ধারাবাহিক
উপন্যাস
তাহার নামটি
তাহার নামটি
(তিন)
পিমকে
খাঁচা থেকে ছেড়ে দিয়েছে রঞ্জনা। দুপুর থেকে সে ছাদের এ কোণে ও কোণে টহল দিচ্ছে।
রঞ্জনা রোদে পিঠ ফেলে পিছন ফিরে বসে খুব মন দিয়ে কিছু একটা পড়ছে, মাঝে মাঝে আবার
উঠে উঠে গিয়ে পিমকে আপেল খাইয়ে আসছে। –
অঞ্জনদের ছাদ থেকে এটুকুই বোঝা যায়।
ছাদে
মাদুরে রাখা রেডিওর নব ঘুরিয়ে কোনো এক হিন্দি গানে এসে থামে অঞ্জন। পাশেই রাখা
অঙ্কখাতা বই আর নীল সালোয়ারের বায়োলজি নোটবুক।
নোটবুকটা
খুব সাবধানে তুলে আনে অঞ্জন। দু’একটা
পাতা ওলটাতেই ফটোকপি করা পাতাগুলো বেরিয়ে আসে তার মধ্যে থেকে।
এদিক
ওদিক দেখে নিয়ে অঞ্জন পড়ে, প্রথম পাতায় লেখা বইয়ের নাম-
যৌন
মিলনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও তার ব্যাখ্যা
টি. পি. মাইতি
ঝট
করে আরেকবার এদিক ওদিক দেখে অঞ্জন পাতা ওলটায়। ওলটাতেই তাতে সাদাকালো
দু’হাত
দুইদিকে মেলে দাঁড়ানো উলঙ্গ পুরুষ ও নারীর পূর্ণাঙ্গ অবয়ব। তাদের
দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বায়োলজির প্র্যাক্টিকাল খাতার আঁকার মতো করে পয়েন্ট আউট
করা। পুরুষ অবয়বকে উপেক্ষা করে অঞ্জন হুমড়ি খেয়ে পড়ে নারী অবয়বের ওপর। দু’একবার অসাবধানে দেখে ফেলা
মায়ের বুক ও বুকের ভাঁজ ছাড়া নারী শরীর সম্পর্কে তেমন কিছুই তার জানা নেই।
অনেকক্ষণ ধরে অঞ্জন ছবিটা দেখতে থাকে। চোখ পাতা বেয়ে একটু নিচের দিকে নামতেই অঞ্জন
টের পায় সে আসছে।
রেডিওতে
ঠিক তখনই গর্জে ওঠে, “দেখা হ্যায় পহেলি বার সাজন কি আঁখো মে প্যার”- এর কুমার
শানু।
আসতে
আসতেই অঞ্জন হঠাৎ শোনে,
অদ্ভুত গলায় কে যেন রেডিওর সুরের সাথে গাইছে,
“দেখা হ্যায় পহেলি বার সাইকেলপে হাথি সওয়ার, কুত্তা নাচে, কুত্তা নাচে, কুত্তা
নাচে, কুত্তা নাচে!”
ছাদের
পাঁচিল দিয়ে গলা উঁচিয়ে অঞ্জন দেখতে পায় রঞ্জনাকে। পিমের পিছু পিছু ঠিক খরগোশের মতোই উবু হয়ে বসে লাফিয়ে লাফিয়ে
এগিয়ে চলেছে রঞ্জনা আর তারস্বরে গানটা বিকৃত করে গাইছে।
অঞ্জনের আর পুরোপুরি আসা হয় না, সে ফ্যাকফ্যাক করে হেসে ফেলে। হাসি শুনে রঞ্জনা
ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। অঞ্জনকে দেখামাত্র সে উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে
থাকে। দরজার কাছে পৌঁছে থমকে দাঁড়ায় রঞ্জনা। তখনও অঞ্জনের হাসি থামে না। অঞ্জনের দিকে ফিরে দু’হাত উঁচিয়ে বেশ সময়
নিয়ে রঞ্জনা হঠাৎ দুটো মধ্যমা দেখায় অঞ্জনকে, তারপর বেরিয়ে যায় ছাদ থেকে। ঘাবড়ে
গিয়ে অঞ্জন পাঁচিলের আড়ালে মাদুরে বসে পড়ে। সামনে খোলা পাতলা পাতাগুলো ওড়ে হাওয়ায়।
সাদাকালো ছবিটা আবার খুলে যায় তার চোখের সামনে। আচ্ছা, রাজীবের দিদিরগুলোও কি...
এইরকমই? এর চেয়ে বেশি ভাবার সাহস হয় না তার, নীল সালোয়ারের বায়োলজি নোটবইয়ের মধ্যে অঞ্জন স্টেপল করা
পাতাগুলো ঢুকিয়ে রাখে।
“ভিতরে
এসো”
রঞ্জনা
বলে, “মা বলছিল তুমি ডেকেছিলে”
“হ্যাঁ”
বলে সুনীল মজুমদার আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যান। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর
রঞ্জনা বলে, “আমায় বেরতে হবে, আমি আসি?”
“না,
দাঁড়াও, কথা আচে।”
বিরক্তিতে
ভ্রূ কুঁচকে ওঠে রঞ্জনার। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পা নাচাতে শুরু করে। মিনিট তিনেক
পরে সুনীল মজুমদার বলেন, “বোসো!”
রঞ্জনা
শব্দ করে চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়ে। সুনীল মজুমদার ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা রঙিন
ফটোগ্রাফ টেবিলের উপর রেখে রঞ্জনার দিকে ঠেলে দেন, “দেখো তো পচন্দ কি না...”
ফটোটি
কোনো এক স্যুট টাই পরে সেজেগুজে পোজ দেওয়া যুবকের। কেন কে জানে রঞ্জনার খুব চেনা
চেনা লাগে তার মুখ। “কে এ?”
“ঋতম
রায়।
শুনেচি তোমার সাতেই প্রাইমারীতে পড়ত, ভালো ছেলে, এখন ডাক্তারি পাশ
করেচে, ট্যাংরায় চেম্বার আচে, মাস গেলে ত্রিশ পয়ত্রিশ মতো ঘরে আসে।... কি পচন্দ?”
“হ্যাঁ,
সে তো পছন্দ, কিন্তু কেন?”
“কেন
মানে? পচন্দ করতে বললাম কী
করতে?”
“ভালো
ছেলে, ভালো ইনকাম, একে অপছন্দ করার তো কিছু নেই!”
“তালে
আসতে বলে দিই? একদিন এসে দেখে শুনে যাক?”
“হ্যাঁ
বলো। ঋতম, না? হ্যাঁ, ওর মা ভালো চাউমিন বানাতো। ঠিক আছে, হ্যাঁ বলে দাও।”
সুনীল
মজুমদার বেশ অবাকই হন, এত সহজে রঞ্জনা মেনে নেবে, তা আশাও করতে পারেননি
তিনি। মনে মনে খুশি হয়ে বলেন, “সেই ভালো, আচ্চা, তুমি এসো এখন।”
রঞ্জনা
উঠে পড়ে।
“ও
হ্যাঁ, আরেকটা কথা, পাঁচিলের গায়ে তুমি যে ওটা লিকলে, জানো তা ঠিক করতে কত টাকা
আবার ঢালতে হবে আমায় রঙের পেচনে?”
“পাঁচিল?
কই, আমি তো কিছু... কি লেখা পাঁচিলে?”
“দেকো,
একদম মিথ্যে বলবে না, সত্যি কথা বললে আমি কিচুই বলব না তোমায়।”
“এতে
মিথ্যে সত্যির কি আছে? আমি কিছু লিখিনি, আর লিখবই বা কেন? তা, কি লেখা পাঁচিলে?”
“সত্যিই
তুমি লেখোনি?”
“নাহ্,
কেন লিখতে যাব, নতুন রঙ করা পাঁচিল...”
“হুম্,
তালে লিকলোটা কে...”
“পাঁচিলে
কি কালকে সকালের দিকে লেখা হয়েছে?”
“হুম,
কেন?”
“তাহলে
আমার মনে হয় এটা টোটো আর টোটোর বন্ধু, ঐ যাকে ওরা জুলপি বলে ডাকে, ওরা করেছে। বিকেলে ওদেরকে ছাদে দাঁড়িয়ে
পাঁচিল নিয়ে হাসাহাসি করতে শুনলাম।”
“সত্যি
বলচো? টোটো তো এমন কাজ করে না
কখনও, এসব তো তুমিই করে এসেচো এতকাল!”
“এখন
আমি বড় হয়ে গেছি জ্যে, আমি আর ওসব করি না”
সুনীল
মজুমদার চশমার ফাঁক দিয়ে রঞ্জনাকে মাপেন খানিক, রঞ্জনা আরো টানটান হয়ে দাঁড়ায় তাঁর
সামনে।
“আচ্চা,
এসো তালে, আর টোটোকে বোলো আমার সাতে দেখা করতে, আর বোলো ঐ গোঁফ না জুলপি, তাকেও
সাতে করে আনতে”
“কাল
কি বুধবার? তাহলে জুলপি সন্ধ্যেবেলা আসবে, বুধবার চিরুদা ওদের বাংলা পড়াতে আসে”
“আচ্চা,
তালে তকনই দেকা করতে বোলো”
“আচ্ছা,
আমি তাহলে আসি জ্যে?”
“হ্যাঁ
এসো।”
প্রিয়
সাব্বির,
তিনি
বললেন, “We
must be free, not because we claim freedom, but because we practice it.”
পিমকে
দেখি খুব। খাঁচায় বসে এমনভাবে সে ফুলকপির পাতা খায়, যেন সে দুনিয়া সম্পর্কে least
bothered. আসলে পিমের ধারণা নেই। খাঁচা সম্পর্কে পিমের কোনো ধারণা
নেই। ধারণা থাকলে কি সে একবারও ওই আলগা পাল্লাটা খুলে নিজে থেকে বেরিয়ে আসত না?
পিমকে খাঁচায় রাখো বা খাঁচার বাইরে, পিমের কিচ্ছু যায় আসে না।
মাঝে
মাঝে ভাবি, আমরাও কি পিমের মতোই? খাঁচাটার সম্পর্কে সত্যি হয়তো আমরা কিছুই ভাবি না, জানি না, পাত্তা দিই না।
আবার
এও হতে পারে, জানি, খুব ভালো মতো
জানি বলেই খাঁচাটার মধ্যে বসে থাকি। বাইরে থাকতে গেলে যে
পরিমাণ আবেগ সইতে হয়, তা হয়তো
দুর্বিসহ। অথবা বাইরে থাকার উত্তেজনা
আমরা ভয় পাই। হয়তো খাঁচার প্রতিটা কোণ আমাদের নখদর্পনে হলেও, খাঁচার বাইরেটা
আমাদের একদম অচেনা। তাই আমরা এই বিষয়ে কিছু ভাবতে ভয় পাই। খাঁচার ভিতরে থাকি বা
বাইরে, তাই হয়তো
আমরা সে নিয়ে ব্যস্ত হই না, ব্যক্তিগত স্বার্থে।
আমার
ছোটবেলার বন্ধু ডঃ ঋতম রায় খুব তাড়াতাড়ি আমার সাথে দেখা করতে আসছে। কেন আসছে, সে
তোমার না জানলেও চলে।
ভালো
থেকো।
ইতি
রঞ্জনা
পুনশ্চঃ
তিনি এটাও বললেন, “Freedom is not worth having if it does not
include the freedom to make mistake.”
টেবিলে
ফেলে রাখা চিঠিটা পড়ে না রাজীব। মাঝরাতে রঞ্জনার চাপা নাকের ডাকের মাঝে ঘরে ঢুকে
সে বইয়ের আলমারীর ঠিক একই জায়গায় চটি বইটা গুঁজে রেখে বেরিয়ে আসতে যায়। আর ঠিক তখনই রঞ্জনা ঘুম জড়ানো
গলায় বলে ওঠে, “জুলপি, আহ্, জুলপি! আহ্! ও মা! মাহ্!”
রাজীব
খানিকক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে রঞ্জনার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে
যায়।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন