শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

রঞ্জনা ব্যানার্জী

সাদা-কালো

টার সময় শম্পাকে ওটিতে নেয়া হয়েছিলডেটের পাঁচ দিন পার। ভোরে জল ভেঙেছে সকাল সোয়া আটটায় ব্রজ যখন ফোন দিল আমি তখন স্কুলে। ব্রজ আমার মেজ মাসির একমাত্র ছেলে। শম্পার বর।

শম্পা একসময় আমার মেয়েকে গান শেখাতো মাসি শম্পাকে দেখেছে কিন্তু ব্রজ নয় যেদিন ব্রজ শম্পাকে বিয়ে করে বাড়ি তুলল, মাসি আমাকে ফোনে ডেকে পাঠিয়েছিল,  ‘এক্ষুণি আয়’। ব্রজের বিয়ের তারিখ পাকামেয়ের মুখ দেখে মাসি নিজের আঙুলের আঙটি খুলে পরিয়ে দিয়েছিল আমরাও পাত্রীর রূপ দেখে গলে গিয়েছিলাম। দুধে আলতা রঙ। ছেলের জন্যে মাসি এমন মেয়েই খুঁজছিল। পাঁজি মিলিয়ে বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছিলহঠাৎ মেসোর সিভিয়র হার্ট এ্যাটাকহাসপাতাল থেকে আর বাড়ি ফেরেন নি, সোজা অভয়মিত্র ঘাটে। অশৌচে শুভ কাজ নাস্তি, তাই বিয়ের  তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যেই এই ঘটনা।

শম্পাকে দেখে আমি নিজেই অবাক। কিন্তু মাসির বদ্ধ ধারণা আমার সবই জানা

মাসির সাথে এরপরে দেখা তো দূরের কথা, কথাও হয়নিসকালে ব্রজের ফোনটা পেয়ে তাই অবাক হয়েছিলাম। হঠাৎ আমার খোঁজ? খানিক পরেই অবশ্য কারণটা টের পেয়েছিলামযে ক্লিনিকে শম্পাকে ভর্তি করা হয়েছে সেই ক্লিনিকের পরিচালনা পর্ষদে শারমিনের বর মেজর আজম আছেনশারমিন আমার বন্ধু। মাসি জানেনঘন্টা খানেকের মধ্যেই সিসেকশনএত কম সময়ে আমি কীভাবে কী করি? শারমিনের সাথে স্কুলে বসেই কথা সারলাম আজমভাই ব্যাংককে, কিন্তু ও সব দেখবে জানালো।

স্কুল থেকে চাইলেই তো ছুট লাগানো যায় না! নিজের ভাইবোন নিদেনপক্ষে বরের  ভাইবোন হলেও হতোপ্রিন্সিপ্যাল মহা বিরক্ত। অদ্রীশকে জানাতেই জ্বলে উঠল, ‘এত  তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?’ সব সামলে যখন ক্লিনিকে পৌঁছলাম তখন শম্পার বাচ্চা হয়ে গেছে। ব্রজ নেমে এসেছিল নিচে জানালো, মেয়ে হয়েছেসাড়ে ছ’পাউন্ড, কিন্তু লাইফ সাপোর্টে আছে।

শম্পার মাকে দেখলাম প্রথম বারের মতো ব্রজই পরিচয় করিয়ে দিল। ভদ্রমহিলা কেঁদে কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছেনব্রজ আমাকে ছেড়েই ছুটলো লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে। ব্রজের তো ধর্মে মতি দেখিনি আগে! নিজের বাবার শ্রাদ্ধের সময় পুরুতের কথা মানে নি, মাথা মুড়োয় নি; সেই ব্রজ ছুটছে মন্দিরে!

মাসি জানালো, শারমিন এসে ঘুরে গেছে। বলেছে, চিন্তা না করতে।

শম্পার এ্যানেস্থেসিয়ার ঘোর কাটেনি। কেবিন নম্বর জেনে ওকে আলগোছে দেখে আসি। কী অসহায় ঘুমিয়ে আছে! মনে মনে অসীমে মাথা ঠেকাই, বাচ্চাটা যেন বেঁচে থাকে!  
এমার্জেন্সি মানেই অস্বস্তিকর জায়গা চারপাশে কেমন যেন কিছু একটা অঘটন ঘটানোর পাঁয়তারা। আমি ওয়েটিং এরিয়ায় ফিরি। মাসি জপ করছেন চোখ বুজেশম্পার মা মাঝে মাঝে আঁচলে চোখ মুছছেনআমার নিজেকে বড়ই বেমানান লাগেআমার স্বল্পবুদ্ধিতে বুঝি কথা বললেই মনের ভার কমে। কিন্তু কীভাবে কথা শুরু করব বুঝে উঠতে পারি না। শম্পার মা’র জন্যেই বেশি মন খারাপ লাগছে। পেট কেটে বাচ্চাটা বেরুলো, ভগবান না করুন খারাপ কিছু যদি হয়ে যায়! আমি কেঁপে  উঠি। ওঁর পিঠে অজান্তেই আমার হাত উঠে আসে। উনি আমার কাঁধে শরীর ছেড়ে দিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকেন। মাসি হঠাৎ হাতের মালা ছেড়ে ভ্রূ কুচকে তাকান;  ‘কান্না বন্ধ করে ঠাকুরের নাম নিন তো!’ সাথে সাথেই শম্পার মা আলপিনের মতো সিধে হয়ে যানআমাকে অবাক করে দিয়ে হাত পা নেড়ে বলতে থাকেন, ‘আপনি তো চাননি ওদের বাচ্চা হোক! শম্পার গায়ের রঙ নিয়ে কম করেছেন? আমার  মেয়ে কি আপনার বাড়িতে হেঁটে গিয়েছিল? আপনার ছেলেই তো ফুসলিয়ে নিয়ে এসেছেইষ্ট নাম আপনি জপুন আমার ভগবান জানেন, আমি কী চাই’ মাসি থতমত খেয়ে গেলেও মুহূর্তেই সামলে নিল। চোখ দিয়ে আগুন বেরোতে লাগল যেন, ‘এই মেয়ে তো ছেলেধরা! বিয়ে ঠিক জেনেও ঝুলে গেল! অশৌচ মানলো না।  ভগবান অনীতি সইবে কেন!’ মহিলাও সমান তালে চেঁচাতে লাগলেন, ‘জানেন না কেন অশৌচ না মেনে ঝুলেছে? ফিডার খান আপনি?’ আশেপাশের লোকজন সব দেখছে ঘুরে। আমি উঠে দাঁড়াই


আমার চলে যাওয়া ওদের নজরে আসে না। করিডোরে দেখি ব্রজ। হাতের বেলপাতা দেখিয়ে বলে, ‘বাবার পা থেকে তুলে এনেছি। আমার মেয়েটা বেঁচে গেলে আমি মাছমাংস ছেড়ে দেব দিদি!’ আমি মনে মনে হিসেব কষি, মাস পাঁচেক আগে ওরা   বিয়ে করেছিলতখনই মাইক্রোফোনে ডাকে, ‘ব্রজ চ্যাটার্জী কাউন্টারে আসুন!’ ব্রজ ছুটতে থাকে সামনে। আমি উলটো দিকে যেতে যেতে জপতে থাকি, সব ঠিক থাকুক,  সব ঠিক থাকুক। 

২টি মন্তব্য: