মিসেস টপ্পা এবং মিসেস
টোরি
বিষুবরেখার
কাছাকাছি একটি ভূখণ্ডে সকালের চৌকো রোদ জানালা গলে ঢুকে পড়ল কাউচের ওপর। দুটো মেরু থেকে রেখাটির দূরত্ব সমান
এবং বলা বাহুল্য, রেখাটি কাল্পনিক। শীত সকালে কম্বলটাকে বুকের ওপর থেকে তুলে
তক্ষুনি মুখ ঢাকলেন মিসেস টপ্পা। স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। বেণী থেকে হারিয়ে যাওয়া লালফিতে
খুঁজছে এক কিশোরী। হঠাৎ বিকেলের আকাশে হাজার রঙের আভা। রঙের ছায়াচ্ছন্নতায় খেলা ভুলে আকাশে তাকিয়ে রইল
যে, সে বড় আপন। তার গায়ে মৌরীর গন্ধ।
চোখ বুজে তিনি শুনছেন
মিষ্টি সুর। কম্বলের নিচে রোদ পালালে গানের সুর বাড়ল। কাউচের ওপর শুয়ে রাত কাটিয়েছেন এটা বুঝতে তাঁর কিছু সময়
লাগল। তেষট্টি বছর বয়সী
মিসেস টপ্পা কোনোদিন নিজস্ব বিছানা ছাড়া ঘুমোননি। গান শুনতে পাচ্ছেন। ‘আমি নিশ্চয়ই এখনও স্বপ্ন দেখছি’,
স্বগতোক্তি করলেন তিনি। কিন্তু তা নয়। মুখ বের করে দেখলেন, কার্পেটের
ওপর রিডিং গ্লাস আর আকাশী মলাটের পেপারব্যাক উল্টে পড়ে আছে। প্রিয় লেখকের নতুন উপন্যাস ‘এন আননোন ডাস্ক’। বুকের ওপর
রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নির্ঘাত।
হয়তো গান ভেসে
আসছে অন্য কোনো ইউনিট থেকে। সকাল সকাল রেডিও চালিয়েছে কেউ। নাকি রাতে রেডিও বন্ধ
করতে ভুলে গিয়েছিলেন! এ চিন্তা তাঁকে কম্বলছাড়া
করল। কফি হাতে ভাবছেন, রেডিও
অফ। তবে গান এলো কোত্থেকে! কিছুদিন ধরেই
এমন হচ্ছে। একই গান সম্মোহিতের মতো শুনে যাচ্ছেন। রেডিও স্টেশনগুলো শুনলেন। না, এ
গান তো সেখানে নেই! ছোটবেলায় মায়ের গলায় গানটি শুনেছিলেন। ঘুমপাড়ানী গান। এক ছোট্ট মেয়ে, যে পথ
হারিয়ে ফেলেছে। কাঁদছে আর তার জন্য গান গাইছে বনের নাইটিঙ্গেল। জ্বরের ঘোরে শোনা
নয়। শেষ কবে জ্বর এসেছিল তাঁর, মনে পড়ে না। এক শিশির নিঃসৃত সকালে তিনি বুঝতে পারেন,
রেডিওটি আসলে আছে তাঁর মাথার ভেতর। সেখানে
গান বাজছে। সব সময় সু্র আর শব্দের সাগরে থাকা খুব স্বস্তিদায়ক কিছু না।
রাতে বিছানায় শুয়ে
‘এন আননোন ডাস্ক’ থেকে তাঁর দৃষ্টি দূরে উধাও। মিসেস টপ্পা জানেন তিনি বৃদ্ধা। তবু
অনুভব করেন মায়ের কোলে মাথা রেখে তিনি ছোট্ট মেয়ে, স্তনের গভীর ছায়া কী শান্তিময়! কল্পনা
বলা যায় কী? এ তো ফ্যান্টাসি নয়, বাস্তব। আবেগ আর আলোভরা অতীতের কিছু অংশ। কিছু সুন্দর অভিজ্ঞতার মুহূর্ত যা মধুর স্মৃতি হয়ে আছে। একটু পর শুরু হবে মিষ্টি গান। এ জগতের
অর্ধেকটুকু ডুবে আছে যে গানে, দিন দিন সে গান প্রবল জোরালো হয়ে ওঠে। মায়ের গন্ধের সাথে পাকা ফসল, রক্তগোলাপ, ফ্রিল খুলে যাওয়া
ফ্রক আর মৌরীর সুখ সুগন্ধে।
কঠিন দেওয়ালে আঁটা
স্বপ্নীল দরজা। এ মুহূর্তে একজন ই এন টি ডাক্তারের কথা ভাবছেন মিসেস টপ্পা। কিংবা কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তীব্র সুখের ওয়ান্ডার ল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া মাঝরাতের
দরজাটি কি তবে বন্ধ হয়ে যাবে?
ফ্রেম ঘুরে গেল পৃথিবীর
উত্তরপশ্চিম গোলার্ধে। আটমাস বরফের নিচে ঘুমিয়ে শহরটি জেগেছে। গ্রীষ্মকালীন নরম রোদে গা সেঁকে নেবে আগামী চারমাস। রাত্রিতে এখন কিছু ভেজা কুয়াশা আর ভ্যাপসা ঠাণ্ডা। তাপ এবং শব্দ নিরোধক স্টুডিওতে কাজ করতে করতে ষাটোর্ধ্ব মিসেস
টোরি অবশ্য এসব কিছুই অনুভব করতে পারছেন না। তিনি সুর সৃষ্টি করেন। জনপ্রিয় সুরকার। কানে একটু কম শোনেন। এতে সুর সংযোজনে কোনো সমস্যা হয় না।
পৃথিবীতে ঘটে
যাওয়া শেষ যুদ্ধে বাবা-মা’র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মিসেস টোরি অনাথাশ্রমে ঠাঁই
পান। ‘হোম’এ একলা তাঁর
বেড়ে ওঠা। পিতৃমাতৃহীন। ছোটবেলা থেকেই মাথাটা সামান্য হেলে গেলে নানান সুর শুনতে পেতেন তিনি। মিউজিক্যাল
হ্যালুসিনেশানে অপার্থিব সুর এসে ধরা দেয় তাঁর জাগতিক বোধে। রহস্যময়, গভীর সুরগুলো আসে বোধের সীমানা পেরিয়ে। এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেননি তিনি। তাঁকে হয়তো পাগল
ভাববে লোকে কিংবা তিনি হয়তো সত্যিই তাই।
থমাস মানকি এই
স্বাপ্নিক মুহূর্তকেই বলেছিলেন- ‘ওয়ার্ল্ড বিহাইন্ড দ্যা মিউজিক’? কী অর্থ এ সুরের?
আদৌ কি এ সুর কোনো কিছুর সাথে জড়িয়ে আছে? দোলচেয়ারে বসে ভাবছেন। নইলে কেনই বা তিনি স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারে নিজেকে
দেখতে পাবেন? এক্স রে রিপোর্ট বলছে- তাঁর মস্তিষ্কে ম্যাটালিক
স্প্লিনটার। মাথা নাড়ালেই টুকরোগুলো মিউজিক্যাল টেম্পোরাল লোব-এ মৃদু চাপ দেয়, জন্ম
নেয় অসংখ্য মায়াবী সুরমূর্ছনা। বিশাল নাচঘরের দরজা খুলে যায় আর অসীম সুর মাধুর্যের
কোনো জগত থেকে সুর এসে সেখানে নৃত্যমগ্ন থাকে।
এ পরম সুখ কি মিসেস
টোরি অপসারণ করবেন? ভাবনা চেয়ারে বসে দুলছেন। বাগান জুড়ে রঙ ছড়িয়েছে টিউলিপ। কিছুদিন পরই লাল-হলুদের ছায়া চুমু করবে সবুজ অটামলিফের
গালে। স্বর্গীয় সুরে ভেসে পাতাগুলো নেমে আসবে গাছতলায়। মিসেস টোরি জানতেন না বিষুবরেখার কাছাকাছি এক জায়গায় ঊষার
প্রহরে কোনো কোনো মানুষ বিশেষ একটি গান গায়।সে সঙ্গীতের নাম ‘টোরি’। জানলে তিনি আপ্লুত
হতেন এটা নিশ্চিত বলা যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন