লিনপিয়াও
সমীর একটা শব্দ লিখেছে। লিনপিয়াও। অ্যান্টি লিনপিয়াও নামে আরো একটা শব্দ একটু পরে
লিখেছে। শব্দ দুটোর কোনোটারই মানে জানা নেই।
লিখেছে, মিলিটা দিন দিন লিনপিয়াও হয়ে যাচ্ছে।
মিলিকে আমার ভালো লাগে আবার লাগেও না। এর মানে কী জানি না। ভালোবাসার প্রথম ধাপে
এইসব প্রবলেম কারো কারো হয় বলে শুনেছি। মন নানা রকম দ্বন্দ্বে ভোগে। অনেক ধরনের খুচরো ইচ্ছে সামনে হাত ধরাধরি করে এসে
দাঁড়ায়। কিন্তু অপর পক্ষ কী মনে করবে ভেবে আবার নিজের খোলসে ঢুকে যাওয়া। বুনুকে
এখনি ফোন করা যেতে পারে। গাছ ঝাঁকিয়ে যে কটা শিউলি ঝরে পড়বে, আঁচল ভর্তি করে কুড়িয়ে নেওয়া শুধু। বুনু
ঠিক জানবে। আমরা রোজ কথা বলি। আমরা রোজ চুমু খাই। কিন্তু মুশকিল একটাই। কারণ আমরা
দুজনে আজও দুর্ভিক্ষ পীড়িত।
সুতরাং শিউলির সঙ্গে কয়েকশো মাল্টি ট্রিগারেরও সম্ভাবনা। কেননা
আবহে যখন তখন সাইক্লোনের সতর্কবাণী। আর এই বিপদকে নিজেরাই ঘরে ডেকে এনেছি। কী করে,
সে কথা পরে। আপাতত লিনপিয়াও-এর মানে খোঁজা খুব জরুরি। এর মানে কি বদলে যাওয়া? বা পাল্টে যাওয়া? প্রাথমিক
ধারণা অন্তত তাই বল। মনে হয় খারাপ কিছুই হবে, না হলে সমীরের আক্ষেপ এভাবে ফুটে
বেরোত না! শব্দটা চোখে আটকে গেছে।
করায়ত্ত না হওয়া অব্দি শান্তি নেই। কী করব? শব্দটা সমীরের কাছ থেকে চেয়ে নেব? দেবে
সমীর? না কি... চুরি করে নেব? খুব কি ক্ষতি হবে? অবশ্য আমি তো আর জিনিস চুরি করছি না।
অনেকে স্বভাববশত অন্যের জিনিস চুরি করে।
জিনিসপত্র চুরির ভালো নাম ক্লেপটোমনিয়া। ওদিকে আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। আমি চুরি
করব একটা শব্দ। শব্দচোরকে কী বলে?
ভিড়ে ঠাসা দোকানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি আর ভাবছি এসব। আামার টার্ন আসতে দেরি আছে। ওদিকে বুনুর অস্থির এস এম এস। আর কতক্ষণ
অপেক্ষা করব?
ছেলেটা বলল, দিদি চুরানব্বই টাকা খুচরো দিন। ভাঙানি
দিতে পারব না।
চুরানব্বই টাকায় একটা পাওয়ার কিনেছি আমি, এয়ারটেল টু এয়ারটেল। না কিনলে কথার দাম থাকছিল না।
সেনসেক্স কেবলই পড়ে যাচ্ছিল। এবার আর হবে না।
এটায় এখন থেকে প্রতি মিনিটে দশ পয়সা এবং এইরকম
পরপর একুশ দিন। এবারে মনের সুখে আরো পাপ করতে পারব। পাপকালীন যে সমস্ত শ্বাসকষ্ট, নিঃশ্বাসের
ওঠাপড়া, অক্সিজেনের কমতি; বুনুকে কাল বলেছিলাম রাতে সাড়ে দশটা বাজলে তবে ফোন করব। অনেক সময় নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে।
যেন কী কী কথা বলব, সব আমার নখের নিচে নেল আর্টের মতো জ্যামিতিক পদ্ধতিতে
পরপর সাজানো আছে! যেন লুকনো সেই শব্দগুলো সকলের অলক্ষ্যে বুনুকে চুপি চুপি পাঠিয়ে
দেওয়া। বুনু রাত জেগে অপেক্ষা করে। অফিসের টেবিলে অপেক্ষা করে। খুব তাড়াহুড়ো করে অলিগলি বেয়ে বাড়ি ফেরার সময় পিছু ডেকে
কেউ কিছু জিজ্ঞেসা করলে অকারণ বিরক্তি, কারণ বুনু বলে দিয়েছে ও নাকি কখনও সুখী ছিল
না।
অথচ ছেলেটা প্রশ্ন করছে, চুরানব্বই টাকা খুচরো নেই? না হলে কিন্তু পাওয়ারটা
অ্যাকটিভ করা যাবে না। কী করা যায়!
মোর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকলে এখুনি কিছু খুচরো
আমার হাতে চলে আসবে। সেই ভালো। ওখানে একমাত্র মুসুরি ডাল ছাড়া বাকি সব আইটেমই বাই ওয়ান
গেট ওয়ান। বেশ। ঠিক করলাম বাই ওয়ানটা
নিজের কাছে রেখে গেট ওয়ানটা হরিসভায় গিয়ে দান করে দিয়ে আসব। তাতে অনেক পরজন্ম পুনর্জন্ম প্রারব্ধ কর্ম উৎরে যাবে। আমারও, বুনুরও।
কিন্তু মোর ডিপার্টমেন্টে এসে আমার পা থেমে গেল।
কেউ নেই। তিনদিন বন্ধ থাকবে, জানতাম না। এদিকটা সচরাচর তেমন
আসিও না।
খুচরোর জন্য এখন তাহলে কোথায় যাই? দলের মিছিল অথবা
শান্তিনিকেতন? ধূস্! ওসব আমার কোনোটাই পোষাবে না। ইতিমধ্যে বুনুর আর একটা এস এম এস ঢুকে পড়েছে।
সৈকতভূমিতে ঢেউ আছড়ে পড়ার মতো। তবে মেসেজের তলানিতে সোনার চাবিটা রেখে দিয়েছে
ঠিকঠাক।
অসম্ভব রাগ হচ্ছে ছোঁড়াটার ওপর। এতবড় দোকান অথচ
খুচরো নেই! হয় এটা?
ভাই, চুরানব্বই টাকা খুচরো দিতে পারব না। হচ্ছে না।
তাহলে দিদি অন্য দোকান দেখুন। এখানে হবে না।
আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে ছেলেটা। এত আস্পর্ধা! কাস্টমারকে অসন্মান করছে? ইস্
মোবাইলে পাওয়ার অ্যাক্টিভেট না হলে সারারাত বুনুর সঙ্গে কথা বলব কী করে? ছটপট করতে
করতেই তো সকাল হয়ে যাবে। সেই আবার গিয়ে তখন খোঁয়াড়ে
ঢোকো। অবিশ্যি ডিউটির ফাঁকে ফোকরে একটু আধটু বইটই পড়ি আমি। লিনপিয়াও শব্দটা তখনই চোখে পড়েছে। কে জানে চোখের ভাষা বা হৃদয়ের ভাষার মতো লেখবার কোনো
আলাদা ভাষা আছে কি না! আলাদা ভাষা দিয়ে মানসিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। বিরক্তি বা
ক্রোধ জাতীয়। মানব শরীরে এর সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া। বুনু এসব বলতে পারবে। হতচ্ছাড়া দোকানদার ছেলেটার ওপর এখন বেদম রাগ
হচ্ছে। ওকে কী করে বোঝাই, মোবাইল ছাড়া আমি অন্ধ! বুনুর সঙ্গে রাতে কথা না বললে পাগল
পাগল লাগবে। কেমন যেন একটা জেদ চেপে
যাচ্ছে। মোবাইল সংক্রান্ত যে কোনো ব্যাপারেই আমি দারুণ স্পর্শকাতর। অপমানে মাথাটা
দপদপ করছে।
দিদি একটা ছোট ম্যাগীর প্যাকেট দিয়ে দেব? পাঁচটাকার। তাহলে আর খুচরোর ঝামেলা থাকবে না।
ম্যাগী? ঐটা এখনও বিক্রী করছ? নিষিদ্ধ হয়ে গেছে না?
দিদি ম্যাগী খেয়ে ক’টা লোক মরেছে দেখান তো? কিন্তু সিগেরেট খেয়ে বিগত দশ
বছরে অনেকেই মারা গেছে বা অসুখে ভুগছে। ওইটা আগে বন্ধ করুক!
বলতে বলতে ছেলেটা বাঁদিক ফিরে
ম্যাগীর প্যাকেট ছিঁড়তে যায় আর আমি কথা না বাড়িয়ে টেবিলের আধখোলা ড্র্য়ারটায় যেখানে
কুড়ি পঞ্চাশের কয়েকটা নোট অগোছালো পড়ে আছে, তড়িৎগতিতে হাত ঢুকিয়ে একটা বার করে
নিই। এবং মুহূর্তের মধ্যে আঙুলর চাপে দুমড়ে ছোট করে দিই।
চোখ কুঁচকে ছেলেটা বলে, একি! আপনি আমার ক্যাশ থেকে টাকা তুলছেন যে? প্রথমে
দেখে তো চোর বলে মনে হয়নি!
ছেলেটা চেঁচাতে শুরু করে।
আমি বুঝতে পারি, লিনপিয়াও-এর প্রতিক্রিয়া আমার
মধ্যেও শুরু হয়ে গেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন