মাপ
দক্ষিণারঞ্জনের
ঠাকুরমার ঝুলিতে ‘বাইশ জোয়ান তেইশ জোয়ান’-এর গল্পটা বোধ হয় সব বাঙালির পড়া বা শোনা। সেই যে কে বড় তার প্রতিযোগিতা
শেষে বাইশ জোয়ান তেইশ জোয়ান, তাদের দাঁতনের সুপুরিগাছ, বটগাছ, তাদেরকে সব সমেত
ট্যাঁকে ভ’রে ফেলা রাখাল আর রাখালকে তার গরুর পাল সমেত ঠোঁটে
তুলে নেওয়া পাখিকে, ছাদে বিকালে প্রসাধনরতা রাজকন্যার চোখে পড়া ছোট ছোট কুটিতে
নামিয়ে এনেছিল এইগল্প!
এর থেকেই প্রথম আমার মাপের ব্যাপারটা ছোটবেলায় মাথায় আসে। মাপের ব্যাপারটা সেখানে
গেড়ে বসে ছাত্রজীবনে শখে (ক্লাস এইট থেকে সারা জীবন অধীতব্য বিষয় হিসেবে ইতিহাস না
থাকায় প্রচুর পড়তে বাধ্য হয়েছি) Edwardes এবং Garrett-এর লেখা মুঘল শাসনের উপর বইটি
পড়ে। তার ‘Mughal
Architecture and Arts’ অধ্যায়ে আকবরের ফতেপুর সিক্রি থেকে শুরু ক’রে জাহাঙ্গিরের পেইণ্টিং বিষয়ে জ্ঞান, শাহজাহানের
তাজমহল সহ বিবিধ স্থাপত্য আরো নানান ক্ষেত্রে মুঘল বাদশাহদের জ্ঞান, কুশলতা, উৎসাহ, অবদান ইত্যাদি ব্যাখ্যানের
পর তাঁরা এক ফরাসি লেডি Marechale-এর একটি মন্তব্য পুনঃধ্বনিত করেছিলেন লেখকদ্বয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি অভিজাতদের এক
দুর্নামগ্রস্ত সদস্যের সম্পর্কে উচ্চারিত। সেই
অসাধারণ মন্তব্যটি হলো, ‘Depend upon it Sir, God thinks twice before
damning a man of that quality’১
এই মাপের ব্যাপারটা আমার মাথায় আবার ঢোকে বছর
পঁচিশ-তিরিশ আগে শ্রী সত্য সাঁইকে ঘিরে বিতর্কের সময়। সাঁই-এর ঐন্দ্রজালিক
কাজকারবারের বিরুদ্ধে অন্ধ্রপ্রদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চ্যালেঞ্জ
জানানোর পর এবং তাঁকে পরীক্ষা দেওয়ার আহ্বান জানানোর পর সত্য সাঁই সদম্ভ উক্তি
করেছিলেন, ‘অ্যাণ্টলোগ্ গডলোগকো টেস্ট ক্যায়সে করেগা?’ স্বভাবতঃই আমার সহানুভূতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দিকেই ছিল।
কিন্তু তাঁর ওই অনধিকারী মন্তব্যটি মাপের ব্যাপারটা আমার মাথায় পুঁতে বসিয়ে
দিয়েছিল। সত্যিই তো আমরা যারা ‘অ্যাণ্টলোগ্’, তারা এই সব অতিমানবদের কোন মাপ দিয়ে
মাপব? রিচার্ড বি. ফেইন্ম্যান এঁদের
বলেছিলেন ‘মনস্টার মাইন্ড্স’। তিনি নিশ্চয় ঠাট্টাই করছেন
মিঃ ফেইনম্যান
নামের অসামান্য আত্মজীবনী ধাঁচের বেস্টসেলার রম্যরচনায়! সারা বই
জুড়ে তিনি একথা বলেছেন আইনস্টাইন, নিয়েল্স বোহ্র,
এনরিকো ফের্মি ইত্যাকার মণীষী পদার্থবিদ্দের প্রসঙ্গে। সেই ফেইন্ম্যান
যিনি নিজে গণ্য ছিলেন সমকালে আইনস্টাইনের পর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্
হিসেবে, অথচ রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা,
প্রাণীবিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে চারটি অসমাপ্ত কাজ ছাত্র/সহগবেষকদের
হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন, যাদের প্রত্যেকে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিল! মানে, প্রত্যক্ষভাবে একটি আর পরোক্ষভাবে
চারটি নোবেল প্রাইজের উৎস, সমকালের শ্রেষ্ঠ তালাভাঙার মানুষ, আত্মপরিচয় গোপন ক’রে
ব্রাজিলের নাম করা
সাম্বা ব্যাণ্ডের ফেরেইরা বাদক কিছু মানুষের মাপের হদিশ না পেয়ে তাঁদের বলছেন ‘মনস্টার মাইন্ড্স’২ — ব্যাপারটা
বুঝুন!
রবীন্দ্রনাথ, যাঁকে বুঝুক বা না বুঝুক, না আওড়ালে বাঙালির ভাত হজম
হয় না, তিনি আবার এই মাপের ব্যাপারটাকে স্বভাবতঃই দুই ভাবে
দেখেছেন। একদিকে তাঁর কাছে মহামানুষ একযন্ত্র, একটা মাপ। অণুবীক্ষণ
যন্ত্রে ছোট জিনিসকে
বড় দেখায়, এখানে বড় জিনিসকে
ছোট দেখায়, ফলে আমাদের যত ছোট আমরা তার চেয়ে
বেশি ক্ষুদ্র লাগে। আরেকদিকে একটা অন্য মাপের কথা
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মহাপুরুষদের অভিঘাতের সম্পর্কে,
‘মহাপুরুষদের মাপতে হয় তাঁদের ব্যর্থতা দিয়ে’।
কিন্তু বহু মানুষ আছেন যাঁরা ধর্মীয় অর্থে এমনকি সেকিউলার অর্থেও ‘মহাপুরুষ’ নন হয়তো, কিন্তু
বিশাল মাপের মানুষ। আমি মেধার সংকীর্ণ অর্থেই বলছি। আর
ধরছি কেবল তাঁদের কয়েকজনের পড়াশোনার
পরিধি, এপারে ওপারে!
রাসেল তাঁর একটা বইতে জেমস
মিলের উপর অধ্যায়ে তাঁর ব্যক্তিত্বকে পরিস্ফুট করার জন্য একটি সিচুয়েশনের কথা
বলেছেন, যেখানে চোদ্দ বছর বয়সে জন স্টুয়ার্ট মিলের এক বছরের
জন্য বিদেশে যাবার প্রাক্বালে জেমস তাঁকে কিছু উপদেশ দিচ্ছেন। রাসেল এটার সঙ্গে
তুলনা করেছেন সদৃশ কোনো পরিস্থিতিতে পলোনিয়াসের বাগ্বিন্যাসের সঙ্গে। কোথায়, তা বাহুল্যবোধে ব’লে দ্যাননি। আমিও বলছি না। এর আগে অবশ্য জনের পড়াশোনা তেমন হয়নি। আট বছর থেকেই নিজের পড়া ছাড়াও গোটা আস্টেক ভাইবোনেদের প্রত্যেককে পড়াতে হতো। তারা পড়া না পারলে খাওয়া বাদ দেওয়াও
নাকি বাদ যেত না। ফলে পুরো ইলিয়াড, অডিসি, ইস্কিলাস, সফোক্লিস এবং ইউরিপিডিস, সব ল্যাটিন লেখক, বেশ খানিকটা ইতিহাস, খুব খুঁটিয়ে রোম্যান শাসনতন্ত্র, এসব ছাড়া এগারোর শেষ পর্যন্ত বেশি কিছু পড়তে পারেননি মিল। বারো বছরের আগে খুব
বেশি হলে বীজগণিত, জ্যামিতি, ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস আর উচ্চতর গণিতের বেশ খান কয়েক এলাকা। এতে অবশ্য ভাবা ঠিক হবে না যে জন জীবন থেকে একেবারেই ‘ফান’ বলতে কিছু পাননি।
আত্মজীবনীতে নিজেই বলেছেন এক্সপেরিমেণ্ট্যাল সায়েন্স থেকে তিনি একশো মজা লুটতেন।
কেবল তাত্ত্বিক অর্থে অবশ্য, প্র্যাক্টিক্যাল দিক থেকে নয়। সেই সময় কেবল অন্যদের এক্সপেরিমেণ্ট পড়ে, এমনকি তাঁদের সেটা করতেও না দেখে তিনি যে কী পরিমাণ ফাঁকি দিয়েছেন বা তাতে
পড়েছেন সেই দুঃখ তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত যায়নি। তবে ওই দোষের একটু ক্ষতিপুরণও
হয়েছিল। বারোতে শুরু করলেন লজিক পড়া। সে বিষয়ে অ্যারিস্টটলের যৎসামান্যও যা বলার
ছিল সেটা সেরে ‘স্কুলমেন’-দের (জানেন নিশ্চয়, Anselm
of Canterbury, Peter Abelard, Alexander of Hales, Albertus Magnus, Duns Scotus,
William of Ockam, Bonaventure থেকে St.
Thomas Aquinas)।অ্যাকোইনাসের Summa
Theologicae, Summa Contra Gentiles, এবং St
Augustine-এর De
libero arbitrio-তো যদ্দূর মনে হয় পড়েই ছিলেন। না হলে জানবেন কী করে কীভাবে ক্রিস্টিয়ানিটির মাধ্যমে প্লেটোবাদবা(Platonism) আর অ্যারিস্টটলবাদ (Aristotelianism) ইয়োরোপে অনুপ্রবেশ করল? এটা তো আমাদের সময়কার রাষ্ট্রদর্শনের হরে-নরে-পড়ে ছাত্ররাও জানতেন) এছাড়া বিনোদনও তো ছিল! বাবার সঙ্গে Bagshot
Heath-এ বেড়ানোর সময় গল্প হতো syllogistic
logic, মানে এককথায় ন্যায় কেন
ফালতু নয় আর তা আমাদের যুক্তিকে সত্যিকারের সুসংবদ্ধ চেহারা দিতে সাহায্য করে!
রাসেল
বলছেন এই উপদেশের ঠিকঠাক কথাগুলো কোথাও লিপিবদ্ধ না থাকলেও সেটা ছিল মোটামুটি
এইরকম, সেটা আবার আমার যা তা অনুবাদে— জন: এই মুহূর্ত
পর্যন্ত, এই সত্য স্মরণ রেখে যে নিজের মেধা বা গুণাবলীর সম্পর্কে অত্যধিক উচ্চ
ধারণা এক শোচনীয় দোষ, আমি সতর্কভাবে তোমার থেকে লুকিয়ে রেখেছি কী পরিমাণে তোমার বোদ্ধিক
অর্জনগুলি তোমার বয়সের অধিকাংশ ছেলেদের ছাড়িয়ে গেছে। এখন, অবশ্য, তোমার কল্যাণের
কারণে তোমার জন্য আমি যে বিদেশযাত্রার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার ফলে এটা
নিশ্চিৎ যে আমার থেকে না হলেও তুমি এই তথ্য অন্যদের থেকে জেনে যাবে; কেউ কেউ হয়তো
এতই অবিবেচক হবে যে তোমাকে এর জন্য সাধুবাদ দেবে, এবং তোমার মাথার
মধ্যে এই ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দেবে যে তুমি অলোকসামান্য ক্ষমতা ধরো। বস্তুতঃ যা কিছুই
তুমি অন্যদের থেকে বেশি জানো কোনোভাবেই তোমার অন্তঃস্থ কোনো গুণের কারণ হিসেবে
ধর্তব্য হতে পারে না, এর কারণ কেবল সেই অসামান্য সুযোগ যা তোমার ভাগ্যে পড়েছে, আমার মতো একজন পিতা পাওয়া, যিনি তোমাকে
পড়াতে কেবল সমর্থ নন, তার জন্য প্রয়োজনীয় ঝামেলা নিতে এবং সময় দিতে ইচ্ছুক। তুমি যে অন্য
বহু কম ভাগ্যবান ছেলের চেয়ে বেশি জানো এটা কোনো প্রশংসার ব্যাপারই নয়; বরং তুমি না
জানলে লজ্জার ব্যাপার হতো।’৩
এটা কেবল পড়ার মাপ, বাপ
ছেলের। এপারে — শুনেছি রাজা রামমোহন রায় বাল্যবয়সেই আরবী, ফার্সি, সংস্কৃতর সঙ্গেই বেশি বয়সে ইংরেজি ছাড়াও গ্রিক, হিব্রু,
আর ল্যাটিন শিখেছিলেন। মকরন্দ পরাঞ্জপে লিখছেন তিনি অন্ততঃ ১০টি
ভাষা জানতেন।৪ স্বগ্রামে বাংলা আর
ফার্সি শেখার পর তাঁকে নবম বর্ষে পাটনায় পাঠানো হয় আরবী শিখতে। তিন চার বছরের
মধ্যে আরবী আর ফার্সি ভাষা সম্পূর্ণ আয়ত্ত ক’রে তিনি কেবল
পারস্য আর আরবের তাবৎ কবি আর দার্শনিকদের পড়ে ফেলেন (এঁদের মধ্যে সুফিরা বেদান্ত ও
যোগের সঙ্গে তাঁদের সাদৃশ্যের কারণে তাঁকে আকৃষ্ট করেন) তাই নয়, আরবীতে অ্যারিস্টটল ও ইউক্লিড পুরো পড়ে ফেলেন! মৌলভীদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে
নামেন। বারো বছরে বারাণসীতে গিয়ে সংস্কৃত পাঠ শুরু করেন, আর
১৬ বছর পর্যন্ত হিন্দু শাস্ত্র ও দর্শন পাঠ শেষ করে, বেদান্ত
ও উপনিষদের পাঠ আত্মস্থ ক’রে এক দৃঢ় একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠেন।
আর ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামেন।
এর পরে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু আবার হিন্দুদের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে এক
কেতাব লিখে বাবা রামকান্ত রায়ের বিরাগভাজন হন, আর তার ফলে গৃহত্যাগ ক’রে দেশ দেশান্তরে ঘুরতে ঘুরতে তিব্বতে যান বৌদ্ধ ধর্মের পুঁথিপত্র পড়ে তার
সম্পর্কে জানতে। সেখানে একেশ্বরবাদ প্রচার করতে গিয়ে প্রায় মৃত্যুমুখে পড়েন,
কিন্তু এক তিব্বতী মহিলার দয়ায় প্রাণ নিয়ে ফিরে আসেন। আবার বাড়ি আর
সন্তপ্ত বাবার কাছে ফিরে রামমোহন ইংরিজি শিক্ষায় ব্রতী হন! সন ১৮০০ থেকে ১৮১৩ তিনি
বিভিন্ন সরকারি পদে কাজ করে পরে সেরেস্তাদার হন, আর দশ বছর
রামগড়, ভাগলপুর, আর রংপুরে কোম্পানির
দেওয়ান হন। John Duncan
Martin Derrett লিখেছেন রংপুরে থাকার সময় তিনি হরিহরানন্দ নামে এক
তান্ত্রিক সাধুর কাছে ‘modern tantric works’ পড়েন। এই সময়ে তিনি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তর্কাতর্কি
করা ছাড়াও বেশ কিছু কেতাব লিখেছিলেন ফার্সিতে। আর বেদান্তের কিছু অংশ অনুবাদ
করেছিলেন। তাদের অস্তিত্ব নেই। তবে এই সময়ে রংপুরে তাঁর সর্বৈব বিরুদ্ধে
লেখা আর ১৮৩৮ সালে (মানে বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মসালে) কলকাতায় প্রকাশিত একটি জ্ঞানাঞ্জন
নামের একটি বইয়ে তার উল্লেখ আছে।৫ ১৮০৪ সালেই তাঁর লেখা ফার্সি বই Tuhfat’ ul Muhwahiddin তাঁরওই ভাষায় জ্ঞান ছাড়াও সুফি দর্শনের সঙ্গে
বৈজ্ঞানিক বৈদান্তিক দর্শনের অসাধারণ সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দীর
প্রথমার্ধের ভারতবর্ষে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদানগুলির একটি
হিসেবে বিবেচিত হয়।৬
আমি রামমোহনকে প্রচলিত অর্থে মহাপুরুষ ধরি না। ১৮১৪ সালে কর্মজীবন থেকে
অবসর নিয়ে কলকাতায় ধর্মপ্রচার করার সময় তিনি জমিদার পিতার সাহায্য ছাড়াই বিত্তশালী
ব্যক্তি। আর তাঁর ধনোপার্জনের পথ সম্পর্কে বিতর্ক আছে। Martin Derrett তাঁর ‘A Juridical
Fabrication of Early British Empire’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘Indeed the sources of his wealth are known to
have been various, but we cannot accuse
him of any particular degreeof corruption in office, notwithstanding the
habits of the time.’৭ কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি কীরকম? ১৭৭২ বা ৭৪-এ রামমোহনের জন্মের সময় ভূমি ব্যবস্থায় পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল। ১৮৩৩ সালে তাঁর মৃত্যুর সময় চিরস্থায়ী
বন্দোবস্ত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। রামমোহন যখন প্রথমে কোম্পানির কলেক্টর Thomas Woodforde অধীনে ‘Writing Service’-এ মুনশির চাকুরিতে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে পদত্যাগ করার পর, রামগড়, ভাগলপুর, আর রংপুরে অন্য এক সিভিলিয়ান অফিসার John Digby-র অধীনে সেরেস্তাদার বা দেওয়ান হিসেবে কাজ করছেন, ঠিক সেই সময়েই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ বা
কায়েম হচ্ছে! আর এই সময় রামমোহন ইতিমধ্যেই সিভিলিয়ান অফিসারদের দেওয়া সুদের কারবারে বেশ জমজমাট! ১৯৯৭-তে Andrew Ramsey-কে ৭,৫০০ টাকা, ১৮০২
সালে Woodforde-কেই ৫,০০০ টাকা ধার দেওয়ার দলিল আছে।৮ কোম্পানির কাগজ ও শেয়ার কেনাবেচা চলছে তার সঙ্গে, সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে যে
তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন কোম্পানির কাজে, অর্থাৎ নিজের নামে কোম্পানির কাগজ কিনছেন।৯ এর সঙ্গে ১৭৯৯ সালে গোবিন্দপুরে এবং
রামেশ্বরপুরে দুটি তালুক ছাড়াও কয়েকবছর পরে আরো চারটি তালুক কিনেছেন। এগুলি তাঁকে প্রায় ১২,০০০ টাকার মুনাফা
যুগিয়েছে।১০ নিজের দপ্তরের অভিজ্ঞতা ও আভ্যন্তরিক জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নতুন আইনজ্ঞানহীন পুরনো জমিদারদের
সম্পত্তি লাটে ওঠার সময় আগে ভাগে খবর পেয়ে কম দামে কিনছেন। ‘monied purchasers of
estates sold during the upheavals surrounding the Permanent Settlement’।১১ Martin Derrett ঠিকই বলেছেন
একে ঠিক কোনো ‘বিশেষ মাত্রার
দুর্নীতি’ বলা যাবে না, এই সময়কার অভ্যাস যাই থাক’, কিন্তু একেবারে ঋষিসুলভও বোধহয় নয়! বহু
জায়গায় এসব বেশ চুনকাম করে লেখাও আছে।১২ তবে আরেকটি খবর একটু বোধহয় গোলমেলে। ১৭৯৬-৯৭ সালে উইলিয়াম কেরী এবং তন্ত্রগুরু হরিহরানন্দ বিদ্যাবাগীশের সঙ্গে
তিনি যে মহানির্বাণ তন্ত্র নামে এক প্রাচীন (?) ধর্মীয় গ্রন্থ আবিষ্কার (?)
করেন যার ‘এক সত্য ঈশ্বর’ বিষয়ক তত্ত্ব বাদে তার হিন্দু আইন বিষয়ক ধারাগুলি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সংক্রান্ত সম্পত্তি বিতর্কে ইংরিজি আদালতগুলিতে ব্যবহৃত
হতো, আর কিছু অর্থাগমেরও সুযোগ করে দিয়েছিল, অন্ততঃ যতদিন না ব্রিটিশ
ম্যাজিস্ট্রেটরা এর প্রামাণিকতা নিয়ে সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েন, আর হিন্দু আইনের উৎস হিসেবে এর ব্যাখ্যানের জন্য পণ্ডিতদের উপর নির্ভরতা
কমিয়ে দেন! আশ্চর্যজনকভাবে আদি ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃক প্রকাশিত ও একেবারে অপ্রথাগত ধরনের তন্ত্রটির প্রামাণ্যতা নিয়ে আর রামমোহনের
সঙ্গে তার যোগ নিয়ে সন্দেহ তন্ত্রশাস্ত্রের উপর গবেষণাতেও রয়েছে!১৩
কিন্তু ইতিমধ্যে বেশ
কিছু অর্থাগম হয়েছে, আর কুসীদের আয়ের সঙ্গে নতুন কেনা জমিদারিগুলির আয় যোগ ক’রে ১৮১৪ সালে কলকাতায় গ্রামীণ সম্পত্তিভোগী নতুন নাগরিক ভদ্রলোকশ্রেণির সদস্য হিসেবে নিজের আসল কাজ ধর্মসংস্কারে মন দিয়েছেন। তাঁর আত্মীয়সভা
(১৮২৮) প্রতিষ্ঠা, ব্রাহ্মধর্ম সৃষ্টিও সতীদাহ নিবারণের মতো সমাজ সংস্কারের দিন
সমাগত।
তো, বছর বিয়াল্লিশ আগে আমার এক রামমোহন-ভক্ত অল্পশিক্ষিত বৈবাহিক আত্মীয়কে
এসব বলায় তিনি তো ভীষণ চটে গেলেন! বললেন, ‘তাহলে তুমি নিজে রামমোহন
রামমোহন কর কেন! তুমি তো আর বেহ্ম নও (আমি ইতিমধ্যেই আবার রাগজনকভাবে ব্রাহ্মণ কিনা)! আমি বলেছিলাম, ওই মাপের জন্যে! যে বিশাল মাথায় দশটা ভাষার
ও তাদের প্রধান সাংস্কৃতিক সম্পদগুলি সম্বন্ধে জ্ঞান; কোম্পানির আইনও কোম্পানির
আমলে নতুন ব্যবসায়ের সুযোগ সুবিধার জ্ঞান, শেয়ার বিক্রি,
জমির ফাটকাবাজি, মহাজনী কারবার, বেদান্ত, উপনিষদ, নতুন ধর্ম
সংস্কার তথা ব্রাহ্মধর্ম সৃষ্টি, অসীম সংস্কৃত জ্ঞান আর ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির
আমলে আইনন্ত্রের বদলগুলির জ্ঞানের ভিত্তিতে একটা গোটাগুটি তন্ত্র নির্মাণের
ক্ষমতা, সতীদাহ নিবারণের জন্য বিদেশি রাষ্ট্রকে নিয়োজিত করার সাহস ও দূরদর্শিতা — সব ঢোকে; তার সঙ্গে থাকে ১৭ বছর বয়সে,
মানে আজকালকার প্লাস টু পড়া বয়সে, একা তিব্বতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একেশ্বরবাদ
প্রচার করার সাহস, তাকে আমি বলি ফেইনম্যানের কথায় ‘মনস্টার মাইন্ড্’, যার জন্যে আভূমি
প্রণত হওয়া যায়। তার সঙ্গে যদি যোগ করি নিজের বাবার সম্পত্তি বিকিয়ে যাওয়ার সময়ে তাঁকে ও
তাকে উদ্ধার না করার মানসিক দৃঢ়তা, আর একা একটা পাঁঠার পুরো
মাংস খেয়ে ওঠার মতো সক্ষম, জৈবনিক ক্ষুধা তাহলে যে মাপ তৈরি হয়, সেটা ওই রবীন্দ্রনাথের বলা অণুবীক্ষণ যন্ত্র ধরনের মহামানুষ, যার ফলে তাঁকে Vincent Smith বলেছেন,
‘the greatest creative personality of the nineteenth century India’!১৪ আমি তাঁর ‘মাপ’-ই মাপি, আর দেখি যে তিনি ওই দক্ষিণারঞ্জনের রাজকন্যের চেয়েও
অনেক বড়; অনেক অনেক বাইশ জোয়ান তেইশ জোয়ান, রাখাল, রাজকন্যে দিয়ে তাঁকে তোয়ের করেছেন সেই একমেবাদ্বিতীয়, যিনি এঁকে এঁর শত দোষ সত্ত্বেও
অভিশাপ দিতে ভয় পাবেন!
গ্রন্থসূত্র ও টীকা
1. Stephen Meredyth
Edwardes & Herbert Leonard Offley Garrett-এর Mughal
Rule In India (New Delhi: Atlantic Publishers, 1995),
p. 350.
2. Richard Feynman, Surely
You Are Not Joking Mr. Feynman (London: Unwin Paperbacks, 1986), 77-80.
3. Bertrand Russell, Legitimacy Versus
Industrialism 1814-1848 (London: Unwin, 1935/1965), p.103.
4.
Makarand R. Paranjape, Making India,
Colonialism, National Culture and the Afterlife of Indian English Authority (New Delhi:
Springer, 2013), p. 37.
5. J. C. Ghosh (ed.), The English Works of Raja Ram Mohan Roy
(Calcutta: Oriental Press, 1885), pp. iv-v.
6. Cromwell Crawford,
‘Raja Ram Mohan Roy’s Attitude toward Christians and Christianity’, in Arvind
Sharma (ed.),Neo-Hindu Views
of Christianity (Leiden, the Netherlands; New York: E. J. Brill, 1988), p. 16.
7. John Duncan Martin
Derrett,Essays in Classical and Modern Hindu Law, Vol. 2,
Consequences of the Intellectual Exchange with the Foreign Powers (The Nether
lands: Leiden Brill 1977), p. 169.
8. Brajendranath
Bandyopadhyay, Ramamohana Râya, Sahitya-sadhaka
caritamala, Vol. l, no.l6 5th edn.,
(Calcutta,Bangiya Sahitya Parishad), 1960, p. 18, 21; and Selections from official letters and
documents relating to the life of Raja Rammohun Roy, ed. by R. Chandra, and
J.K. Majumdar, 1935, p. xxxiv, xxxvi.
9.
He ‘employed
himself in dealing with Company’s name … or buy Company’s papers in his own
name’, Selections from official letters and documents, p. xxxvii.
10. Ramamohana Râya,p. 19;
Selections from official letters and documents, p. xxxv, and xxxix.
11. Barbara D. Metcalf,
Thomas R. Metcalf, A Concise History of Modern India, Third Edition
(Cambridge
[England]; New York: Cambridge University Press, 2012),p. 88.
12. Poonam Upadhyaya, Social,
Political, Economic and Educational Ideas or Raja Rammohun Roy (New Delhi: Mittal Publications, 1990), p. 113-14; Krishna Dutta, Calcutta: A Cultural
and Literary History (Oxford: Signal Books, 2003).
13. See Hugh B. Urban, Tantra:
Sex, Secrecy, Politics and Power in the Study of Religion (New Delhi: Motilal Banarsidass, 2008), pp. 63-72.
14. Vincent A Smith, The Oxford History Of India,
ed. Percival Spear, 3d. edition,
(Oxford: Clarendon Press, 1958), p. 733.