শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

সুবীর সরকার

হেরম্বচরিত 

  
   

টু নু মু নু এ ক্কা

তো, এক বিকেলডোবার ক্ষণে টুনুমুনু এক্কার সাথে দেওয়ান বর্মনের দেখা হয়ে গেল। দেওয়ানের কপালে ঘাম, ঘাড়ের গামছায় মুখ মুছে সে যখন ধানহাটি থেকে বেরিয়ে আসছে তখনই দেখা পেল টুনুমুনু এক্কার। কালো পেশল শরীরে ঢেউ তুলে তুলে ধামসা মাদলের তালে শরীর দুলিয়ে টুনুমুনু তখন প্রবেশ করতে যাচ্ছে মোরগলড়াইপর্বে। হাড়িয়াহাট পর্বে। দেওয়ান বর্মণ কি টুনুমুনু এক্কাকে গ্রহণ করবে? না কি তিন নদী পাঁচ ফরেষ্ট ঘেরা তার জোতজমির ভিতর, দিক ও দিগরের ভিতর ছড়িয়ে দেবে! দেওয়ানের প্রবীণ চোখের কুঞ্চনে সাময়িক দ্বিধা তৈরি হতে থাকলেও দেওয়ান কিন্তু  টুনুমুনুর দিকে মুখ ভরতি হাসি নিয়ে পানের পিক নিয়ে হাজির হয়। টুনুমুনু তখন দেওয়ানের দিকে হাততালি ছুঁড়ে দেয়। বর্ণাঢ্য উৎসবের দিকে টেনে আনতে থাকে দেওয়ানকে চারপাশের নদীগুলি ফরেষ্টগুলি হাতিমাহুতের গানগুলি মন কেমনের দিনগুলি থেকে প্রবল একাকীত্ব আর বিষাদ যেন চুঁইয়ে নামতে থাকে। জোতজমির খালবিলের বাড়িটাড়ির গানবাজনার হাসিতামাসার এক পরিপক্কতায় কেমনতর এক দিন দুনিয়াই বুঝি সংশয়তাড়িত করে ফেলতে থাকে সমগ্র পরিপার্শটুকুন আর মহিষের গাড়ির সমবেতে ঘুমকাতুরে এক অসহায়তায় দ্বন্দ্ব দ্বিধা নিয়ে দেওয়ান দাঁড়িয়ে থাকেন আর একসময় জাঁকজমকের সঙ্গে ফিরতে থাকেন আবহমানের জোতজমির দিকে। পূর্বস্মৃতির তোয়াক্কা না করেই, যেভাবে মাদলধামসায় মেতে ওঠে টুনুমুনু এক্কা। নির্মাণ বিনির্মাণ নিয়ে একা একা বসে থাকা। রাজার হাতির পিছে পিছে দেওয়ানের ঘোড়া যুক্ত হয় আর বিস্তৃত কালখণ্ডে স্মৃতিকাতর হতে থাকা। দেওয়ান বর্মনের জোতজমি পত্তন করেছিল মেঘা বর্মণ। হাটের ভিতর মাঠের ভিতর রাতদিন খেলে বেড়াতো বাঘ। বাঘের নখ বাঘের লেজ অতিসন্ত্রস্ত জনপদগুলিতে কেবল হাওয়া ছড়িয়ে দিত। হাওয়ায় ভেসে আসা গান মাঘকুয়াশায় দলা দলা একাকীত্ব নিয়ে বিষাদ নিয়ে  পুনর্জন্মের কথকথার বৃত্তে সীমায়িত হতে গিয়েও হোঁচট খায় আর দশ কুড়ি পঞ্চাশ গঞ্জ গাঁ জুড়ে রবিশস্যের লকলকে সম্ভার। রাস্তায় রাস্তায় গান বাজে। বাজনায় বাজনায় নৃত্যে নৃত্যে আশ্চর্যতম দুলুনির ভরকেন্দ্রে গিয়ে ঝাঁকড়া সব গাছপালায়  অতিজীবিত হতে থাকা অনুখণ্ডগুলি দিয়ে ধরাছোঁয়ার এক জীবন ক্রমে টেনে নিয়ে চলে আর তখন দেওয়ান বল টুনুমুনু বল ধানহাটির ইঁদুর বল সব কিছুই যেন বৃত্তায়নে আটকে পড়া মজা ও ম্যাজিক। ধামসামাদল না থামলেও বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি নামে। উঠোনের নিকানো অংশে কীর্তনসুর প্রতিষ্ঠিত হলেও কোথাও কোনো স্বীকৃতি জোটে না। কেবল নদীর ওপর সাঁকো আর ওপারের ছায়াছন্নতায় বুঁদ হয়ে যাওয়া বিষণ্ন সব মানুষেরা হাড়হিম এক নির্জনতাই ফিরিয়ে আনতে আনতে গান গাইতে  গাইতে কীভাবে অন্যমনস্ক ও আত্মগত হয়ে উঠতে থাকে! হাজার হাতির মিছিল তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। চিলাপাতা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বাইসনের পাল ফের জঙ্গলেই। নদী পেরিয়ে চলে যাওয়া ধাইধাই বিটে। এমত দোলাচলে বাঁধা না দিয়েও  আদিঅন্ত মেঘের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে  কীভাবে দূরাগত গন্তব্য নির্ধারিত হতে থাকলে সোনাভাবী হাসির বান ডেকে আনে। কাঠের বাড়ির সিজিলমিছিল দেখে বুক ভরা শ্বাসে নতুনভাবে বেঁচে থাকতে চাওয়া। বৃক্ষ নদী আকাশ পুকুর হালগেরস্থির ভরভরন্তির ভেতর জীবনের পর জীবনের প্রবাহিত হতে থাকা। মহল্লায় মহল্লায় মাদলধামসা জেগে উঠলে টুনুমুনু শনিচরী ফাগুলাল চুনিয়া মালতিরা গাথা কিংবদন্তির লহর তলে। করম পূজার মাঠ জুরে অন্ধকার নামে। জোনাই জ্বলে। মোরগলড়াই শেষে ফিরতে থাকে চিলবানুস ওরাও। চিল্বানুসের পীঠে চিতার থাবার দুরন্ত আচড়। অতি পুরাতন পৃথিবীর বাঘে-মানুষের লড়াইয়ের গল্প স্বপ্নতাঁত বুনতে থাকলে চিলবানুস কখন কীভাবে যেন ‘বাঘুয়া’ হয়ে ওঠে। অতিকথার পৃথিবীতে এইসব চলতেই থাকে। দেড়শো ঘোড়া তিরিশ হাতির দেওয়ান ধনী টুনুমুনু এক্কাকে চিনতে পারবার প্রয়াসটুকুন জারি রাখেন আর সব পেরিয়ে জীবনযাপনের অর্ন্তগতে অবধারিতভাবেই টুনুমুনু, তার বাড়িটাড়ি গানকিসসা হর্ষবিষাদ ও হাটগঞ্জ সমেত।






টাড়িবাড়ি

 সে তো ৫০/৭০ বছর আগেকার কোনো পৃথিবীকালখণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা টুকরোগুলিকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করেই বুঝি গায়ত্রী সিং জলঢাকার চর পেরোতে পেরোতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে মধ্য শীতের রোদমায়ায় অসম্ভব এক পুলক জাগেমাথায় শোলার টুপিহাতে দোনলা বন্দুকগোঁসাইহাট ফরেস্ট থেকে শিকারফেরত গায়ত্রী, হীরা সিং-এর কাঁধে হাত রাখলেই বিশাল প্রান্তর যেন ডেকে নিতে থাকে গিলাডাঙ্গা এস্টেটের ভিতরগায়ত্রী তার অন্যমনস্কতাকেও অগ্রাহ্য করে; গভীর কোনো গান ভেসে আসতে থাকে, 
হামার দেশত বড় বাঘের ভয় রে সোনা রায় 
ফান্দত পড়িয়া বুড়া বাঘা কান্দে রে রূপা রায় 

গানের ভিতর কেমন এক যাদু থাকে মায়া থাকেগান ছড়িয়ে পড়ে গানে গানে ভরে ওঠে টাড়িবাড়ি খেতখামার বৃক্ষ নদীঅন্যমনস্কতা থেকে ফিরে আসবার মরীয়া প্রয়াস গায়ত্রীরপৃথিবীর ভিতর পুরাণসকল ঢুকে পড়তে থাকলে পুরাতন পৃথিবীর পটভূমির ভিতর এসে জড়ো হতে থাকে রাজার হাতি, শিকারজুলুস কিম্বা গায়ত্রী সিংএর জোতজমি। গায়ত্রীর চোখের তারায় তারায় আন্ধার আতির জোনাই জ্বলে ওঠেঅতীতময়তায় দিন কাটে তারকোথাও চলে যাওয়া ঘোড়ার ক্ষুরধ্বনি আর ফিরিয়ে আনতে পারে না সেচলমানতা দিয়েই তো তার দীর্ঘ যাপন, যা তাকে স্মৃতিকাতরতার দিকে ঠেলে দিলে তার কিছুই করার থাকে না আরজলঢাকার তরমুজবাগিচায় কুয়াশাশিশিরের কুহকে শেয়ালেরা ডেকে ওঠেবিভ্রমে ঢুকে পড়তে পড়তে গায়ত্রী আবার বুঝি জাগিয়ে তোলে, পুনরুদ্ধার করে গিলাডাঙ্গা এস্টেটহেমন্তের ফসলবোঝাই মহিষের গাড়িবিষাদু মইষালের বাওকুমটা বাতাসের গানকোথাও বুঝি চলে যেতে হয় মানুষকে! পুরাতন পৃথিবীর ভিতর দীর্ঘনিঃশ্বাসেরা ঘনবদ্ধ হয়জিপগাড়ির ভাঙা পাদানিতে দাঁড়িয়ে হেসে চলেছে হীরা সিংসময়  অতিক্রম করতে গিয়ে বুঝি এক পর্বে গায়ত্রী সময়াতীতের ধারাবাহিকতাতেই আটকে পড়ে! 

‘আঞ্চলত মুছিনুং হয় তোর 
সোনা মুখের ঘাম’... 

নয়ারহাটের জমজমাটির ভিতর দাঁড়িয়ে আমাকে শুনতে হয়েছিল গায়ত্রী সিং-এর গল্প২৫ বর্গমাইল বিস্তৃতির পূর্বতন গিলাডাঙ্গা এস্টেটের পুরনো নতুন সব মানুষের কাছেই যিনি মিথের মতোমিথ ভেঙে দিয়ে তৈরি হওয়া নতুনতর মিথের জালকে আটকে  গিয়েও নিজেকে স্মরণযোগ্য করে রাখবার প্রয়াসটুকুন তাকে চলমানতা দিতে না পারলেও; সে কিন্তু মাথায় শোলার টুপি হাতে বন্দুক সহ আদ্যন্ত এক গায়ত্রী সিং হয়েই যেন উঠে আসছেন জলঢাকার পুরাতন চরের খুব খুব গভীর থেকেই 


















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন