শিরোনামহীন
চার
* হালকা করে গান চালিয়ে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে ব্যালকনিতে
এসে দাঁড়ালেন বিভাস| আহা, সরোজের গলাটা এত সুন্দর, আগে কখনো খেয়াল হয়নি! সরোজিনী তাঁর স্ত্রী হলেও তাকে কখনো সেইভাবে পাননি বিভাস| সারাজীবন গান নিয়েই
কেটেছে সরোজের| তবু আজ যখন সরোজ নেই তখন
কোনো আক্ষেপ নেই বিভাসের, কারণ সরোজের যে গানের প্রতি
অভিমান করে তিনি দূরে সরে গেছিলেন, সেই গানেই
এখন সরোজের ছোঁয়া পান তিনি|
* মনোময়ের প্রিয় জায়গা এই গঙ্গার ধারের বেঞ্চটা| পাশেই একটা ছাতিম গাছে ফুল ভরে এসেছে| বুক ভরে
নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল| বাসন্তীর সাথে
এখানেই এসে বসতেন ছুটির দিনের সন্ধ্যেগুলোয়| ছাতিম ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন
দুজনেই|
চোখে চোখে বলা হয়ে যেত অনেক না বলা কথা| বাসন্তী চলে গেছেন মাত্র ক’টাদিন আগে| আজ আবার এখানে এসে বসেছেন| গঙ্গার বুকে ডুবে যাওয়া সূর্য আর ছাতিম ফুলের মাতাল
করা গন্ধে আবার খুঁজে পেলেন তাঁর বাসন্তীকে| বাসন্তী তার প্রিয় এই জায়গা ছেড়ে কোত্থাও যায়নি!
* সুনন্দাকে প্রবাল এই
মিউজিক সিস্টেম উপহার দিয়েছিলেন তাদের তিরিশতম বিবাহবার্ষিকীতে| আসলে সুনন্দা গান শুনতে ভীষণ ভালোবাসতেন| স্ট্রাগল
করতে করতে যখন সংসারে একটু সমৃদ্ধি এলো, তখন এই উপহার কিনেছিলেন প্রবাল| 'আজ ‘জানে কি জিদ না কারো/ইউহি
প্যাহলু মে ব্যাঠে রাহো’ এই আকুতি
আজ ছেয়ে ফেলছে মফঃস্বলের সচ্ছল এই ফ্ল্যাটের প্রত্যেক কোণা| হাজার জেদ করলেও সুনন্দা ফিরে আসবেন না| আসলে উচ্চতার ইঁদুর দৌড়ে প্রবাল এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, কখন মারণব্যাধি খেয়ে ফেলেছিল সুনন্দাকে, তিনি
খেয়ালই করেননি| আজ বোঝেন, বিলাসবহুল জীবনের থেকে সুনন্দার সঙ্গ অনেক বেশি
কাম্য ছিল|
* রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি
এসে বাওয়াল করত হারু| মেয়েদুটো ভয়ে সিঁটকে থাকত প্রত্যেকটা রাত|
হারু বাড়ি ফিরেই সব রাগ সব হতাশা ঝেড়ে ফেলতে হাতের সুখ করত মালতীর
ওপর| মেয়েদুটোও ছাড় পেত না| যেন এইভাবেই
সংসারের সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে! মারতো, পিটতো, খারাপ কথা বলে শান্তি খুঁজে নিত| আবার শেষরাতে সেই মালতীর ব্যথা
দূর করত আদরে, সম্ভোগে| এইভাবেই কেটে
গেছে পঁচিশ বছর একসাথে| বড়টার বিয়ে হলো, পাকা দালান হলো, চাষের জমি হলো| সংসারে এখন স্বচ্ছলতা উপচে পড়ছে চারিদিকে| ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েই মালু কেমন যেন নেতিয়ে
পড়েছিল|
আজ বউটাকে ওরা নিয়ে গেল| হারুকে মুখাগ্নি
করতে দিল না ওরা, বলল, বেঁচে থাকতে যে বউকে একটু সুখ দেয়নি মরা
বউ নিয়ে আদিখ্যেতা
তাকে মানায় না| ওরা কী করে বুঝবে
ভালোবাসা অনেক রকম হয়! এত মার খেয়েও যেমন মালু তাকে ভালোবাসতো, তেমনি এত মার মারার পর সেও মালুকেই তো ভালোবাসতো!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন