প্রশ্ন
সেদিন,
ভোরের ‘সময়’ এসে ভোরের ‘আলো’কে জিজ্ঞেস করেছিল : ‘আচ্ছা, ভোর, একজন আরেকজনকে এমন কী দিতে পারে, যা
দ্বিতীয়রহিতভাবে শুধু সে-ই দিতে পারে? যেটা সে ছাড়া আর অন্য কেউ পারবে না দিতে। কী এমন আছে তার?’
ভোর তখন
ভীষণ ব্যস্ত। ইয়েলো আর অরেঞ্জ মিশিয়ে একের পর এক শেড দিচ্ছে ব্রাশ বুলিয়ে। আর হলুদ
মানে কি একটা হলুদ নাকি! তারও ক—ত—রকমের ভাঁজ। আঙুলে, সারা হাতে, জামায় তার লেগে
আছে ছোপ ছোপ টাটকা রঙের ছিটে। ওরকম ব্যস্ততার সময়ে মুখ তুলে তাকাবারও ফুরসৎ থাকে
না। একটু এদিক-ওদিক হয়ে যদি বেশি রঙ প’ড়ে যায় তো হলো, ফট ক’রে ভোরবেলাতেই সকাল
দশটার ফটফটে শাদা হয়ে যাবে। ‘ব্যস্ত
আছি ভাই, পরে এসো’, রঙ মেলাতে মেলাতেই ভোর বলল।
সেদিন
সন্ধেবেলা সময় আবার এলো। সন্ধে তখন গোধূলির রঙ মেলাচ্ছে। বেলা ডুবতে আর
বেশি বাকি নেই। চাঁদও স্টেজে এন্ট্রি নেবে বলে উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে। কি অসম্ভব
দ্রততায় অথচ কি নিখুঁত ফ্রেসকো টাঙিয়ে কোবাল্ট আর অকার ইয়েলো মারছে তখন সন্ধে,
সাট্ সাট্ ক’রে। তারই মধ্যে সময় এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে, চুপটি ক’রে, মুখ নিচু।
মুখ ফুটে বলেই ফেলল তাও, ‘তুমি আমায় এমন কী দিতে পার বন্ধু, যেটা দ্বিতীয়রহিতভাবে
শুধু তুমিই দিতে পার? যা তুমি ছাড়া আর অন্য কেউ পারবে না। কী এমন আছে তোমার? যা
শুধু তুমিই, তুমিই দিতে পার?’
এবারে
সত্যিই বিরক্ত হল সন্ধে। আচ্ছা পাগল তো! নিজের কাজ নেই বলে কি আর কারও কাজ নেই?
‘তুমি রাতের দিকে আসতে পারবে?’ রেডিশ অরেঞ্জের সাথে খুব অল্প-অল্প আইভরি ব্ল্যাক
মেশাতে মেশাতে বলল, ‘এখন তো দম ফেলার সময় নেই। দেখতেই পাচ্ছ। একটু এদিক-ওদিক হয়ে
গেলে ঝপ ক’রে রাত নেমে আসবে।’
সেদিন
রাতেও এল সময়। তারা ফুটছে তখন এক-এক ক’রে। বনজ্যোৎস্নায় ভেসে গেছে চরাচর। তাকিয়ে
থাকলে নেশা হয়ে যায় এমন জ্যোৎস্না। চাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিল্পীর কাছে গিয়ে সময়
বলল, ‘এখন তো ফাঁকা আছ। কাজ নেই’। শিল্পী তখন বিরাট এক গামলায় তরল রুপোর জল গোলাচ্ছে লম্বা
একটা বাঁশ দিয়ে। ‘অ্যাঁ?
কাজ নেই মানে?’ সময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই জ্যোৎস্নার রঙটা কে মেলাচ্ছে?’ সময় তাও
মুখ নিচু ক’রে দাঁড়িয়েই আছে। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পায়ের নিচে থাকা মেঘেটার ওপর ডান
পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষছে। হাঁ-হাঁ ক’রে উঠল শিল্পী। ‘আরে-এ, আরে করছ কি! মেঘটা পুরো
জলে ভরা। একটু চাপ পড়লেই পেট খসে ঝরিয়ে দেবে সব। আর আমার খাটনির রঙগুলো ভেসে যাক।
তুমি বরং এক কাজ করো’, রঙ গোলা থামিয়ে বাঁশটা গামলার গায়ে ঠেসিয়ে বলল, ‘ছুটিছাটার
দিন দেখে কোনও মানুষকে গিয়ে ধরো। ওরা বেশ ভালো-ভালো কথা বলতে পারে। তোমার উত্তর
পেয়ে যাবে’।
পরদিনই
ছিল রোববার। সকাল সকাল রাস্তায় নেমে সময় ধরল এক লোককে। ‘ক্-কে? কে আপনি?’ একেবারে
চমকে গেছে লোকটা। হাতে একপাটি ছেঁড়া চামড়ার চটি আরেক হাতে ঢাউস বাজারের ব্যাগ নিয়ে
হন্তদন্ত হয়ে ছুটছিল সে। আচমকা সময় এসে দাঁড়িয়েছে মুখোমুখি। ভয় পাবারই কথা। ‘আ্-আমি,
আমি সময়’। এটা যে কারুর নাম হতে পারে বা, আদৌ হতেও পারে এরকম নাম, তা কিন্তু লোকটা
তখন ভাবেইনি। সে আছে তার নিজের তাড়ায়। তাকে প্রায় জোর ক’রে থামিয়ে সময় বলল, ‘দেখুন
আমার একটা জিনিস জানার আ—’। ব্যস ওটুকুই। আর কিছু বলতে সে পারেনি। বা, লোকটা
তাকে আর বলতে দেয়নি। তার মাঝখানেই সময়কে থামিয়ে সে বলেছে, এবং ওরকম হন্তদন্ত হয়ে
ছুটতে ছুটতেই বলেছে (অনুমান করা যায় সময়ও নিশ্চই তখন লোকটার সাথে পাল্লা দেবার
জন্য ওভাবেই ছুটছিল), ‘আমার ভাই এখন একটুও সময় নেই বুইলেন। এই দেখুন, চটি’, হাতে
ধরা চটিটা তুলে সময়ের মুখের কাছে এনে দেখায় (সময় দ্যাখে কোনও পুরুষের ডান পায়ের
চটি, যার বহুদীর্ণ সোলে গোড়ালির কাছে ক’দিন আগের শুকনো গোবর), ‘ছিঁড়ে গেছে, মুচিকে
দিয়ে তারপর যেতে হবে দোকানে, একগাদা জিনিস কেনার বুইলেন তো? বিকেলেই আবার ট্রেন,
ফ্যামিলি ট্যুর, দার্জিলিং, বুইলেন কিনা...’ সময় দাঁড়িয়ে রইল পথিমধ্যে। হাঁ ক’রে।
লোকটা ছুটে চলে গেল। ডান হাতে তার ঢাউস বাজারের ব্যাগ। বাঁ হাতের তর্জনী আর বুড়ো
আঙুলে ধরা চামড়ার ছেঁড়া চটি। দেখে মনে হয়, ওরা দু’জনেও ছুটছে তার সাথে, পেছন পেছন।
মনটাই ভেঙে গেল সময়ের। এদের জন্য সে এত করে! দিন নেই রাত নেই, নাওয়া নেই খাওয়া
নেই, ঘড়ির কাঁটা ধ’রে অক্লান্ত পরিশ্রম। ছ্যাঃ।
সেদিন,
গভীর রাতে টুপভুজঙ্গ মাতাল হয়ে সময়কে ফিরতে দেখে শিল্পী হাঁক দিল, ‘কি হে, গেছিলে
নাকি মানুষের কাছে? কী বলল সে?’ সময় তখন ডান পা বাঁ-পাশে আর বাঁ পা ডান পাশে ফেলে
হাঁটছে। ‘তুমি বরং কাল গাছের যাও, ওরা তোমার কথার উত্তর দেবে ঠিক।’ সময়ের কাছে
এসে, তার কাঁধে হাত রাখল শিল্পী।
পরদিন
গাছের কাছেই গেল সময়। তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ক’রে দাঁড়িয়েই আছে। গাছের
কোনও উত্তর নেই। নির্বাক, অনন্ত মৌনী সে। পাত্তাই দিল না। একটা বুড়ো কাক ডানা
ঝটপটিয়ে উড়ে গেল সময়ের প্রশ্ন শুনে। আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই রইল সময়। হাওয়ায়
এপাশ-ওপাশ ভেসে দুলতে দুলতে, যেন হাওয়ার কোমরে সে হাত রেখেছে আর হাওয়া তার কাঁধে,
এভাবে যুগলনৃত্যে মাটিতে পড়ল একটা পাতা। ‘আহারে, একেবারে কচি পাতাটা। এখনই ঝ’রে
গেল!’ পাতাটাকে হাতে নিয়ে সময় ভাবল, মনে মনেই বলল, ‘আরও বেশ কিছুদিন তো দিব্যি বাঁচত।
বড় হতো। ঝরার সময় তো হয়নি এখনও।’ তারপরেও, আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কোনও উত্তর না
পেয়ে সময় ফিরে এলো।
‘কী
ব্যাপার?’ সন্ধের পর শিল্পী হেঁকে জানতে চায়, ‘কি বলল গাছ? গেছিলে নাকি?’ সময় তাকে
বলল পুরোটা। ‘বেশ তো। উত্তর তো পেয়ে গেলে তাহলে।’ ঠোঁট ঝুলিয়ে সময় বলে, ‘দুর্,
কিছুই তো বলল না। কে জানে, আমিই তাকে বোঝাতে পারিনি হয়তো।’
শিল্পী
হো-হো হাসছে এবারে। হাতে তার ব্রাশ। ম্যালাসাইট গ্রিন। হাসতে-হাসতে হাতের
ঝাঁকুনিতে, ব্রাশ থেকে ঝকঝকে সবুজ ছিটকে লাগে তার ঘন শাদা দাড়িতে, হলুদ জামায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন