চোট্টামি
স্টেশনের বাইরে নিজের সাইকেলটা রোজকার মতো খুঁজে পেল সুদীপ। প্রতিদিনের মতো সেটা আজও স্থান পরিবর্তন করেছে। দেওয়ালের পাশের
ল্যাম্পপোস্ট ছেড়ে সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে বেশ অনেকটা। সাইকেলটা বাকি সাইকেলগুলোর
মতোই। দুটো চাকা, দুটো হ্যান্ডেল, দুটো
প্যাডেল, দুটো ব্রেক - তবুও প্রতিদিন সাইকেলটা চুরি যাওয়ার একটা অজানা ভয় কুরে কুরে খায় তাকে। এই ভয় নিয়ে কোনো গবেষণা করেনি কোনোদিন। কলেজ যাওয়ার পথে প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো
করে সাইকেলটার পিছনের
চাকায় চাবি ঘোরানোর সময় একটা লুঙ্গি পরা লোককে ধারে কাছে দেখতে পায়। তাকেই কেমন সন্দেহ হয় চোর বলে। লুঙ্গিতে কালিঝুলির
দাগগুলো যেন স্তরে স্তরে বসে গেছে। মুখটা নিরীহ তবুও যেন বিশ্বাস হয় না। গত পরশুও
বিশ্বাস হয়নি যখন পিছনের পকেট থেকে চল্লিশ টাকা গোঁজা মানি ব্যাগটা আস্তে আস্তে
তুলে নিচ্ছিল একজন অফিসযাত্রী ভদ্রলোক। পাছায় অকারণ স্পর্শ পাওয়ায় সতর্ক হয়ে যায়
সুদীপ। পিছন ফিরতে পারেনি অত চাপাচাপির মধ্যে। অগত্যা চোরটির চেহারা কেমন তা ঠিক
দেখা হয়ে উঠে না। তবে চোরেরা যে নিতান্তই নিরীহ সে বিষয়ে মনে আর কোনো সন্দেহ
নেই। ‘পেপার চাই পেপার... আনন্দবাজার বর্তমান প্রতিদিন আজকাল...’ ফ্রন্ট পেজের কুড়ি বাই কুড়িতে রঙিন বিয়ে করেছে শ্রেয়া ঘোষাল! মৌসুমির মুখটা আচমকা মনে পড়ে
যায় সুদীপের। মন চুরি করার পর এক গাল হেসে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করল কাকার বন্ধুকে।
যদিও তাতে বিশেষ কিছু যায় আসেনি সুদীপের। যায় আসেনি, কারণ,
সাইকেলের চাকায় হাওয়া থাকত ভরপুর। সোঁ সোঁ করে ভর দুপুরে উড়ে বেড়াত। গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে বাবার অ্যাশট্রে থেকে জোগাড়
করা আধ খাওয়া বিড়ির বাকি অর্ধেক অংশের ধোঁয়া বানাত। গোল গোল চৌকো চৌকো ধোঁয়ার
মধ্যে দিয়ে দেখে নিত আকাশটা। ডান পাশের আকাশে তখন
চাঁদ বাঁ পাশে ঘটিগরমওলা।
এরকমই বেশ কয়েকদিন চলে
যায় এপাশ ওপাশ দিয়ে। নীল নীল খোপ করা শার্টের বুক পকেট থেকে সাইকেলের চাবিটা বের করে আনে সুদীপ। পড়ন্ত বিকেল, রেখে
যাওয়া সাইকেলটায় চাবির খোঁচা দেয়। বুঝতে পারে, খুলতে
চাওয়া লক আগে থেকেই খোলা।
কপালটা কুঁচকে আসে না ওর। এ ক’দিনে এটা
অভ্যাস হয়ে গেছে। একটা বদল বদল
খেলা। তিড়িং বিড়িং জায়গা বদল। সাইকেলটাও কেমন ক্যামেলিওনের মতো রঙ বদলে ফেলছে। সবুজ রঙের সাইকেল কোনোদিন হয়ে যাচ্ছে
লাল আবার কোনোদিন বর্ণহীন ধূসর! কিন্তু সাইকেলটা থেকে যাচ্ছে অবিকল একটা সাইকেলের
মতোই... দুটো চাকা, দুটো হ্যান্ডেল, দুটো
প্যাডেল, দুটো ব্রেক। ভাবনা
চিন্তাকে অবকাশ না দিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ইউ-টার্ন নেয় সুদীপ। দেখতে পায়
সেই লুঙ্গি পরা লোকটা অদ্ভুত একটা হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে, হাতে একটা
আয়না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন