসব। জ্যাঠাকাকা আছে, শাসন আছে। শুদ্দু ল্যাখাপড়া শিকে লাভ নাই

আমাকে ঠুকল? আমার কানদুটো বেজায় লাল। মহাদেবকে ভুল বুঝছি? কত সরল লোকটা।
সামনের বারান্দায় শঙ্করের ফেলে-যাওয়া খাতাটা ঘাঁটছিলাম। হাতের লেখা সুন্দর হয়ে গেছিল। ওখানের ইশকুল! সে কেমন? পেছনের পাতায় গোটা গোটা করে ট্রান্সলেশন করেছিল, আই ওয়ান্ট টু বী এন্‌ আই-পি-এস অফিসার।
-চিন্তা করো না মাম্‌। রিজার্ভেশন কোটা থাকে ওদের। পাশ করলেই চাকরি পাবে, হোয়াটএভার দ্য রেজাল্ট উড্‌বী।
দীপের কী সামান্য সঙ্কোচ হয়েছিল? অনুতাপ? কর্মস্থলে চলে গেছে হপ্তাখানেক।
কোটা! হ্যাঁ, ঠিকই তোদাবীদাওয়া, ভামুলা, হার্দিক। খবরের কাগজে টিভিতে দেখি প্রায়শঃ। নিরুত্তাপ হাই ওঠা একঘেয়ে। গেটের ফাঁকে মুখ বাড়িয়েছে বছর দশেকের ন্যাড়াদুটো। শালিখপাখি যেন। হাতেপায়ে মাটি।
-ও দিদা, ঘাস তোলাবে?
-কোথায় থাকিস রে? ইশকুল-টিশকুল যাস না?
-ভেজা কাপড়ের বালতি নিয়ে অঞ্জু বারান্দায়। আমি কথা না বললেও কী করে বোঝে?
-ও বড়দি, এদুটোকে ডাকেন না যেন। ভারী বদমাশচোর!

আর কারুক্কে ডাকব না অঞ্জু, প্রমিস

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন