মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

অলোকপর্ণা

ধারাবাহিক উপন্যাস





তাহার নামটি


(পাঁচ)

“বোসো”
সুনীল মজুমদার রাজীব ও অঞ্জনকে চেয়ার দেখিয়ে বলেন।
তারা বসে পড়ে।
“তোমার নাম কী?”
“অঞ্জন”
“পুরো নাম?”
“অঞ্জন বসু।”
কী কর?”
“আমি রাজীবের সাথেই পড়ি”
“আর দেওয়াল লেকো না?”
“দেওয়াল!” অঞ্জন অবাক হয়ে রাজীবের দিকে তাকায়।
“জ্যে, দেওয়াল মানে?” রাজীবের ভ্রূ কুঁচকে ওঠে।
“বাইরে পাঁচিলে, পরশুদিন সকালে তোমরা কিছু লিকে এসেচো, মনে নেই?” সুনীল মজুমদার গভীর দৃষ্টিতে অঞ্জন আর রাজীবকে দেখেন।
“আমরা মানে, আমি আর ও বলছো?”
“হ্যাঁ, টোটো, আর তো কাউকে ঘরে দেকচি না”
অঞ্জন কিছু একটা বলতে গেলে রাজীব তাকে থামিয়ে দেয়, “ও কিছু করেনি, জ্যে, আমিই লিখেছি”
“কেন লিকেচো?”
রাজীব চুপ করে থাকে, অঞ্জনও কিছু বলে না, তার চোখে ঘুরে ফিরে লাল আলোর সাপটা ভেসে আসতে থাকে।
সুনীল মজুমদার বলেন, “তোমাদের বয়সে, পুরকি, - বোজ? তোমাদেরই তো ভাষা... বড়ই পুরকি থাকে। যাইহোক, আমি রঙ কিনে দিচ্চি, এই হপ্তার মদ্যে দেওয়াল আগের মত সাদা চাই, এসো এবার।”

রাজীব অঞ্জনকে রাস্তা অবধি ছাড়তে আসে।
“তুই কেন বললি না জ্যেঠুকে?” অঞ্জন অবাক হয়।
“এমনিই”
“শুধু শুধু তোর ঘাড়ে দোষ পড়ল”
“পড়ুক, তোর কি?”, একটু বিরক্ত হয়েই রাজীব বলে ওঠে।
“আমার কিছু না, যখন রঙ করবি, ডাকিস, থাকবো”, সাপটাকে মনের গর্তে যতটা সম্ভব ঢুকিয়ে ফেলে বলে অঞ্জন।
অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে রাজীব অল্প হাসে।

ছাদের রোদে দুটো চেয়ার আর টেবিল পেতে দেওয়া হয়েছে। পাট করা শাড়ি পরে একটায় বসে রঞ্জনা। সামনের চেয়ারে ডঃ ঋতম রায়।
টেবিল থেকে চায়ের কাপ হাতে তুলে নেয় ঋতম, “তোর মনে আছে, টিফিনের ভাগ দিতে চাইতাম না বলে পিঠে কি কিল মারতিস তুই?!”
“না তো, তাই?”
“হুম, আর হাসিদিদিমণি তোকে যেদিন বাথরুমের সামনে নিলডাউন করিয়ে রাখল, ছুটির আগে এসে আমায় শাসিয়ে গিয়েছিলি যেন বাড়ির কাউকে বলে না দিই”, শব্দ করে হেসে ওঠে ঋতম।
“মনে নেই রে”
“তারপর একদিন অঙ্কখাতার পিছনে লেখা, আমার নাম জিজি, কারণ আমার নাম জিজি, আমি একটি রাজকুমারী, আমি ভালো মেয়ে, আমি একটি পরী, তাই আমার নাম জিজি”, হাসতে গিয়ে কাপ থেকে চা চলকে ওঠে ঋতমের।
“নাঃ কিছুই মনে নেই”, নিজের কাপে সশব্দে চুমুক দেয় রঞ্জনা।
এক চুমুকে চা শেষ করে ঋতম বলে, “মা চাইছে তোর সাথে আমার সম্বন্ধ করতে, মায়ের তোকে পছন্দ।”
“পছন্দ? উনি চেনেন আমায়?”
“হ্যাঁ, বেল সার্কেলে তোর কবিতা পাঠ শুনেছে, বলছিল দারুন লিখিস”
“বয়স্ক মহিলারাই কি খালি আমায় পছন্দ করেন...” আনমনে বলে রঞ্জনা।
“মানে?”
“মানে, এই তোর মা... আবার ইন্দিরা নামে এক মহিলা, মাঝে মাঝে কবিতার প্রশংসা করে চিঠিও লেখেন... আমার কবিতা কি খালি বয়স্ক মহিলাদেরই পছন্দ হয়!” প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করে রঞ্জনা।
“আমারও ভালো লাগে, নন্দন বুকস্টল থেকে ম্যাগাজিন কিনে পড়ে দেখেছি... যাই হোক, বল, তোর কী মত?” ঋতম উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে।
রঞ্জনা ধীরে ধীরে চা খেতে থাকে। তারপর বলে, “একটা কবিতা শোনাই?”
“হ্যাঁ, শোনা”
ঋতমের দিকে ফিরে রঞ্জনা রোদের মধ্যে উঠে দাঁড়ায়, শব্দ করে গলা পরিষ্কার করে করে বলে ওঠে, “নমস্কার, কবি রঞ্জনা মজুমদারের কবিতা, সোনাগাছি,

সোনাগাছি সোনাগাছি, কেন ওরা তোমায় খাওয়ায়?
সোনাগাছি সোনাগাছি, এটা তো তোমার দোষ নয়!
সোনাগাছি সোনাগাছি, কেন হলে এত আনমনা
সোনাগাছি সোনাগাছি, আমি আর ভার্জিন না।
নমস্কার”

চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে রঞ্জনা। ঋতম রায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তারপর বলে, “তুই সরাসরি বলতে পারতিস, তোর আমায় পছন্দ নয়, আমি কিছুই মনে করতাম না, পছন্দ হওয়ার তেমন কথাও তো নয়, দুম করে কুড়ি বাইশ বছর পর একজন উদয় হয়ে বিয়ে করতে চাইলে তাকে একবারে হ্যাঁ বলা যায় কি? যায় না”
রঞ্জনা কিছু বলে না, চায়ের প্লেট থেকে মেরি বিস্কুট তুলে খেতে থাকে।
“তাই বলে তুই ভার্জিন না, এটাও বলার দরকার ছিল না। তুই ভার্জিন হোস বা না হোস তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।”
নিজের প্লেটের বিস্কুট শেষ করে ঋতমের প্লেট থেকে বিস্কুট তুলে নেয় রঞ্জনা।
রঞ্জনা বিস্কুট খেতে শুরু করলে ঋতম বলে, “যাইহোক, এই মিথ্যেটা না বললেও হতো
“মিথ্যে? কোনটা?”
“এই তোর ভার্জিনিটি...”
“সত্যি আমি ভার্জিন নই।”
“আমি তোকে জোর করব না, মিথ্যে বলার দরকার নেই”
কী আশ্চর্য, আমি না হলে আমায় জোর করে ভার্জিন বানাবি!”
“জোর কোথায় করছি, মিথ্যে বলছিস তাই বললাম”
“এটা সত্যি”
“উঁহু, ডাহা মিথ্যে”
“সত্যিই রে!”
“না মিথ্যে কথা”
“বলছি সত্যি!”
“আমি বিশ্বাস করি না”
“এবার ক্যালাবো কিন্তু!” রঞ্জনা তেড়ে আসে ঋতমের দিকে।
ঋতম হাসতে হাসতে বলে, “একদম ক্লাস থ্রির মতো!”




প্রিয় সাব্বির

তিনি বললেন, “It’s safer to be feared than loved.”
আমার আলাদা করে মুখেভাতের অনুষ্ঠান হয়নি। ভাইয়ের হয়েছিল। ছোটবেলায় আমার কোনো ট্রাইসাইকেল ছিল না। ভাইয়ের ছিল। আমাকে প্রাইভেট টিউটর দেওয়া  হয়নি কোনোদিন। ভাইয়ের পাঁচজন স্যর। আমি ভাইকে হিংসা করি? না। ভাইয়ের প্রতি আমার হিংসা নেই। মায়ের প্রতি রাগ আছে। জ্যের প্রতিও। ভাইয়ের প্রতি আমার যে কী আছে এখন, তা আমি বুঝতে পারি না আর। ভাইয়ের সাথে আমি কথা কেন বলি না, এটাও একটা প্রশ্ন বটে। ঋতম জানতে চেয়েছে, উত্তর দিইনি। দেবোও না।

সাব্বির, পৃথিবীর শেষটা কোনো বিন্দুতে নয়, একটা রেখায়, একটা ব্যবধান সৃষ্টিকারী রেখায়। বিন্দু তো মিলিয়ে দেয়। রেখা আলাদা করে। আলাদা করে রাখে।
ভালো থেকো।
ইতি
রঞ্জনা

পুনশ্চঃ তিনি এও বললেন, “All you need is love, love, love is all you need.

(ক্রমশ)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন