ঢেউগুলি ছিল তার উড়ালি পাখা
নদীতে জোয়ার
আর উড়বার জন্য আকাশ, আকাশের নীল যন্ত্রণা, নীলের বিশালতা, বাতাসের প্রবহমানতা একসাথে জুড়ে দিলে
যে ক্ষীপ্র গতির বিমুগ্ধতা তৈরি হয়, আবুল হাসান যেন তাই। উড়ছেন, উড়ছেন লক্ষ্যে অলক্ষ্যে মুগ্ধতায় বিস্ময়ে অনুসন্ধিৎসায়। কখনো আটকে পড়েছেন সাংসারিক জটাজালে
কখনো জীবনের কঠিন পথে রক্তাক্ত করেছেন নিজেকে, হয়েছেন লক্ষ্যভ্রষ্ট। ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারার
যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত হয়েছে তাঁর হৃদয় প্রতি মুহূর্তে। অন্তর্গত চির স্বাধীনতাকামী গভীর বোধ, ছন্দময় ও গদ্যময় ভাবের প্রকাশ আর কঠিন বাস্তবতার দ্বন্ধময় জীবন পড়তে পড়তে তাঁর সমগ্র জীবনটাই আমার লেখনীতে এভাবেই
উঠে এলো -
“সে যেন ছিল এক উড়ন্ত নদী
কলকল তরঙ্গময়
ঢেউগুলি ছিল তার উড়ালি পাখা”।
আমি সাহিত্যের ছাত্রী। তবু যে কোনো লেখা আমাকে টানে না। প্রথম একটি শব্দ কিংবা বাক্য পড়বার
সাথে সাথে যদি ভালো লেগে যায়, আমি শুধু
তাতেই মন দিতে পারি। তাতে লোকসান
অনেক। পঠিত বিষয়গুলো সংখ্যার গুরুত্বে খুব
কমের দিকে থেকে যায় বরাবর। জ্ঞানের
পরিধিটুকু আর বিশালত্বের দরজায় পা রাখে না। এই লোকসানটুকু মেনে নিয়েই এক অদ্ভুত
পাঠোন্মাদনা আমার। এবং আবুল হাসান আমার অনেক লোকসানের
মাঝে একটুকরো লাভ। তাঁকে পড়বার সাথে
সাথে আমার ভালো লেগে যায়। আমি যেন অবগাহন করি অন্য আর এক
ঊর্ধ্বতর সত্ত্বায়।
“একসময় ইচ্ছে জাগে, মেষপালকের বেশে ঘুরি ফিরি
... ... ...
একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে যদি দিন যেত’’
(‘একসময় ইচ্ছে
জাগে এভাবেই’)
কবিতাটি পড়তে পড়তে আমার মনে হলো, আমার ভেতরেও
তো এরকম এক যাযাবরের বাস! কবিতাটির শুরু
আর শেষের লাইন দুটো আমি এখানে উল্লেখ করলাম। মাঝে আরো যা আছে তাতে আমার অনুভূতি
এমন যে, আমারও তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, এই সমাজ সংসার ধর্মের আর কর্মের যাবতীয় অসহযোগ শৃঙ্খল ভেঙে প্রথাগত নারী পুরুষের
সব সম্পর্কগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে যাযাবরের মতো, ইচ্ছেমতো দিনযাপন করি। উপড়ে ফেলি এই নিত্য দুঃসহবাস। জটিল জীবনের সব পঙ্কিলতাগুলোকে এক
নিমেষে উড়িয়ে দিয়ে ‘সহজ সত্যেরে
করি ধারণ’। অথচ তিনি পুরুষ আর আমি নারী। কিন্তু
মনের গোপনে অকারণ শৃঙ্খল যে কতটা উদাসীনতায় প্রতিপালিত প্রত্যেকটি যাপিত জীবনে, তার অনুভব নারীতে আর পুরুষে একই। কেউ স্বীকার করবেন আর কেউ হয়তো করবেন
না। একারণেই আমার কাছে আবুল হাসান অনন্য, তাঁর সৃষ্টি চিরায়ত শাশ্বত ক্লাসিক।
‘‘শুনেছি শাদা চামেলী নাকি চাঁপা এনে পরিয়ে
দিতেন রাত্রিবেলা মায়ের খোঁপায়’’ (‘চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ’), এ তো মনে হয় যেন আমার জীবনেরই অনেক অনেক দেখা ছবি। আমারই মায়ের
সাথে বাবার আচরণের এমনই একটি দিক আমি প্রায়ই ছোটবেলায় দেখেছি; শুধু চামেলী কিংবা চাঁপাতেই হয়তো একটা ক্ষীণ পার্থক্য শুধু।
আরো আরো যা
কিছু সব পড়ার সাথে সাথে ভালো লাগতে শুরু করে। তাঁর লেখা পড়ে আমি প্রথম ভাবতে শুরু
করি, এত সহজ করে কবিতা লেখা সম্ভব? তখন সাহিত্য
নিয়ে পড়ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২য় বর্ষ। ১৯৯৩ সাল। রবীন্দ্রনাথ আমার আজন্ম পাঠ। কবে প্রথম তাঁকে পড়েছিলাম, কবে প্রথম তাঁর গান গেয়েছিলাম আনুষ্ঠানিকভাবে, আজ আর মনে
পড়ে না। তারপর নজরুল সুকান্ত জীবনানন্দ শহীদ
কাদরী আল মাহমুদ শামসুর রাহমান নির্মলেন্দু গুণ সৈয়দ হক রফিক আজাদ। এবং তারও পর আমি প্রথম পড়ি আবুল
হাসান। যিনি বরাবর আমার মুগ্ধতার সীমানা
পেরিয়ে সবসময় রয়ে গেছেন অসীম সুন্দরতার মাঝে। তারপর গেছে অনেক সময়। কখনো খুব একলা নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোতে
আবুল হাসানের কবিতা ছিল আমার দারুণ বন্ধু। তাঁর কবিতা পড়া কিংবা আবৃত্তির মঞ্চে ‘‘মৃত্যু আমাকে নেবে জাতিসংঘ আমাকে নেবে না’’ অন্য কোনো আবৃত্তিকারের মুখে শোনা ছিল এক বিশেষ
আনন্দ। কিন্তু এত এত বছর পর আজ, আবার, যখন নতুন করে আবুল হাসান পড়তে বসলাম, ভাবলাম লিখব তাঁর কথা তাঁর লেখার কথা - তখন একজন সহজ সাধারণ পাঠকের
মনোবিশ্লেষণে এটাই মূর্ত হয়ে উঠল কেবল – তিনি ছিলেন রিক্ত তিনি ছিলেন নিঃস্ব। তিনি ছিলেন দায়িত্বের
ভারে ভারাক্রান্ত। আবার তিনি ছিলেন অসাধারণ জীবন বোধে
ঐশ্বর্যবান। কখানো প্রেম কখনো ছলনা, কখনো অপ্রাপ্তি কখনো অসুস্থতা - নিয়তির নিষ্ঠুরতা তাঁকে করে তুলেছিল প্রচন্ড অভিমানী। প্রখর রোমান্স ব্যপ্ত তাঁর জীববোধে আর
জীবনযাপনে। তিনি যেন ব্যাপক ভাব আর আবেগের সুবিশাল বিস্তৃত পথপ্রান্তর। সেই পথপ্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা নুড়ি পাথর
আর মনিমাণিক্য ঋদ্ধ করে রেখেছে বাংলা সাহিত্যের পট। তাঁর রচনা পাঠে পাঠকের মন ভরে উঠেছে
দূরন্ত সাবলিমিশনে। এর কোনো শেষ নেই। এর কোনো শুরুও নেই। আবুল হাসানের লেখা কবিতাগুলোকে খুব
কঠিনতর সাহিত্যের (ব্যাকরণসুলভ) বিশ্লেষণে আমি আগ্রহী নই। বলা যায় কবিতার কঠিনতর বিশ্লেষণের চেয়ে পাঠকের জায়গা
থেকে সুখপাঠের অভিজ্ঞতাটুকুই লিখতে চাইছি এখানে। শুধুই সুখপাঠ কেন? তার ব্যাখ্যাটাও দেওয়া প্রয়োজন। যা কিছু সৃষ্টি, তা শুনে দেখে কিংবা পড়ে যতই দুঃখ হোক মনের ভেতর, যখন এক অদ্ভুত সংরাগ তৈরি হয়, তখনই তা শিল্প হয়ে ওঠে। বুঝি, আর নাই বুঝি! জীবনের কঠিন সত্য যা আমাদের নিয়ত
কাঁদায় যন্ত্রণা দেয় জীবনযাপন প্রতিনিয়ত জটিল করে তোলে, তা অবিকল তুলে আনলে তা আর সাহিত্য
কিংবা শিল্প থাকে না। এরিষ্টটলের ভাষায়, ‘‘Literature is the reflection of life’’। সাহিত্য জীবনের নকল, কিন্তু অবিকল
রূপায়ণ নয়। জীবনের গভীর বেদনা অসীম অপ্রাপ্তি
গভীর ক্ষরণ প্রত্যন্ত দহন আর বিস্তৃত একাকিত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে যখন এক
উন্মার্গ আধ্যাত্মিকতায় রূপলব্ধ হয়, তখনই কেবল তা
শিল্পের স্তরে উঠে আসে। পাঠকের কাছে
আদরনীয় হয়ে ওঠে। আমার কাছে আবুল হাসান সেই আধ্যাত্মিক
যিনি প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের বোধের প্রয়োজনের সবচেয়ে অখন্ডনীয় আর সবচেয়ে
ক্ষুদ্রতম স্থানটিতে বিরাজ করেন সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সময়ে। আর তাই তিনি দেশ কাল সময়ের সংকীর্ণতা
ছাড়িয়ে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েন সুবিশাল আন্তর্জাতিকতায়। তাঁর একটি বাক্যে তিনি মিশে যান ইথিয়পিয়া থেকে বাংলাদেশের সব ক্ষুধার্ত মানুষের মনে দেহে
শরীরে আর যন্ত্রণায় –
“শুধু আমি জানি
আমি একটি মানুষ
আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা”
একেবারে নিজের জীবন থেকে শুরু করে
পৃথিবীর যে কোনো ব্যক্তি মানুষের মৌলিক অধিকার
প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অব্যবস্থা কিংবা বিশৃঙ্খলতা কিংবা অপারগতা কিংবা উদাসীনতা যাই
বলা হোক না কেন, তিনি বলে গেছেন একটি মাত্র বাক্যে আর
করেছেন যাবতীয় সাম্রাজ্যবাদের মূলে কুঠারাঘাত।
চামেলী ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন
একজন নিম্নমানের মানুষ। কী অদ্ভুত
সুন্দর করে বাস্তবতার কাঠিন্য চিত্রায়ণ করেছেন সহজ স্বাভাবিক শব্দে ভাষায়। কী অপরূপ তাঁর ভঙ্গি। ‘‘চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ’’- বাংলাদেশের যে কোনো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সাদামাটা মানুষের স্বপ্ন আর বাস্তবতার, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির দ্বান্দ্বিক চিত্রায়ণ। অসাধারণ নামকরণ। নামটি পড়ার সাথে সাথে একটি সাধারণ চিত্রকল্প দৃশ্যায়িত হয় যে কারো মনে। আমি নিজের মানসপটে দেখেতে পাই, আমারই বাবা একগুচ্ছ ফুল হাতে ব্যর্থ লজ্জিত অধোবদনে একা দাঁড়িয়ে আছেন জীবনের একধারে, অসহায়। একজন সাধারণ মানুষ যিনি নিজেকে বিশেষ
কেউ মনে করেন না। চাকরবাকর আর প্রভু এই সম্পর্কের
দূরত্ব মানেন না। নিজের পদাধিকার বলে নানা সুবিধা আদায়
করেন না। নানা সুবিধা আদায় না করার কারণে সংসারে প্রাচুর্যের অভাব থাকে। কিন্তু সুন্দর এক প্রেমিক মন নিয়ে বাড়ি ফেরেন স্ত্রীর
জন্য চামেলী ফুল নিয়ে। নিজ হাতে
পড়িয়ে দেন স্ত্রীর খোঁপায়। স্ত্রী তাতে সুখী নন। ছেলেরাও মানুষ নয়। যার যার স্বার্থ নিয়ে সরে দাঁড়ায়
বাবার পাশ থেকে। রাত জেগে একা বসে থাকেন একজন ব্যর্থ মানুষ। আবুল হাসানের শব্দে বাক্যে চিত্রায়িত
এই যে একজন বাবা একজন ব্যর্থ মানুষ তা বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে বাস করা এক একজন
সৎ মানুষের নিরাভরণ সত্য রূপ। তাই তাঁর লেখা
ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার সীমা অতিক্রম করে হয়ে ওঠে সার্বজনীন। কবিতারও সীমা অতিক্রম করে হয়ে ওঠে যাপিত
জীবন ও সময়ের সত্য তথ্যচিত্র।
তাঁর কবিতায় নারীপ্রেম নারীপ্রকৃতি
নারীবিরহ নারীএকাকিত্ব নারীআশ্রয় নারীপ্রশ্রয় নারীহতাশা নারীক্রোধ নারী সর্বব্যাপী
এক অসম ক্ষুধা। যে মুহূর্তে নারীর কাছে নিজেকে সমর্পণ
করছেন পর মুহূর্তেই ম্রিয়মান হয়ে গলে পড়ছেন গভীর অন্ধকারে। দারুণ সুন্দর প্রেমানুভূতি নিয়ে প্রেমিকার
অন্তরবাহ্য বর্ণনার পাশেই থাকছে তাতে বিলীন হতে না পারার গভীর বেদনা। গভীর ভালোবাসা প্রকৃতির রূপ আর
প্রেমিকার প্রলুব্ধ সুন্দরতা বর্ণনার পাশেই বাস করে এক গভীর শূন্যতার নিকষ ঘ্রাণ, নির্মম আঘ্রাণ। বোঝা যায় যখন গোলাপের নিচে নিহত কবি কিশোর কবিতায় লিখছেন ‘‘জোৎস্নায় ফেরা জাগুয়ার চাঁদ দাঁতে
ফালা ফালা করেছে আমারও প্রেমিক হৃদয়!’’ বোঝা যায়, ‘অপরিচিত’তে একই কবিতায় শেষ দুটি লাইনে দু’বার করে যখন লিখছেন-
“অসীমা যখন তার অত নীল চোখের ভেতর
ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর
সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত
আমার কেবলই রাত হয়ে যায়”।
আমার চোখে, নারীর চরিত্র বর্ণনায় অসাধারণ শব্দ সংযোগ তাঁর কবিতাকে দারুণ মাত্রায় উন্নীত করেছে বরাবর। যখন আলাওল পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনায়
বাস্তব থেকে সুন্দরতা আশ্রয় করেন, রবীন্দ্রনাথ যখন হরিণের চোখের সাথে
নারীর চোখের সুন্দরতা মেলান, যে কোনো লেখক যখন প্রেমিকার ঠোঁটের উপমা দেন
কমলার কোয়া, নাকের উপমা দেন টিয়াপাখি, মুখের উপমা দেন পানপাতা, তখন আবুল হাসান বিশেষ্যের পরিবর্তে বিশেষণ ব্যবহারেরই চমক তৈরি করেন। আমার কাছে মনে হয়েছে চোখের উপমা কি
পাখির বাসা না পদ্মপুকুর প্রিয়ার মুখ, সে কি পানপাতা নাকি চাঁদ তা পাঠকই
বুঝে নিক। এমনই এক উদাসীনতায় তিনি লেখেন-
‘‘অতো বড় চোখ নিয়ে, অত বড় খোঁপা নিয়ে
অতো বড় দীর্ঘশ্বাস বুকের নিঃশ্বাস
নিয়ে
যত তুমি মেলে দাও কোমরের কোমল সারশ’’
(‘প্রেমিকের
প্রতিদ্বন্দ্বী’)
কখনো প্রবল প্রেমে নিকট করেছেন দূরকে।
কখনো আবার প্রেমে ছলনার জালে প্রতারণায় ক্লান্তিতে হয়েছেন পর্যূদস্ত। একজন সাধারণ প্রেমিক পুরুষের
অভিমান তাড়িত হয়ে যখন লিখেছেন-
‘‘আমি ফিরব না আর, আমি কোনোদিন
কারো প্রেমিক হবো না।’’
আবুল হাসানের
কবিতায় নারী এসেছে প্রকৃতির সাথে ছলনার সাথে। কখনো জীবনের প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্ণায়। কখনো প্রখর পরাজয়ে। কখনো যাবতীয় জটিল ক্রোধে আশ্রয় করেছেন
নারী কিংবা নারীর শরীর। পিপাসায় গেছেন
নারীর কাছে, দিকভ্রান্তিতে ফিরে গেছেন নারীর কাছে, প্রেমে ফিরেছেন নারীর কাছে, প্রাপ্তিতে নারীর কাছে। কখনো আবার প্রেমহীনতায় দ্বারস্থ হয়েছেন নারীর আর তারই সাবলীল
স্বীকারোক্তি কবিতার শব্দে শব্দে বাক্যে মর্মরিত হয়েছে। প্রকট করে তুলেছে এক জটিল কাব্য
প্রণালী। এই জটিলতায় বারবার হয়েছেন দিকভ্রান্ত। বাস করেছেন দ্বন্দ্বে দোলাচলে। যখন একই কবিতায় (‘একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই’) লিখছেন–
‘‘নারী, আমি মহুয়া বনের এই সুন্দর সন্ধ্যায়
পাপী
তোমার নিকটে
নত’’
আবার পরক্ষণেই লিখছেন–
“তোমার তৃষ্ণার নিচে নিভৃতের জোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসেছি
আদিম আজ
এখন আমার কোন পাপ নেই
পরাজয় নেই।’’
নারী পুরুষের
অযাচিত সম্পর্কে তাঁর কবিতা বার বার হয়েছে দ্বিধান্বিত। এ কি পাপ, না প্রেম! প্রেম, নাকি তাড়না! ধর্ম, না কি অধর্ম! অধর্ম, নাকি প্রেম! প্রেম আর নৈতিকতা বোধ, নারীর শরীর আর নারীপ্রেম এই দুই এর মাঝখানে দোদুল্যমানতা তাঁর কাব্য জীবনের এক
নিরাভরণ প্রবহমানতা। অবশেষে স্বীকার করেছেন-
‘‘আমিও আমার প্রেমহীনতায় গণিকার কাছে ক্লান্তি সঁপেছি
বাঘিনীর মুখে চুমু খেয়ে আমি বলেছি
আমাকে উদ্ধার দাও’’
(‘গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর’)
আবার একই কবিতায় লিখেছেন- ‘‘আমারও ভ্রমণ পিপাসা আমাকে নারীর নাভিতে ঘুরিয়ে মেরেছে’’
আবুল হাসানের জীবনের কথা যদি বলি, কী তিনি
চেয়েছিলেন, কী তিনি হতে চেয়েছিলেন, কী তিনি করতে
চেয়েছিলেন, কী তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন, তিনি নিজেই কি জানতেন? তিনি কি লেখক কিংবা কবিই হতে
চেয়েছিলেন? লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। টাকার
অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করতে না পারলেও লেখালেখির সুযোগ হয়েছিল নানা
পত্রিকায়। তবু ছেড়ে গেছেন বরাবর এক থেকে অন্যে।
কিন্তু জীবনের সময়টা তাঁর ছিল বড়
অল্প। সেই যে বাবার চরিত্র এঁকেছিলেন, একজন দরিদ্র নিম্নমানের মানুষ যাঁর হাতে একগুচ্ছ চামেলী ফুল তাঁর মায়ের জন্য ভালোবাসা স্বরূপ। আবুল হাসান
নিজেও বুঝি তাই। তাঁর বাবার চরিত্রটি পড়তে পড়তে পাঠক আমাদের সমাজের তথাকথিত সামাজিক শ্রেণীভেদের পারস্পেক্টিভে
দেখতে পায় একজন নিম্নমানের মানুষকে ঠিকই, কিন্তু সেই মানুষটি ভেদ করে পাঠকের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে আরো আরো অনেক উঁচু তলার একজন প্রেমিক পুরুষ একজন
সৎ বাবা আর একজন আমূল সংস্কৃতিবান উদার জীবনযোদ্ধার ছবি। যদিও আবুল হাসান শেষে ডেকেছেন বাবাকে
ব্যর্থ মানুষ বলে। অন্যদিকে আবুল হাসানের হাতে ছিল কবিতা, হৃদয়ে সৃষ্টির উন্মাদনা আর মস্তিস্কে ছিল প্রখর শাণিত বোধ। তাঁর রোগাক্রান্ত হৃৎপিন্ডে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল
বেদনার অশেষ প্রাপ্তি। জীবনের নানা অপ্রাপ্তি তাকে নিয়ে গেছিল এক অধরা প্রাপ্তির
বোধে। বুকে অসহ্য ব্যথা নিয়ে হসপিটালের বেডে
শুয়ে লিখেছিলেন-
‘‘ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহে যাও, ভিতরে বিষের বালি, মুখ গুজে মুক্ত ফলাও’’
(‘ঝিনুক নীরবে
সহো’)
তিনি তখন ভীষণ রোগাক্রান্ত। তাঁর
অসুস্থ হৃৎপিন্ডটি দিন দিন কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে
সেই যাতনা – তিনি নিজেই বুঝি ঝিনুক, আর হৃৎপিন্ডের অসুখটিই বুঝি বিষের থলি, মাথায় ছোট ভাই বোনদের দায়িত্ব সঠিক মতো পালন করতে পারছেন না তার যাতনা, মাথায় আর মনে অসংখ্য সৃষ্টির তাড়না, কিন্তু পেরে উঠছেন না শরীরের সাথে হৃৎপিন্ডের সাথে এই অবস্থায় মুখ বুজে
নীরবে সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কী করবার আছে তাঁর? আর একটি অন্তর্নিহিত বিষয়ও আমি
উপলব্ধি করেছি কবিতাটির মধ্যে। দিনরাত
ঘর্মক্লান্ত যে শ্রমিক মাটির নিচে খোদাই করে
তুলে আনে মুক্তো, তারা কি পায় এই মুক্তোর একটি দানা? এই শ্রমিকটি কি কোনোদিন সমর্থ হয় তার প্রিয়তমার কন্ঠে পরানোর মণি মাণিক্যের হার? অথচ সমাজের উঁচু তলার মানুষ কতই না সহজে হস্তগত করতে পারে
শ্রমিকের ঘর্মক্লান্ত অমানুষিক শ্রমে আরাধ্য রত্ন। কী করবে শ্রমিক? নীরবে সহ্য করে যাওয়া ছাড়া? এই কবিতাটি নিজস্ব ব্যক্তি মানুষের অন্তর্গত নিরুপায় যাতনা আর
দহনের ছবি এবং সমাজের নিম্ন বর্ণের মানুষের শ্রম ঘামের বিনিময়ে উপরে উঠতে থাকা
মানুষের আস্ফালন নীরবে সয়ে যাওয়া, উভয়বিধ যন্ত্রণার এক সবিশেষ
শব্দপ্রতিকৃতি। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ প্রজ্ঞার
প্রতিরূপ তাঁর এই সৃষ্টি। ব্যক্তিগত
যন্ত্রণার সাথে শ্রেণীভেদের যাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ কিংবা নিম্নবর্ণের মানুষের যন্ত্রণার এক চমৎকার ব্লেন্ডিং।
শব্দে শব্দে অদ্ভুত সুন্দর সব ইমেজ
তাঁর কবিতার বিশেষ অলঙ্কার। যা দারুণ সব চিত্রকল্প নিয়ে অস্থির বোধের সাথে নিয়ত যুদ্ধে লিপ্ত থাকে আমার পাঠক মনে। ‘গোলাপের নিচে নিহত হে কবি কিশোর’ কবিতায় যখন লিখছেন, ‘‘বাঘিনীর মুখে চুমু খেয়ে আমি বলেছি আমাকে উদ্ধার দাও’’ কিংবা ‘‘সক্রেটিসের হেমলক আমি মাথার খুলিতে ঢেলে তবে পান করেছি মৃত্যু হে কবি কিশোর’’ অথবা ‘‘অভিমানে আমি অভিমানে তাই চক্ষু উপড়ে
চড়ুইয়ের মতো মানুষের পাশে ঝরিয়েছি শাদা শুভ্র পালক’’। এই লাইনগুলো পড়ছি আর চোখে দেখছি একটি চড়ুই, চড়ুই নাকি আমি আমি নাকি কবি
নিজেই উপড়ে ফেলছেন নিজের চোখ, অসহ্য যাতনা তখন শরীর কিংবা চোখে নয় হৃদয়ে মগজে মস্তিস্কে। কী দারুণ অভিমানে নিজের চোখ উপড়ে ফেলছে যে মানুষ তার হৃদয় তখন খুব খুবই নিরীহ এক পাখি চড়ু্ই-এর মতোই নিষ্পাপ অপলক ছড়িয়ে যাচ্ছে শাদা পালকের
শান্তি। নিজেকে রিক্ত করে রক্তাক্ত করে শান্তির পালক ছড়াচ্ছে যে মানুষ সে আসলে চড়ুই-এর মতোই ক্ষুদ্র আর নিরীহ। নিজস্ব যন্ত্রণার এমন দুঃসহ দারুণ ছবি আমি আবুল হাসানের কবিতা পড়তে
পড়তে বহুবার দেখেছি আর রক্তাক্ত হয়েছি একা একা। সক্রেটিসকে হেমলক গাছের বিষ দিয়ে পান
করতে বলা হয়েছিল। নিজের হাতে বিষ পান করে আত্মহত্যা
করতে বাধ্য করা হয়েছিল তাঁকে। ছোটবেলায় যখন
প্রথম এই ইতিহাসটি পড়েছিলাম তখন থেকেই সক্রেটিসের নাম শুনলেই আমি দেখতে পেতাম এক প্রগাঢ় প্রজ্ঞাবান স্থির অচঞ্চল
বসে আছেন হেমলকের পাত্র হাতে। এ আমার
মনচ্ছবি। মনের কোণে ঐ ছবিটিতে যে প্রাজ্ঞ, তাঁর কোনো দ্বিধা নেই। শান্ত সমাহিত এক প্রজ্ঞাবান হয়ে ভেসে
আছেন গত ২৫ বছর আমার মনে। যখন আবুল
হাসানে পড়ি সেই বিষ তিনি নিজেই ঢেলেছেন নিজের খুলিতে আর মৃত্যুকে করেছেন পান, তখন শান্ত স্থির সক্রেটিসের ছবিটা আয়নার মতো ভেঙে পড়ে। আয়না ভেঙে
গেলে যেমন শত টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আর প্রতিটি টুকরোতেই এক একটি স্বতন্ত্র ছবি ফুটে
ফুটে অসংখ্য পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরি হয়, ঠিক তেমনি আবুল হাসানের যন্ত্রণাগুলো
আমার কাছে অসংখ্য যন্ত্রণার মাল্টিপ্লাই হয়ে অনবরত ধরা দিতে থাকে। যা তাঁর কবিতাকে নিয়ে যায় অসীমে – ইনফিনিটিতে – সাবলাইমে। কিন্তু আসলেই কি তিনি মানুষের জন্য ঝরাতে পেরেছেন শুভ্র পালক! তাঁর শহীদ স্বপ্নেরা কি পেরেছে তার
আত্মার নিরন্তর কান্নাকে ধারণ করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে শান্তির বাণী! বলতে কি পেরেছে বুকে হাত দিয়ে তাঁরই কবিতার কথা তাঁরই প্রশ্নের
উত্তরে - ‘ভালো আছি, খুব ভালো আছি।’’
‘গোলাপের নিচে নিহত হে কবি কিশোর’ কবিতাটিকে আমার মনে হয়েছে কবির ভেতরে কবিরই অবগাহন। ‘কবি কিশোর’ বোধকরি তাঁর জীবনের ক্ষণকালের কাব্যসৃষ্টির ভ্রমণটিকেই বুঝিয়েছিলেন। যখন তিনি লিখছেন ‘‘হে কবি কিশোর নিহত ভাবুক’’ আমার মনে হয়েছে তিনি তো জানতেন তাঁর
হত হৃৎপিন্ডটির কথা। ১৯৭০ সালে প্রথম হৃৎপিন্ডের রোগটি ধরা পড়ে। ১৯৭৪ সালে
আবার অসুস্থ হলে ভালো হবার কোনো লক্ষণ দেখা
যায় না। তাহলে! ক্ষণকালস্থিত
জীবনোপলব্ধি তাঁর কি তখনই এসে গেছিল? যে কবিজীবন / লেখকজীবন তিনি
শুরু করেছেন সেটির তখন সবে কৈশোর। প্রথম
কাব্যগ্রন্থ ‘রাজা যায় রাজা আসে’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। যদি একেই ধরি
লেখক জীবনধারার শৈশবকাল, তারই দু’বছর পর ১৯৭৪এ প্রকাশিত হয় দ্বিতীয়
কাব্যগ্রন্থ ‘যে তুমি হরণ করো’কে ধরাই যায় কৈশোরকাল। জীবনের হিসেবে তিনি তখন মাত্র ২৭
বছরের তরুণ। কিন্ত লেখকজীবনের কৈশোর সবে। তবে কি
কিশোর কালেই সমাপ্ত হয়ে যাবে তাঁর লেখকজীবন, সেটাই তিনি আসলে টের পেয়ে গেছিলেন! হয়তো পেয়েছিলেন, হয়তো নয়। কিন্তু আমি পাঠক যখন পড়ছি-
‘‘তবু এর কিছুই তোমাকে দেবো না ভাবুক তুমি সেরে ওঠো
তুমি সেরে ওঠো তোমার পথেই আমাদের পথে
কখনও এসো না
আমাদের পথ
ভীষণ ব্যর্থ আমাদের পথ”
তখন আমার মনে
হয় তিনি জেনে গেছিলেন যে, মৃত্যু ঘনিয়ে
আসছে। তাই নিজের কবিজীবনের কিশোর সময়ে লেখনী
থেমে যাবার আগাম সঙ্কেত যেন এই “নিহত কবি
কিশোর” বাক্যটি আর এই কবি কিশোরটি তিনি
নিজেই। একই সাথে তিনি আলাদা করে দিচ্ছেন তাঁর ২৭ বছরের শরীরধারী ব্যক্তিমানুষটিকে। নিজের ভেতর ভাবুক কবির জন্য নিজেরই
প্রার্থনা তাঁর ‘‘ভাবুক তুমি সেরে ওঠো’’।
চির নিত্য অবনতি, শারীরিক যন্ত্রণা, প্রত্যাশার অপূর্ণ ব্যপ্তি, জটিল জীবন যাপন প্রণালী, অপর্যাপ্ত অর্থ, প্রেমে পরিপূর্ণতা না পাওয়া, ইচ্ছে অনিচ্ছের অসহ অবস্থান, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা - এইসবই ছিল তাঁর জীবনের ঢেউ। এর সবই পূর্ণতা পেয়েছিল তাঁর কাব্যভাবনায় কাব্যভাষায় আর দারুণ সব চিত্রকল্প তৈরির অসাধারণত্বে যা পাখার ক্ষিপ্রতায় তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে গেছিল ভাব প্রকাশের এক অনির্বচনীয় মাধ্যমে। যত যত না পাওয়া তার সবই উড়ালী পাখায় ভর করে উড়ে বেরিয়েছে আবুল হাসানের কবিতায়। সেই যন্ত্রণাগুলোই নদীর কলকল তরঙ্গের মতো অদ্ভুত দুঃখের একটি বেণু যেন বাজিয়ে যাচ্ছে চিরদিন। সেই বেদনার সুরটিই পাঠকের মনোবেদনায়
আপ্লুত হয়ে পেয়ে যাচ্ছে এক ঊর্ধ্বতর সত্ত্বা।
যা কিছু ছিল
আবুল হাসানের বিরল, যা কিছু প্রখর তাঁর প্রখরতা এ পৃথিবী
খুব বেশিদিন ধারণ করতে পারল না। বড় বেশি অযাচিতভাবে তাই ঝরে পড়ে গেল এইমাত্র
উন্মীলিত নতুন আনন্দে উদ্ভাসিত কিশোর গাছটি। যা বেঁচে থাকলে হয়তো বিশাল বট বৃক্ষের
মতো ছড়াত ডালপালা, গভীর শেকড়ে ধরে রাখত চারপাশের মাটি আর তার ছায়ায় হতো চির শান্তিরও প্রতিষ্ঠা। স্বভাব কবিদের মতো ক্ষিপ্র গতি সম্পন্ন ছিলেন আবুল হাসান। দ্রুততম
সময়ে যখন তখন লিখতে পারতেন অসাধারণ কবিতা। কিন্তু নিয়তি ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তাই তিনি জীবনের হিসেবে যত না
স্বল্পায়ু তার চেয়ে বেশি ‘ক্ষণজন্মা’ সাহিত্যের ইতিহাসে। তাঁর মৃত্যুর পরে যা কিছু প্রাপ্তি আর
পুরস্কার, তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় সেগুলো
প্রাপ্ত হলে হয়তো বা আরও কিছুদিন দীর্ঘায়িত হতো তাঁর জীবন, অসুস্থ হৃৎপিন্ডটি পেত আরো একটু যত্ন আর
চিকিৎসা। বাংলা সাহিত্য পেত আরো কত যে কিছু অসাধারণ
সাহিত্যকণা! আমার শুধু এইটুকু মনোযাতনা কেবলই
প্রলম্বিত হতে থাকে, যতবার পড়ছি
তাঁর কথা তাঁর কবিতা, আরও আরও যা কিছু - সব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন