শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

রোখশানা রফিক

পর্দাপ্রথা,  কিছু সংশয় ও প্রবাস




(৩)

রমজান মাসে নিউজিল্যান্ডের ডুনেডিন শহরে, যেখানে বর্তমানে আমি বাস করছি,  এখানকার একমাত্র মসজিদ আল হুদায় মসজিদস্থ সকল মুসল্লী ও মহিলাদের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয় পুরো রমজানের প্রতিদিন। একেক দেশের মুসল্লীগন একেকদিন রান্নার দায়িত্ব পালন করেন। খাবারের কাঁচামাল মসজিদ কর্তৃপক্ষ ও সেই দেশের মুসল্লীগন যৌথভাবে সরবরাহ করেন। জনসমাগমও ভালোই হয় পুরো রমজান জুড়ে।

মাগরিবের নামাজ ও ইফতার শেষে তারাবীহ পড়ার জন্য অনেকে থেকে যান মসজিদ কক্ষে। অনেকে চলেও যান বাসায়। মাগরিব ও তারাবীহ
র মধ্যবর্তী সময়টুকুতে  বাংলাদেশের গ্রামীণ মেয়েদের উকুন বাছার আসরের মতো ফ্লাক্সে চা, কেক, বিস্কুট, নানা পদের ঘরে তৈরি স্ন্যাকস সহযোগে কিছু মহিলার নিয়মিত আড্ডা জমে ওঠে মহিলা  কক্ষে। 

আমি যে কদিন দেখেছি, মোটামুটি ধর্মীয় কোনো আলোচনা বাদে কুশলাদি বিনিময়, পরচর্চা,  ফ্যাশন, পরবর্তী দাওয়াতের ভেন্যু, হাসিঠাট্টা এরকম সব আলোচনাই হয় সেই আসরে। অবশ্যই মসজিদ একটি সামাজিক ভাবে সম্মিলিত হওয়ার স্থানই বটে। কিন্তু সেখানে অন্ততঃ মহিলাকক্ষে পবিত্র রমজান মাসে নামাজের আনুষ্ঠানিকতায় সামিল হওয়া ছাড়া, কিছু হিজাবী ছাত্রী এবং নগন্য সংখ্যক মহিলার কক্ষের কোণার দিকে  বসে অনুচ্চারিত স্বরে কোরান পাঠ বাদে,  যে কোনো সামাজিক দাওয়াত অথবা রেস্টুরেন্ট-ক্যাফের গল্প-আড্ডার মতোই পরিবেশ থাকে। নিশ্চিতভাবে তাঁরা বাড়ির লোকজনের কাছে ইবাদতে মশগুল থাকার উদাহরণ হিসাবেই চিহ্নিত হন।

মসজিদের বিশাল আরামপ্রদ মহিলাকক্ষের মাঝখান জুড়ে বসা মহিলাদের আড্ডার দাপটে প্রকৃত গুটিকয়েক ইবাদতকারিণীর একেবারে নির্জন কোণায় নীরবে কোরান  পাঠের দৃশ্য যেন বর্তমান সমাজে ধর্মীয় অনুশাসনের কোঠাসা হয়ে পড়ারই রূপক চিত্র। সেইসাথে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও উল্লেখ না করে পারলাম না,  ডুনেডিনে বসবাসরত বাঙালি কমিউনিটিতে যে সামান্য বিষয় নিয়ে বিবাদে ফাটলের সৃষ্টি হয়ে  দুটি গ্রুপের সৃষ্টি বছর দুয়েক আগে হয়ে এখনও বিদ্যমান,  সেই ঘটনা প্রবাহের সবচেয়ে উত্তপ্ত বাদানুবাদ মসজিদে জুম্মার নামাজ শেষে দাঁড়িয়েই হয়েছে। ঘটনার উল্লেখ করে কাউকে ব্যক্তিগত ভাবে মর্মাহত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু  আমার সাধারণ জ্ঞানে আমি মনে করি,  একজন বেনামাজীও মসজিদে দাঁড়িয়ে কলহ করে  মসজিদের পরিবেশ কলুষিত করার আগে দুবার চিন্তা করবেন। আমি কি ভুল বললাম?


(৪)

নিউজিল্যা
ন্ডে ডুনেডিনে একজন হিজাবী মহিলার আপত্তিতে একটি বাঙালি পার্টির  কয়েকটি গ্রুপ ছবি আমি ফেসবুকে পোষ্ট করার পর ডিলিট করে দিয়েছিলাম, যে ছবিগুলোতে তিনি ছিলেন। সেসব ছবিতে তিনি হিজাব পরিহিতা ছিলেন। বর্তমানে  তিনি ফেসবুকে সেলফিসহ অন্যান্য ছবি যেগুলো কোনোটাই হিজাব পরিহিত নন,  প্রায়শই পোষ্ট দিয়ে থাকেন। হতেই পারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন! কিন্তু কোনো  মতামত অতি জোরের সঙ্গে প্রকাশ করার আগে দুবার চিন্তা করে নেয়া ভালো নয়  কি? একজন হিজাবী বাঙালি মহিলা আবার বলেছেন, বাইরে থেকে কিছু বোঝার  উপায় নেই বলে তিনি কোনোদিনই কোনো অন্তর্বাস ব্যবহার করেন না। ভয়ে আছি এ ব্যাপারে কোনো তাফসীর আবার শুনতে পাই কিনা?


এছাড়াও সেলফি আক্রান্ত যুগে বিভিন্ন মাধ্যমে যে হিজাব পরিহিতা এবং অধিকাংশ সময়ে ভারী মেকআপ চর্চিত বোনদের ছবি দেখতে পাই, তাদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন, ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী, পশুপাখি এবং মনুষ্যকুলের কোনো ছবি ঘরে থাকলে সেই ঘরে ফেরেশতাকুলের অনুপ্রবেশ ঘটবে না। তাহলে ছবি তোলা এবং তা প্রকাশ করার মতো মাকরূহ কাজটি আপনারা অতি উসাহের সাথে করেন কেন? নাকি মাথার একটি স্কার্ফই, জলে নামবো কিন্তু চুল ভেজাবো না, টাইপ আভরণ আপনাদের? মানে, সেজেগুজে ছবিও দেয়া হলো, আবার পর্দানশীনতার সুনামও বজায় থাকলো! এটা এক ধরনেডাবল স্ট্যান্ডার্ড 

সামাজিক মনস্তত্ত্ব অবশ্য বলে, কোনো দেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় যখন মূলধারার সাথে একাত্ম হতে না পারে, তখনই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দে
য়ার জন্য  মাত্রাতিরিক্ত কিছু আচরণ বা বহিঃপ্রকাশ রপ্ত করে। নিউজিল্যান্ডের অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী  এবং সময়ের হিসাবে পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয় ডুনেডিন শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় এখানে বসবাসকারী বাঙালি পরিবার ও সিঙ্গেল পারসনদের শতকার ৯৭% নিজের বা পরিবারের কারো পি এইচ ডি সংশ্লিষ্টতার  কারণে এখানে এসেছে। বাকি ৩%ও হয় ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সাথে  জড়িত, অথবা হাতে গোনা ২/১ জন রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সাথে জড়িত, মানে সেখানে বা সুপার শপে চাকরি করেন। এখানকার মুসলিম বাঙালিদের অনেকের কঠোর ধর্মীয়  গোঁড়ামি প্রীতির কারণে, অনেক ঘরোয়া সমাবেশেই আলোচিত হয় এই ব্যাপারে যে,  বিধর্মীদের এই দেশে স্কার্ট পড়া মহিলাদের দেখার চেয়ে তাঁরা কেন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য আবেদন করেননি? এতে উভয় পক্ষের জন্যই সুবিধা হতো।

এছাড়া সুযোগ পেলেই হিজাববিহীন মহিলাদের সাথে খোশগল্প করার মতো ধর্মপ্রবণ ভদ্রলোকের সংখ্যাও এখানে কম নয়তা সেই মহিলাগন দেশী-বিদেশী যাই হন না কেন। একজন শুশ্রুমণ্ডিত ধর্মপ্রবণ ভাইকে তো একবার জিজ্ঞাসা করেই বসলাম এক বাঙালি পার্টিতে, 
আপনি তো ভাই দেখতে পাচ্ছেন আমি হিজাব পরিহিত নই। তাহলে একজন ধর্মপ্রব পুরুষ হিসাবে, পার্টিতে হিজাববিহীন মহিলাদের সাথে খোশগল্প করতে আপনার গুনাহ হচ্ছে না?


(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন