দাগ
হরিমোহিনী
ইস্কুলের একতলায় বাইরের সরু বারান্দাটা অনেক লম্বা। এপার থেকে ওপারে যেতে প্রায়
পাঁচ মিনিট লাগে। ওরা মজা করে বলে সাইকেলে যেতে দশ মিনিট লাগবে।
আজ হলে
পিনড্রপ সাইলেন্স। ইতিহাস পরীক্ষা চলছে। এই একটা পরীক্ষার প্রথমের দিকের বেশির
ভাগটা অংশ কেউ কারও দিকে তাকানোর চেষ্টা করে না। কেউ টয়লেটে যেতে চায় না। ঘাড়
গুঁজে লিখে যায়। শুভজিৎ সেটাই করছে। আজ অবশ্য পুরো সময়টাই সে তাই করবে। তাতে যদি
নম্বর কমে যায়, কমুক।
মোটা
ফর্সা সুমনবাবু তেড়ে পায়চারি করছেন, এই হলের তিনি একমাত্র গার্ড। আধঘন্টা এ-রকম
চালানোর পর উনি ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসবেন, আর উঠবেন না, স্মার্টফোন বের করে কী-সব
খুটখুট করবেন। ছোট হল। একজনের বেশি লাগবে না।
ঘুরতে
ঘুরতে সুমনবাবু শুভজিতের পাশে এসে দাঁড়ালেন। আগের দিনের ঘটনাটার পর থেকে তাকে একটু
বেশিই নজরে রাখা হচ্ছে। সুমনবাবুকে নিশ্চয়ই বলে দেওয়া হয়েছে। আজ সে ক্রিমিনালদের
লিস্টে আছে।
লিখতে
লিখতেই শুভজিতের পেট আবার গুড়গুড়িয়ে উঠল। সকাল থেকেই এটা হচ্ছে। ভয়ের চোটে।
হেডস্যার সেদিন প্রচণ্ড রেগে বলেছিলেন তার বাবাকে ডেকে পাঠাবেন। সত্যিই আজ চিঠি
দেবেন না তো! বাবাকে যদি চায়ের দোকান ফেলে ইস্কুলে আসতে হয়, হেডস্যারের ঝাড় খেতে
হয়, বাবা আসার আগে মারবে, ফিরে যাওয়ার পরে আর আস্ত রাখবে না।
সুমনবাবুর
ঘামের গন্ধ আর শ্বাসপ্রশ্বাস টের পাচ্ছিল শুভজিৎ।
গোদের
উপরে বিষফোঁড়া। বাইরের বারান্দায় অনেকটা দূর থেকে জ্যোতির্ময়বাবুর গলা শোনা
যাচ্ছে। একেকটা হলে ঢুকে কাকে যেন খুঁজছেন তিনি। আগের দিনের পরীক্ষাটা ওঁরই
সাবজেক্টের ছিল। জ্যোতির্ময়বাবু তো তাকে স্রেফ ছিঁড়ে খেয়ে নেবেন! বাবাকে এবার
ডেকেই পাঠাবেন! আজ রাতে আর খেতে দেবে না বাড়িতে।
নামটা
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। আবছা কানে আসছে। শুভজিৎ চৌধুরী? নাকি সুপ্রীত
চৌধুরী? সুব্রত চন্দ? সুমিত চাকলাদার? একেবারে পাশের হলে যখন পৌঁছেছেন
জ্যোতির্ময়বাবু, শুভজিৎ স্পষ্ট আওয়াজটাও বুঝতে পারল না। কান ভোঁ ভোঁ করছে। পাখার
তলাতেই ঘামতে শুরু করেছে। কলম থেমে গেছে। খাতা আবছা। সুমনবাবু হেসে এগিয়ে গেলেন
দরজার দিকে।
জ্যোতির্ময়বাবু
বিরক্ত মুখে ঢুকলেন, ‘পুষ্পিত চক্রবর্তী এই হলে আছে সুমনবাবু?’
‘না তো!
কী হয়েছে?’
‘আরে ওর
নামটা ওরা সিট অ্যারেঞ্জমেন্টে ঘুলিয়ে ফেলেছে। কোনো হলেই ওর নাম নেই। এদিকে শুনছি
প্রথম পরীক্ষাটা অসুস্থতার জন্য দিতে পারেনি। আমি নিজেও আসিনি সেদিন। ওর খাতাও
পাইনি। খাতা দেখার আগে কনফার্মড হতে হবে তো... আর বলবেন না!’
দুই
স্যার ইস্কুলের দোষত্রুটি নিয়ে কথা বলার ফাঁকে হলে একটু ফিসফাস শুরু হয়ে গেল।
শুভজিতের পেছন থেকে চয়ন পণ্ডিত ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই শুভ, আব্রাহাম লিংকন
কোন দেশের মানুষ ছিলেন রে? বল না, এই... কোনটায় দাগ দেব?’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন