পর্দাপ্রথা, কিছু সংশয়
ও প্রবাস
(৫)
নিউজিল্যান্ডের ডুনেডিন শহরের একমাত্র মসজিদে পুরুষ এবং মহিলাদের ইবাদতের জন্য পৃথক কক্ষ ও শৌচাগার আছে। অত্যন্ত উন্নত ব্যবস্থাপনা। আগে মসজিদের সদর দরজার সিঁড়ি, বারান্দা পার হয়ে তারপর মহিলা ও পুরুষগণ নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করতেন। বর্তমানে বছরখানেক হলো মূল ফটক থেকে সরু পথ পার হয়ে পেছন দরজা দিয়ে মহিলাদের নির্ধারিত নামাজ কক্ষে প্রবেশের নিয়ম করা হয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরে মহিলা কক্ষে কোনো পুরুষের সামান্যতম ছায়া পড়াটাকেই চরম অভদ্রতা হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অনেক দিন দেখেছি, মসজিদের সুপ্রশস্ত মূল ফটকে অনেক পরস্পর পরিচিত, তা সে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যে পর্যায়েরই হোক, অনেক নারী-পুরুষই কুশল বিনিময় এমনকি হাসি ঠাট্টাও করছেন। আমি নিজেও বাংলাদেশী ও ভিনদেশী অনেক পরিচিত ভাইয়ের সাথেই কুশল বিনিময় করেছি মূল প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে। ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এখানেই অপেক্ষা করতে হয়। ...আমার প্রশ্ন, ফটক এবং ইবাদতখানার মধ্যকার কুড়ি কদম ব্যবধানে নিয়মের এত কঠোর হেরফের আসলে কি কোনো যথোপযুক্ত নিয়মকে প্রমাণ করে?
আবার মসজিদের একমাত্র ল্যান্ডফোন লাইনটি পুরুষ কক্ষের বিপরীতে খোলা প্রশস্ত বারান্দায় অবস্থিত। কোনো পর্দানশীন মহিলার ফোনটি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়লে সেখানেই যেতে হয় বা হবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়, একবার আমি মোবাইলে প্রয়োজনীয় ব্যালেন্স না থাকায়, বাসার গাড়ি এসেছে কিনা খবর নিতে গিয়ে, টের পেয়েছি ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। অথচ সামান্য মুখ দেখাদেখির ব্যাপারে এত কড়াকড়ি যেখানে, সেখানে বর্তমান দিনে অত্যন্ত সহজলভ্য সামান্য একটি এক্সটেনশন লাইন মহিলাকক্ষে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কর্তৃপক্ষ খেয়াল করেননি! এখানে ল্যান্ডলাইন টু ল্যান্ডলাইন বিলও অতি সামান্য। মোবাইলেও কল ঢোকে না সেখান থেকে। তাহলে ব্যাপারটা ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেড়ো’র মতো দাঁড়ালো না কি? আধাআধি যে কোনো কাজ বা ব্যবস্থাই অত্যন্ত বিসদৃশ।
আমার সামান্য জ্ঞানে পর্দাপ্রথার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক সৃষ্টির আবহ
তৈরি করতে ইচ্ছুক নই আমি।
কিন্ত আমি মনে করি, পর্দা নয় শুধু,
যে কোনো নিয়ম মানতে হলে, পুরোপুরিই মানা
উচিত। আধাখেঁচড়া নয়। এবার আসি একজন ডিজাইনার হিসাবে এ ব্যাপারে আমার প্রাতিষ্ঠানিক
অভিজ্ঞতার ব্যাপারে। ফ্যাশন ডিজাইনের জগতে যে কোনো ফ্যাশন ট্রেন্ডই মোটামুটি
প্রতি দশ বছর পর পর ঘুরে আসার রিদমিক সাইকেলের ধারণা সুপরিচিত। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ট্রেন্ড হিসাবে বর্তমানে বেশ
কয়েক বছর ধরেই
মেয়েদের টারবান বা পাগড়ী এবং হিজাবের অবস্থান বা জনপ্রিয়তা অত্যন্ত তুঙ্গে। এসবের
নতুন নতুন ডিজাইন এবং সাথে ব্যবহার্য এক্সেসরিজ ও বাজারে প্রচুর পরিমানে আসছে। এটা
মার্কেটের দিকে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ না হলেও চলে।
২০১৬র জানুয়ারি মাসে ঢাকার উত্তরায় ‘রাজলক্ষ্মী
শপিং কমপ্লেক্সে’র পেছনে নতুন গড়ে ওঠা ‘আলাউদ্দিন
শপিং কমপ্লেক্স’ সম্ভবত নাম মার্কেটটির, সেখানকার তৃতীয় তলায় অবস্থিত ‘ইরানী বোরখা
শপ’টিতে কিছু হিজাব উপহার হিসাবে কিনতে গিয়ে, বোরখা এবং
হিজাবের চমকপ্রদ সব বাহারি ডিজাইন আমার নজর এড়ায়নি। সেখানকার বেশ কিছু চড়া
মূল্যের বোরখাই আসলে ওয়েষ্টার্ণ ষ্টাইলের ইভিনিং গাউনের ইসলামিক সংষ্করণ। এ মনোরম
নজরকাড়া যে, আমি নিজের জন্য একটা গাউন হিসাবে কিনেই ফেলব কিনা বুঝতে পারছিলাম না। অবশেষে নিজের
পকেটের প্রতি সদয় হয়ে নিজের জন্য আর কেনা হয়ে ওঠেনি, উপহারের জন্য কিনে বাড়ি ফিরেছি।
(৬)
ইসলাম ধর্মের উৎপত্তিস্থল মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর নারীদের বাড়ির বাইরে জনসম্মুখে বের হওয়ার বিধিসম্মত পোশাক হিসাবে বোরখাই প্রচলিত। বিশেষতঃ আমার পরিচিত একজন বিদেশিনী ইরানে চাকরি করতে যাওয়ার সুবাদে জানতে পারি, সেদেশের আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত মহিলাদের জন্যও বাহিরে যাওয়ার সময় বোরখা পরিধান বাধ্যতামূলক।
তাহলে এই স্কার্ফ-এ মাথা ঢাকার মূল উৎস কোথায়? বিভিন্ন খ্রিস্টান গীর্জাসমূহের নানদের এবং অন্যান্য বেশ কিছু ধর্মযাজিকাদের পোশাকের অনুষঙ্গ এটি। অখণ্ড সোভিয়েত রাশিয়ার শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোর নারীদের মধ্যেও বাহারি স্কার্ফে মাথা ঢাকবার প্রচলন আছে। আর বর্তমানে বাংলাদেশে যে স্টাইলের হিজাব সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, অর্থাৎ রেডিমেড দু’প্রান্ত সেলাই করা স্কার্ফের মাঝখানের ফাঁকা অংশে মাথা গলিয়ে সহজে পরিধানযোগ্য। এই স্টাইলটি আসলে মালয়েশিয়ান-ইন্দোনেশিয়ান আর্কিপেলাগো বা দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসিনী মুসলিম মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘আবায়া’র মাথা আবৃত করার অংশটুকু। ‘আবায়া’র নিচের অংশ হচ্ছে ঢোলা সোজা ছাঁটের পা পর্যন্ত লম্বা স্কার্ট। আর উপরের অংশটি হচ্ছে ঢোলা ধরনের ফুলহাতা শার্ট। পুরোটা মিলে যথেষ্ট মার্জিত ও শালীন। দশবারেরও অধিক সেই দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চল ভ্রমণের ফলে তাদের পোশাক ও অনুষঙ্গ সম্পর্কে আমি অবগত। আর আকাশ সংস্কৃতির ফলে আমরা হরহামেশাই ‘আবায়া’ পরিহিতা নারীদের ছবি তো দেখেই থাকি।
আর বাংলাদেশে বর্তমানে সব বয়সী নারীদের মধ্যে সহজে ‘ম্যানেজেবল’ পুরো শরীর ঢাকা ও আরামপ্রদ পোশাক সালোয়ার-কামিজ মূলতঃ
পাকিস্তানী মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। কাটছাঁটের উপর অনেক সময়ই এর শালীনতা-অশালীনতা
নির্ভর করে। খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা বুঝতে পারব, সালোয়ার-কামিজ বা শাড়ির সাথে
হিজাবের ব্যবহার আসলে একটি ফিউশন পোশাক। মার্জিত ব্যবহারে যে কোনো ফিউশনই অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।
কিন্তু ফিল্মি বা হিন্দী সিরিয়াল টাইপ মেকআপের সাথে পাকিস্তানী সালোয়ার-কামিজ অথবা ভারতীয় ঢংএ পড়া শাড়ি নজরকাড়া হলেও, অনেক সময়ে মেকআপ ও এক্সেসরিজ-এর বাহুল্যে যেন উচ্চকিত ভাবে গোপনে বলতে থাকে –
কিন্তু ফিল্মি বা হিন্দী সিরিয়াল টাইপ মেকআপের সাথে পাকিস্তানী সালোয়ার-কামিজ অথবা ভারতীয় ঢংএ পড়া শাড়ি নজরকাড়া হলেও, অনেক সময়ে মেকআপ ও এক্সেসরিজ-এর বাহুল্যে যেন উচ্চকিত ভাবে গোপনে বলতে থাকে –
“আমি যে রূপসী বংগ ললনা,
জানি সবই ছলাকলা ছলনা,
কামনার বাণী আমায় বোলো না,
আমি ধোয়া তুলসী পাতার তুলনা”।
এবার আসি বাংলাদেশ তথা বাঙালি মুসলিম নারীদের পোশাক প্রসঙ্গে। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রেক্ষাপটে বহু নারী বোরখা না পড়ে হিজাব পছন্দ করছেন। অনেক শিক্ষিতা নারীই এর ব্যবহার কর্মক্ষেত্রে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যময় মনে করে থাকেন। তাঁদের কাছে বিনীত প্রশ্ন আমার, বাঙালি নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনও কিন্তু শাড়ির মার্জিত ব্যবহার করেই বাড়ির বাইরে কাজ করেছেন। কাজেই বাইরে কাজ করার দোহাই না দিয়ে, বর্তমানে হিজাবের নাম করে যা পড়া হচ্ছে, তা ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। নিজেই টের পাবেন কোনটি অধিক শালীন। বেগম রোকেয়া অথবা মাদার তেরেসার শাড়ি পড়ার ধরন আপনাদের টানে না, কিন্তু উৎকট মেকআপ চর্চিত ফিউশন পোশাক আপনাদের মন ঠিকই টানে! মাঝখানে পর্দাপ্রথার ব্যবচ্ছেদ বা ডিসেকশন ঘটে, যেমন ডোমের হাতে সদ্যমৃতা কুমারীর লাশ।
এসব কি তাহলে নজর এড়িয়ে যাচ্ছে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের? নাকি বিবর্তনের ধারায় ‘পাইমালি’ নামক শব্দের উদ্ভব হচ্ছে আমাদের সমাজে? এটি আমার
উদ্ভাবিত শব্দ। পাকিস্তানীর ‘পা’, মালয়েশিয়ানের ‘মা’, ইন্দোনেশিয়া ও
ইন্ডিয়ার ‘ই’ এবং সব শেষে লেজকাটা
শেয়ালের মতো বাঙালিত্বের ‘লি’। তাতে বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি না হলেও, ‘পাইমালি’ ফ্যাশনের মতো ইসলামকে এজমালি সম্পত্তি না মনে করলেই হলো!
(ক্রমশঃ)
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন