দূরের কথা
ঠেলা দিতেই খুলে গেল আধাভেজা দরোজাটা। তনিমা খাবারের ট্রে’টা টেবিলে রেখে বসার ঘরে ঢুকতেই দেখে মাসীমা কার সাথে যেন ফোনালাপে ব্যস্ত।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ দিদি, গত সপ্তায়েই তো কুইল্ট না কি যেন পাঠিয়েছে আমার তূর্য। ঘর ভর্তি নকশিকাঁথাগুলো এখন কি করি বলেন তো!'
খোশ মেজাজে ছেলের আদরের জবাবে ভর্ৎসনা করছেন তিনি। তনিমাকে দেখে হাতের ইশারায় বসতে বলে, আবার গল্প শুরু…
‘আরে আমি টিকিট পাঠাতে মানা করেছি এবার, বুঝলে! বারবার এরকম টাকা খরচ করে যাওয়া আসা করার কী দরকার! নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে বৌমারা। মাসে মাসে কিস্তি শোধ দিতে হয়। তারপরে ফার্নিচার কেনা না লাগলেও রান্নাঘরের কি কি সব কিনেছে, আভেন টাভেন, তাতে মুরগী নেচে নেচে রান্না হয়। কত্ত খরচ!'
এরকম আরো দশ বারো মিনিট কথা বলে ফোন ছেড়ে আদরের গলায় ডাকলেন তনিমাকে।
‘তনু, কি এনেছিস রে?’
‘চলো হাত ধোবে। খাবার টেবিলে গিয়েই দেখ! ’
একরকম ঠেলে ওঠালো সে মাসিকে। তারপর টেবিলে নিয়ে বসালো। তনিমা একে একে খিচুড়ী, রসুনের আচার, ডিমভূনা আর হাঁসের ঝাল বেড়ে বেড়ে দিতে লাগলো। মাসী চোখ কপালে তুলে যা কিছুই বলতে যায়, তনিমা শোনে না।
‘অনেকক্ষণ বকবক করেছো মাসী! এবার খাও।’
এক বোনপো ছাড়া তাঁর কাছে আর কেউ থাকে না। বোনপোও থাকে নিজের ধান্ধায়। তনিমা কী এক প্রগাঢ মায়ায় প্রতিদিন মাসীর খবর নিয়ে যায়, খাবার দেবার হলে দিয়ে যায়। খাবার সময় মাসী গল্প করতে ভালোবাসেন। কিন্তু আজ গল্প বাদ দিয়ে বাচ্চাদের মতো এটা ওটা গায়ে ফেলে খাচ্ছেন। তাঁর আজ অনেক খিদে।
মাসী একসময় ছবি আঁকতেন। দেওয়ালে তাঁর অনেক চিত্রকর্ম এখনো ঝাপসা ঝুলছে। ঘরটা ছোট। এক ছটাক বারান্দা। সেখানে দুজন মানুষ একসাথে হাঁটতে পারে না। রান্নাঘরটি বড়। কিন্তু মাসী আজকাল রান্না ভুলে গেছেন। ভুলভাল মশলা দিয়ে প্রায়ই তিনি তরকারী নষ্ট করেন। একা একা সেই তেতো খাবার কত যে ফেলে দেন! ভরা সংসারের দারুণ রাধুনী সেই মা আজ একা একা চাল বাছেন, আর বেছে তুলে আনেন তাঁকে ফেলে চলে যাওয়া সময়ের মানুষ আর শান্তিময় সেই দিনগুলোকে। মন ভালো রাখতে ফোন তুলে একে ওকে ডায়াল করে কথা বলতেই থাকেন। মাঝে মাঝে একা একাই চালান কথার চলাচল। তনিমার কষ্ট হয়।
তিন সন্তান তাঁর তিন উন্নত দেশের বাসিন্দা। হাসিভরা জম্পেস পরিবারের ছবি বাধাঁনো দামী ফ্রেমে। তাতে মাসীর সাথে তোলা ছবি হয়তো অনেক খুঁজলে দুই একটা পাওয়াও যাবে। তনিমা এত বছরে কখনো দেখেনি তাঁর ছেলেরা তাঁকে কিছু পাঠিয়েছে। মাসী পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পকারের মতোই সবাইকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলেন।
একদিন তনিমাকে ডেকে তুঁতে রঙের এপলিক শাড়ি বের করে মহাখুশী।
'শোন্ এটা সূর্য পাঠিয়েছে রে। দেখ কী সুন্দর শাড়ি! বৌমার পছন্দ আছে'।
এদিকে শাড়িটা তনিমা নিজেই যে পুরো বেইলী রোড খুঁজে এনে দিয়েছিল, তা মাসী বেমালুম ভুলে গেছেন। তনিমা আর ভুল ভাঙায় না। থাক না! কিছু কিছু ভুল বড় মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়ায় একা বিকেলের ব্যালকনিতে। এই ঘ্রাণ বড় জাগ্রত। মাসীকে অনেক সময় ধরে সুখের থাকার স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে রাখে।
খাওয়া শেষে এঁটো প্লেটবাসন তুলে নিয়ে তনিমা রান্নাঘরে গিয়ে সব ধুয়েমুছে রেখে এলো। মাসীকে যাবার বেলায় ডাকতে গিয়ে দেখে মাসী বসার ঘরের সোফাতেই ঘুমিয়ে গেছেন। থাক ঘুমোক!
পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। সামনের ফ্ল্যাটেই তনিমারা থাকে। দরজা খুলতেই দেখল নিচে কতকগুলো খাম পড়ে আছে। সবই তার বাবার নামে। একটাতেই কেবল মাসীর নাম দেখা যাচ্ছে, শ্রীমতি চিত্রলেখা নাগ। খামটা রেখে আসতে গিয়েও চমকে গেল সে। টেলিফোন অধিদপ্তর থেকে এসেছে। সাত মাসের বিল বকেয়া থাকায় বাড়ির ল্যান্ডফোনের লাইন অনেক আগে থেকেই সাময়িক ভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন