হেরম্বচরিত
চিরকালীনতা
চিলাপাতার হাতে ঢোল বাজাতে
বাজাতে নিকটবর্তী হয়েছিল জার্মান রাভা। আন্দু বস্তিতে হাড়িয়া খেতে খেতে কত কত বছর আগে জার্মান তার
জীবনের নানা কিসিমের গল্প শুনিয়েছিল। কত কত বাদ্যগান মোরগলড়াই কবরখানা ধামসা মাদল! এক ফাঁকে জেনেছিলাম শিবজির বৃত্তান্ত, যাকে গিলে ফেলেছিল
মেন্দাবাড়ির হাতি। মাঠে মাঠে ঘুরি। ছড়ানো রোদের মায়ায় ভরভরন্ত শীতকাল। নক্সাদার। অপরূপ। প্রান্তিক সব গঞ্জবাজারে
উত্তরজনপদের, নিম্ন অসমের নদী জল বাতাসে পুষ্ট হতে হতে কেমন এক চিরকালীনতাই এসে যায় বুঝি! কত সম্পর্ক! বর্ণময় এক জীবনই তো যাপন
করি!
অসমের গৌরীপুর। সাদা ফিতের এক নদী গদাধর। লাওখাওয়ার বিল। ৩০০ বলির দুর্গাপুজো। রাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া। রাজকুমার প্রমথেশ। লালজি রাজার গল্পগাথা। আর হস্তির কন্যা প্রতিমা
বড়ুয়া। জনশ্রুতিতে ‘আজার বেটি’। গৌরীপুরের পথে পথে হাঁটি। পাগলের মতো হাতি খুঁজি। সেই সব মাহুত ফান্দীদের খুঁজি। আমার শরীর জুড়ে গোয়াল পারিয়া লোকগান। কাঠি ঢোল। মায়াময় এক জীবন নিয়ে আমার
গতজন্মের ‘মাটিয়াবাগ রাজবাড়ি’। বিমল মালির বাজনা বাজে, বাজে সীতানন্দের সারিন্দা। প্রতিমা বড়ুয়ার গানের সুরে
সুরে আমার আবহমানের অনুভূতিময় স্মৃতিকাতর কুয়াশাঘেরা
জীবনের দিনগুলি জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকে। তুমুল এক শীতরাতে রাজবাড়ি থেকে বিমল মালির সঙ্গী
হয়ে ফিরছিলাম। বিমল শোনাচ্ছিল প্রতিমার নেশাময় জীবনের হরেক গাথাগল্পগুলি। প্রতিমার জীবন, তার গান, গানময় বেঁচেবর্তে থাকবার
আর্তি প্রবলভাবে উজ্জীবিত করেছিল। নাসিরুদ্দিন বিড়ি আর দেশী মদ খতে খেতে হাতিমাহুতের সে এক
অন্তহীন পৃথিবী-
‘ও তোর মাহুত চড়ায় হাতি / গদাধরের পারে পারে রে’
রঙিলা দালানের মাটি
আবার হেরম্ব বর্মণকে কী করে ভুলি! সাহেবপোঁতার হাটে, পাটকাপাড়ার হাটে টর্চলাইট
বিক্রি করত হেরম্ব। সে ছিল আমুদে, রসিক মানুষ। কোচবিহার রাজার শিকারযাত্রায় হাঁকোয়ালি করত। ‘কুষাণ পালায়’ ছুকরি সেজে
খোসা নাচত। আবার হেমন্তের সদ্য কাটা ধানখেতে ঘুরে ঘুরে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান কুড়িয়ে নিয়ে
আসত। হেরম্ব গল্প বলত, যেন বহুপ্রজ এক কথোয়াল! পুরনো দিনের সব ধনীজোতদার, কোচবিহারের রাজা রাণী রাজকুমারেরা কী জীবন্ত হয়ে
বর্তমানে ফিরে আসত যেন!
দিদির মৃত্যুর দিন বৃষ্টির
হচ্ছিল। বৃষ্টির ভিতর মৃত দিদির মৃতদেহ বহনকারী আমরা। দিদির মৃতমুখ বেদনাবাহী বৃষ্টিকণায় মিশে যেতে যেতে কেমনতর
এক শোকগাথা হয়ে দিদিকে নিয়ে লেখা যাবতীয় এলিজিতে গিয়ে ঝাঁপ দেয়।
গল্পের পাকে পাকে, স্মৃতির পাকে পাকে জড়িয়ে
যাওয়া জীবন। অথচ কোথাও জায়মানতা থাকে না! নদীতীরের বাতাসে তিরতির কেঁপে ওঠা জীবন। কাঠামবাড়ির জঙ্গল ভেঙ্গে
হাতিরা বেরিয়ে আসে, হাঁটতে থাকে গজলডোবার দিকে। আমি বুঝে ফেলি, দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে
রঙিলা দালানের মাটি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন