‘আফাল’ হাওর অঞ্চলের জীবনযুদ্ধের সরল
সমীকরণ
লেখিকা শিরিন
আক্তারের সাথে হাওরের ঢেউ আর হাওরাঞ্চলের মাটি ও মানুষের শেকড়ের সম্পর্ক। জীবন চলার পথের বাঁকে বাঁকে হাওরের ঢেউয়ের সাথে সংগ্রাম করে
টিকে থাকা মানুষের জীবনযুদ্ধের বহুমাত্রিক পর্যবেক্ষণ লেখিকার জীবনকে
নানাভাবে আলোড়িত করেছে। তারই
প্রতিফলন হিসেবে জীবন চলার পথের বোধ-ব্যাপ্তির বক্ররেখার সরল সমীকরণ টেনেছেন
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আফাল’ রচনার মধ্য দিয়ে। লেখিকা শিরিন
আক্তার সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার উজানীগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লীডস, ইউকে থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পাশাপাশি তিনি দেশে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে এমবিএ এবং কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। শিরিন আক্তার দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা
এফআইভিটিবি-এর প্রাথমিক শিক্ষা
কর্মসূচির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ভাটি বাংলার হাওর – হয়তো বা সমুদ্র নয়, তবে তার চেয়ে কোনো অংশে কম কী! হাওর মানে দিগন্ত বিস্তৃত ভুমি। বর্ষায় পানি আর পানি। শুকনোকালে
মাঠের পরে মাঠ। সবুজ ধানের ক্ষেতে ফসলের হাসি। ঘাসের চট্টন আর মাছের জলাধার। হাওরাঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ছয় মাস পানি আর ছয় মাস ফসল
উৎপাদনের ব্যস্ততা। এই
হাওরাঞ্চলের মানুষের অজানা জীবনযুদ্ধের অবর্ণনীয় বর্ণনায় লেখিকা শিরিন আক্তার তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আফাল’ গ্রন্থে তুলে
ধরেছেন হাওরের মানুষ, জীবন, ধর্ম, লোকাচার
ও সংস্কৃতির অনন্য আলেখ্য। আফাল মানে
ঢেউ - হাওরের
উতলা ঢেউ। হাওরের আফালের সাথে হাওরের মানুষের জীবন কীভাবে কাটে, কীভাবে ঘুমায়
আর চিন্তার অতলে কীভাবে স্বপ্নের জাল বুনে সেইসব অজানা কথামালাকে নিজের জীবনবোধ আর দর্শনের মালঞ্চে গেঁথেছেন
একটি অনবদ্য কাহিনী। হাওর এলাকার বড়কর্তা, একান্তবর্তী পরিবার, সামাজিক সংস্কারের দাসত্ব, দুর্যোগ-দুর্ভাবনা, হাহাকার ভরা দীর্ঘশ্বাস, অনেকের মাঝেও একাকীত্ব, এমনকি
হতাশার মাঝেও আশা নিয়ে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াবার অর্ণিবাণ প্রত্যয় হাওরের
মানুষেরা কীভাবে জীবন কাটায়, কীভাবে মানুষ
গড়ে, কীভাবে তাদের
স্বপ্ন ভাঙ্গে-গড়ে, লেখিকা খুব আদুরে আঞ্চলিক ভাষায় উপস্থাপন করেছেন
ভিন্ন মাত্রার জীবনচিত্রকথা ‘আফাল’। এই আফাল
যার অর্থ ঢেউ। ঢেউয়ের দোল খাওয়া নৌকার মতোই আফালের কাহিনী পাঠকের হৃদয়
দোলাতে দোলাতে নিয়ে যাবে হাওরে ভাসা কোনো এক অচিন দ্বীপে। যেখানে স্বপ্নরা বাস করে সুদূর সবুজ
পাহাড়ের উপর ভর করে অনন্য
উচ্চতায় দাঁড়িয়ে থাকা সুনীল আকাশের মেঘালয়ে। যে মেঘালয় থেকে হয়তো ক্ষণিক পরেই
রিমঝিম বারিধারায় কোনো এক নতুন গানের সুর তুলবে হাওরের জলে, ঢেউয়ের গর্জনে, জলের অতলে অথবা নীরব নিথর রোদেলা দুপুরের নিঃষ্প্রাণ
বাতাসের বোবাকান্নায়। লেখিকা শিরিন আক্তারের হাওরে বিভোর স্বপ্নে-জাগরণে, অনুভবে আলিঙ্গনে কাটানো শৈশব, যৌবন আর
বিদগ্ধ জীবনবোধের পূর্ণতায় দেখা-অদেখা, চেনা-অচেনা মানুষগুলোর ভেতরের নির্যাসটুকু খন্ডিত
করেছেন উপন্যাসের শব্দে, বর্ণে, বাক্যে, প্যারায়
প্যারায়। গল্পের কাহিনীর চেয়ে পাঠকের কাছে মাঝে মাঝে মনে হবে
হাওরের মানুষের ভাষার শৈল্পিকতার কত মুগ্ধতা, না আধুনিক, না অ-প্রাচীন। আগামী দিনে যে
প্রজন্ম হাওরের ইতিহাস ঘেঁটে ঘেঁটে সাগরের জল সিঞ্চন করতে চাইবে
ঝিনুকের খোলস দিয়ে, তাদের জন্য অনবদ্য সহায়িকা হবে এই উপন্যাস ‘আফাল’।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে চৈতন্য
প্রকাশনী, সিলেট থেকে। মূল্য ১৮০
টাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন
তৌহিদ হাসান। অনলাইন পরিবেশক : রকমারি ডটকম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন