ধারাবাহিক উপন্যাস
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
(১৫)
চাঁদের গায়ে চাঁদ
লেগেছে আমরা ভেবে করব কী! সুতরাং যুবতীর আর সুনীলের সংসার আমাদের নজরের বাইরে এখন।
কিন্তু চণ্ডাশোক? ওড্র দেশের প্রান্তর রক্তে লাল করে দিল
যে, সে সংসার করেনি?
- আমার এক হাত হলো ঘৃণা, অন্য হাত হত্যা। সে কী বিস্তির্ণ যুদ্ধক্ষেত্র! শিবিরে ফিরে প্রতিষেধক লেপন করে যখন বাইরে এলাম তখন
হাওয়া আসছে আমার শিবিরের দিকে। পচা একটা গন্ধ পড়িমড়ি করে এসে গেল। শিবিরপালিকা
একবার আমার মুখের দিকে তাকাল। দেখল আমার নাসা কুঞ্চন। ছুট্টে চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে লোক লস্কর নিয়ে এসে অগুরু চন্দনের গন্ধে
ভরিয়ে দিল শিবির। স্থির হয়ে দাঁড়াল আমার কাছে। হাতে একটা মশাল নিলাম। গন্ধ যেদিক
থেকে আসছে সেদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপক, দেহরক্ষী সবাই আমার পিছু পিছু হাঁটতে থাকল। শিবির থেকে আধ যোজন হেঁটেই
পৌঁছে গেলাম যুদ্ধক্ষেত্রে। সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে নানা রকমের আলো। মশাল জ্বলছে কোথাও, কোথাও
জ্বলছে প্রদীপ। ভাবতে পার? প্রদীপ? বাড়ির
মেয়ে-বউরা প্রদীপ নিয়ে এসেছে, মশালের সামর্থ্য নেই তাদের।
চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে তারা দেখছে তাদের কোন প্রিয়জন মাটিতে লুটিয়ে। জীবিত না
মৃত। সমগ্র রণক্ষেত্র জুড়ে শকুনের দল তাদের বড় বড় ডানা ছড়িয়ে উঠছে, নামছে, সামান্য লাফিয়ে সরে যাচ্ছে মানুষ দেখলে,
অপেক্ষা করছে। আর ঝাঁকে ঝাঁকে শেয়াল। যুদ্ধক্ষেত্রের প্রান্তরের
দিকে নাকি আরো সব ভয়ানক জন্তুরা এসেছে।
সবাই মিলে যেন তামাশা দেখতে এসেছে। এই এত এত মানুষের মহাভোজ দিয়েছে মানুষ। আয়,
আমরা আনন্দ করি। ফূর্তি করি। গন্ধে নাক ভারী হয়ে আসছে। বমি উঠে
আসছে। আমি ভূতগ্রস্তের মতো চলছি যেন।
- কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র তো এমনি হয়। এর
অন্যথা আর কি আছে?
- নেই। সত্যিই নেই। কিন্ত এ
যুদ্ধক্ষেত্রের সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য কী জান?
- কি?
- এখানে যোদ্ধারা কেউ ভাড়াটে না। আমারই
বাহিনীতে কত ভাড়াটে সৈন্য ছিল। কত সব দেশ, জাতের লোক। এদের
একজনও ছিল না।
- তাতে ফারাক কী হলো?
- এরা আমৃত্যু যুদ্ধ করেছে। উন্মাদের মতো
লড়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও মনে হতে দেয়নি
যে এই যুদ্ধটা কোনোদিনও শেষ হবে। বস্তুত, আমি একটা সময়
ভাবছিলাম আরো কিছুক্ষণ এমন যুদ্ধ চললে আমার সৈন্যরাই না ভেঙে বসে! তারা তো যুদ্ধ করছে তাদের প্রাপ্য অর্থের জন্য। এমন জীবন বাজী
রেখে যুদ্ধ তারা করবে কেন?
- তবু তো তুমিই জিতলে!
- হ্যাঁ। কেন না আমার বাহিনী বিপুল।
- শুধু তাই?
- নাহ, শুধু তাই
না! প্রত্যেক বাহিনীর নেতাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, যে সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত হয়েও
ফিরতে চাইবে, তাকে আমি স্বহস্তে হত্যা করব। যতক্ষণ একটা হাতও তোলার সামর্থ্য থাকবে ততক্ষণ যুদ্ধ
করতে হবে। আর সকলেই জানে আমি চণ্ডাশোক। যুদ্ধ জয় হলে ওদের যা প্রাপ্য তাকে আমি
দ্বিগুণ করে দিয়েছিলাম।
আমি কোনোদিন যুদ্ধে
যাইনি। যুদ্ধের বর্ণনা পড়েছি শুধু। সিনেমায় দেখেছি। এবং যারা সিনেমা বানায় তারাও
সকলেই যুদ্ধে গেছে, এমন না। তবু কেউ কেউ যুদ্ধের সিনেমা বানাতে গিয়ে যুদ্ধেই মারা গিয়েছে সেটাও
দেখেছি। কিন্তু যুদ্ধে যাওয়া আর যুদ্ধ দেখা এক না।
- যুদ্ধে তুমি জেতার পরে কী দেখতে গেছিলে
যুদ্ধক্ষেত্রে?
- জানি না।
- জান না? যুদ্ধে
মানুষ মরলে কেমন দেখতে লাগে এর আগে তো অনেকবার দেখেছ, নতুন কী
দেখতে গেছিলে?
- বললাম তো, জানি না।
- তুমি প্রতিশোধ উপভোগ করতে গেছিলে।
- না।
- হ্যাঁ। যুদ্ধরত অবস্থায় তুমি উপভোগ
করতে পারনি। তোমার ভেতরে তুমুল অস্থিরতা ছিল। তাই যুদ্ধের শেষে নিজেকে যুদ্ধ থেকে
বিযুক্ত করে দেখতে গেছিলে কেমন প্রতিশোধ নিলে তুমি।
- যদি গিয়েই থাকি...
- ক্ষতি কিছু নেই। সব ঘৃণার এইটাই তো
সর্বোচ্চ অবস্থান।
- তাই হবে। আমি জানতাম না আমি কেন
যাচ্ছি! কিন্তু আমাকে যেতেই হতো। গিয়েছি।
- যে সব মেয়ে-বউরা উপস্থিত ছিল তারা
তোমাকে দেখেনি?
- দেখেছে অথবা দেখেনি।
- কেন এভাবে বলছ?
- তারা আমার দিকে এক লহমা চোখ পরলেও
ঘৃণায় ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। তারা জানে এই লোকটাই দায়ী এত এত মৃত্যুর জন্য। তারা ঘৃণা
এবং ক্রন্দন এবং সময় বিশেষে নৈঃশব্দ দিয়ে অভ্যর্থনা করেছিল আমাকে।
- তোমার রাজধানী হলে ফুল ছুঁড়ত।
- হ্যাঁ। লুটের ভাগ সবাই পায়।
- রাজধানী না গিয়ে তুমি তবু...
- কলিঙ্গ আমার পদানত। কিন্তু এই কি
কলিঙ্গ?
- কেন নয়?
- এরা যে স্বাধীন জাতি। এরা সারাদিন
নিজেদের ক্ষেতে কাজ করে। সমুদ্রের গভীরে চলে যায় মাছ ধরে আনতে। তুমি ভাবতে পারবে
না, সামান্য ডিঙি নৌকা নিয়ে এরা চলে যায়
সেই কতদূরে দূরের দেশে বাণিজ্য করতে। বঙ্গোপসাগর থেকে ভারত মহাসাগরের দ্বীপে
দ্বীপেও চলে যায়। আরেকটু বড় জাহাজ হলেই চলে যায় আরো বেশী বেশী বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে আরো আরো দূরে। এরা কি সেই কলিঙ্গ?
- নয়?
- না। এরা বিজিত। এরা শক্তিহীন। এরা আরও
দীর্ঘকাল ক্ষেতের কাজের জন্য লোক যোগাতে পারবে না। পারবে না মাছ ধরার জেলে আনতে।
সব মরে গেছে। আমি মেরে ফেলেছি। আরো অনেক অনেককাল এরা আমাকে রাজস্ব দেবার ক্ষমতাও
রাখবে না। এরা সে কলিঙ্গ না। আমি কাদের হারালাম বল তো!
সহসা আর্ত-চীৎকার করে
ওঠে সুনীল।
- এর পরে আমি আর অশোক থাকতে পারি না।
- তাহলে?
- সুনীল না হয়ে আমার গতি নেই। এই লোভ,
এই ক্রোধ, এই আকাঙ্ক্ষার থেকে আমার মুক্তি
নেই।
- ধর্মাশোক হয়েও না?
- না। কে ধর্মাশোক? সেও তো আরেকজন শাসক মাত্র।
- শুধু শাসক?
- আরে এই করবে আর ওই করবে না বললেই কী
ধর্ম হয়ে যায়? ধর্মিষ্ঠ হলে তো সবার আগে সিংহাসন ছেড়ে চলে
যাওয়া উচিত ছিল, গিয়েছিল কি?
- না। কিন্তু...
- কেন, কেন যায়নি
বল তো?
- সুশাসন দেবে বলে।
- একমাত্র ওই আছে যে সুশাসন দিতে পারে?
আর কেউ পারে কী পারে না সে জানল কীভাবে?
ডুলুং-এ বিকেল চলে
যাচ্ছে এখন। আমাদের থেকে কিছু দূরে ক'জন
সান্থাল নারী-পুরুষ সামান্য গলা ডোবানো জলে সাঁতার কাটছে। পাড়ে বসে অনেকে দেখছে আর
হাসছে। আমার কৌতূহল হলো। হাঁটা দিলাম ওদিক পানে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন