কাঁথা
সাঁইত্রিশ বছর ধরে সুখে দুখে একসাথে, অথচ আজ সব কেমন অলীক মনে হচ্ছে।
মেয়েটা কে?
শ্বশুরমশাই নিয়ে এসেছিলেন ঘরে। বুক ভেঙ্গে
কাঁদছিল রাস্তায়। স্বামী ছেড়ে গেছে ওকে। বাচ্চাটা কারও বুদ্ধিতে গীর্জায় দিয়ে এসেছিল মাস খানেক আগে;
সর্বসত্ত্ব ত্যাগ করে। ইট ভাঙ্গার কাজ জুটে গেল
শহরে। দুপুর রোদে হাতুরির তালে মনের ভেতর হঠাৎ উথাল পাথাল; দুধের বাচ্চাটা কেমন আছে কে জানে!
সর্দারের কাছ থেকে টাকাটা গুনেই গিয়েছিল দেখতে। হাতে পায়ে ধরে ফিরিয়ে নেবে বুকের
ধনকে। গিয়ে শোনে বাচ্চাটা নেই ওখানে। দত্তক নিয়েছে কোনো ভিনদেশী।
লোকজন দেখছিল নির্বিকার। শ্বশুর মশাইয়ের কী মনে হলো, নিয়ে এলেন বাড়িতে।
শাশুড়িমা চেঁচাচ্ছিলেনঃ
- কবে আক্কেল হবে তোমার? জাতকূল
বাদ দিলাম, চোর ডাকাতের বংশ কিনা সেই খোঁজেরও দরকার নেই?
দিব্যেন্দু তো পারলে মেয়েটাকে
চোখ দিয়েই ভস্ম করে দেয়। অসন্তোষের মেঘ তাঁর মনেও জমেছিল কিন্তু তুড়িতে মিলিয়েও গিয়েছিল। অমন উদোল রাস্তায় কত বিপদ। যথার্থ কাজটাই করেছেন শ্বশুরমশাই।
মেয়েটার জায়গা হয়েছিল কোণের
ঘরে। স্টোর রুমে। বাড়ির কাজে হাত লাগাতো সু্যোগ পেলেই। শাশুড়িমা দেখলেই হিসহিসিয়ে উঠতেনঃ
-কবে যে দূর হবে!
না, ওকে দূর করতে হয়নি। উল্টে মাস না পেরোতে মা-ছেলে দুজনেই চলে গিয়েছিলেন অনন্তলোকে।
কাওয়াসাকি মোটর সাইকেলটার কিচ্ছু
হয়নি, শুধু সওয়ারীর মাথাটা থেঁতলে গিয়েছিল। খাটের হাতল ধরে চুপচাপ ছেলের মৃত্যুসংবাদ
শুনেছিলেন শাশুড়িমা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন একভাবে, তারপর ঢলে পড়েছিলেন বিছানায়। কোমাতেই ছিলেন। দিব্যেন্দুর শ্রাদ্ধের চারদিন পরে চলে গেলেন।
ওর ‘আম্বিয়ার মা’ নামটা এই
সময়েই পোক্ত হলো। বাচ্চারা ডাকতো ‘আম্বিয়ার মা মাসি’। নিজেই শিখিয়েছিল। আম্বিয়া কে, জানতে চায়নি কেউ।
চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তাঁর ব্যস্ত সময় হঠাৎ
বিষণ্ণতার জগদ্দল পাথর হয়ে জমে বসছিল। সেই সময়েই কাঁথা নিয়ে নিরীক্ষা শুরু। শ্বশুরমশাই ততদিনে দেহ
রেখেছেন। ছেলে মেয়ের স্থায়ী ঠিকানাও পাল্টে গেছে।
শুরুতে এমনিতেই সূচ সুতোয়
ফুলকারী নকশা করতেন। একদিন দুপুরে সবে একটা কাঁথায় তালি মারা শেষ করেছেন, হঠাৎ দেখলেন আস্ত একটা গল্প ঘুরে
বেড়াচ্ছে শাড়ির বিরান জমিনে। সেই শুরু।
একদিন আম্বিয়ার মা’কে ডেকে সুতোর
ফোঁড় তোলা শেখালেন। অদ্ভুত শেখার ক্ষমতা! চট করে ধরে ফেলল
সুঁইসুতোর খেলা। কিন্তু সুতোর রঙ নিয়ে প্রায়ই লেগে যেত। একদিন তো সেলাই ছেড়েই উঠে গেল! নকশাটা অনেক খেটে দাঁড়
করিয়েছিলেন। কাজ শুরুর আগে সবে ঝাঁপি থেকে সুতো বার করছেন, অমনি বলে উঠলঃ
- এই রঙ দিয়া বুনলে কিসুই
অইবো না।
- মাতব্বরী করিস না তো!
নাকের পাটা ফুলিয়ে দুম করে
উঠে গিয়েছিল। উনিও গজ গজ করে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন একাই। কিছুটা নকশা তুলে দেখলেন, সত্যি কিছুতেই ফুটছে না।
অতঃপর হার মানতেই হলো।
- চল সুতো কিনে আনি।
- হুদাই ঘাউরামিটা করলেন।
ও ঝাঁঝ ফলাতে ভুলল না।
কী অদ্ভুত! সেই কাঁথাটাই তাঁর
জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
খোকার এক সাংবাদিক বন্ধুর
নজরে এলো কাঁথাটা। রাতারাতিই সেলিব্রেটি বনে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন কাগজে প্রতিবেদন, টিভিতে সাক্ষাৎকার। আম্বিয়ার মা’র
নাম কোত্থাও বলেননি। ডিজাইন তো
তারই, রঙে কী আর যায় আসে! নিজেকে নিজে স্তোক দিয়েছিলেন।
জার্মান এ্যাম্বেসি থেকে আমন্ত্রণটা পেলেন হঠাৎ। যেতে হবে মিউনিখ। বিশাল এক্সপো। রবি ঠাকুরের সার্ধশত বার্ষিকীর
উদ্যাপন চলছে দেশ জুড়ে। গীতাঞ্জলী নিয়েই একটা সিরিজ করবেন ঠিক করলেন। কঠিন কাজ। ছ’মাসেরও
কম সময়। সব মিলিয়ে কুড়িটা কাঁথা। খোকার বউ মিতু এগিয়ে এলো মুশকিল আসানে। মাদারীপুরে ওর চেনা জানা কারুশিল্পী আছে। সবই দিতে চাইলেন তিনি, কিন্তু আম্বিয়ার মা’র
জেদের কাছে হার মানতেই হলো। ছ’টা কাঁথা সে করবেই।
কবিতাগুলোর গভীরতা ও ধরতে পারবে তো!
শেষ হওয়ার পর মুগ্ধ হওয়ার পালা তাঁর। এত নিখুঁত!
মিতুকে সাথে নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছে যান মিউনিখে। গীতাঞ্জলী থিম নিয়ে হাতের
কাজ! সবাই অবাক। কবিতা আর ভাবনার এমন যুগলবন্দী আগে দেখেনি কেউ। তবে আম্বিয়ার মায়ের করা সেই ছটা
কাঁথার সূক্ষ্ম কাজেই মোহিত সবাই। কোথায় যেন খোঁচাচ্ছিল।
এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথেই শোনেন, সে নেই। কোথায়? কাউকে কিছু বলে যায়নি। সাঁইত্রিশ বছরের সম্পর্ক পেছনে ছেড়ে গেছে অবলীলায়। চোখ
জ্বলতে থাকে তাঁর, জ্বলে ভেতরেও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন