শরীরী গান্ধার ও কর্ণাটরাগিনী
"না উড়ে থেমেছো পাখি, সমস্তটা ওড়ো
কীভাবে উড়ছো তুমি, কীরকম বন্ধ হয়ে আছো
এভাবে পালকে ওড়ো
নানান আকারে একবার..."
(হাজারদুয়ার - স্বদেশ সেন)
রাতের বেলা সুর যেন একটু অন্যভাবে কাছে আসে। নৈঃশব্দ্যের ফ্রেমে বাঁধানো থাকে সোনার রেখায় ফুলকারির আঁকিবুকি। মনে পড়ে কি শংকর জয়কিশনের স্প্যানিশে অমোঘ স্ট্রোকের পেলব মায়া! ধানি সারেগামাপা... ধা পা... রাজ কাপুর নেমে যান স্টুডিয়োতে সাজানো চাঁদজাগা ছায়াময় গাছগাছালির আঙিনায় হ্যামকটিকে দুলিয়ে দিয়ে... নার্গিস তাঁর দীর্ঘনাসা সুষুপ্তিময় চোখের জাদুতে বেঁধে রাখেন শহর-গ্রাম-মাঠ-ময়দান-মফঃসলে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ গ্রস্ত মুগ্ধ চোখের মানুষজন। মান্না আর লতা ধর্মব্যাধের মতো নির্লিপ্ত সততায় শিকার করে চলেন তাদের হৃদয়। "ইয়েহ রাত ভিগি ভিগি, ইয়েহ মস্ত ফিজায়েঁ... উঠা ধীরে ধীরে উওহ চাঁদ প্যারা প্যারা... কিঁউ আগ সে লগাকে গুমসুম হ্যাঁয় চাঁদনি, তুনে ভি নহি দেখা মৌসম কা ইয়েহ ইশারা..."। অদ্বিতীয় শৈলেন্দ্র! কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে জেগে থাকে রাগ কিরওয়ানির মাদক আশ্লেষ। অলীক জেনেও কী অনিবার্য অভিঘাত সেই সুরের! তোমার কাছে এ বর মাগি...
"ইয়েহ রাত ভীগি ভীগি" :
https://www.youtube.com/watch?v=WNPAABBkk7M
(২)
দক্ষিণদেশের সুর কিরওয়ানি। শাস্ত্রীয় অর্থে কিরওয়ানি এখনও 'হিন্দুস্তানি রাগ' নয়, অন্ততঃ পন্ডিত ভাতখন্ডে'র তালিকা অনুযায়ী। তাই হিন্দুস্তানি মতে কিরওয়ানির কোনও নিজস্ব ঠাট নেই। যেহেতু হিন্দুস্তানি রাগের শিল্পী ও শ্রোতাদের কাছে কিরওয়ানি অভূতপূর্ব গ্রহণযোগ্যতা ও লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছে, সম্প্রতি কিরওয়ানিকে একটা নিজস্ব ঠাট হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস লক্ষ্য করেছি। এহ বাহ্য, মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছোনো'ই সঙ্গীতের লক্ষ্য, সেই যুক্তিতে এই রাগ আদি ঠাটভিত্তিক রাগবিশ্লেষণের এলাকার মধ্যে না এসেও উত্তরভারতের হিন্দুস্তানি ঘরানার শ্রোতা ও শিল্পীদের রুচিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। হিন্দুস্তানি রাগের সুরসাম্রাজ্যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেকে। সম্পূর্ণ অঙ্গের রাগ, আরোহ অবরোহে আটটি করে স্বর, কিন্তু জাদু ধরা আছে সব শুদ্ধস্বরের পটভূমিতে চকিতে স্পর্শ করা কোমল গান্ধার আর কোমল ধৈবতের নেশায়। তার মেজাজে ধরা থাকে শৃঙ্গার, বিষাদ আর নির্ভুল শরীরী আবেগ। ব্রাহ্মণ থেকে চন্ডাল কারও নিস্তার নেই সেই সম্মোহনে।
"শোলা থা জল চুকা হুঁ", মেহদি হসন, : https://www.youtube.com/watch?v=H9ns-cT-xOM
মনে পড়ে, মেহদি হাসান সাহেবের 'শোলা থা জল বুঝা হুঁ, দওয়ায়েঁ মুঝে ন দো...' অথবা গুলাম আলি সাহেবের সম্ভবতঃ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি (আমার মতে) 'পারা পারা হুয়া পয়রাহেঁ এ জান'। জনসমাদরে পিছিয়ে থাকে না আলি সাহেবের 'অ্যায় হুস্ন বেপরোয়াহ তুঝে, শবনম কহুঁ, শোলা কহুঁ...'
"পারা পারা হুয়া পয়রাহঁন জাঁ", গুলাম আলি :
https://www.youtube.com/watch?v=p7_zp7NdQOA
(৩)
কিরওয়ানি রাগটি বেশ জনপ্রিয়, বিশেষ করে যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে। এই রাগটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বাল্যকালে পণ্ডিত রবিশংকর পরিচালিত একটি বৃন্দবাদনের অংশ হিসেবে একটা তরানার মাধ্যমে। এই পরিবেশনার সহশিল্পীরা ছিলেন ষাটের দশকে পণ্ডিতজীর প্রধান শিষ্য ও অনুসারীরা। পরবর্তীকালে তাঁরা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের স্তম্ভ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত শিবকুমার, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ, পণ্ডিত কার্তিককুমার, পণ্ডিত এল সুব্রামনিয়ন, পণ্ডিত কমলেশ মৈত্র, উস্তাদ আল্লারাখা, উস্তাদ সুলতান খান এবং লক্ষ্মীশংকর। টুকরো টুকরো করে পরিবেশিত চতুরঙ্গ, ধমার, কজরি, দেহাতি, নাদেরদানি ইত্যাদি। মূলতঃ বিদেশী শ্রোতাদের ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। সারঙ্গি, বেহালা, সেতার, বাঁশি, মৃদঙ্গম, তবলা'র সঙ্গে কণ্ঠ সঙ্গীত। পণ্ডিত রবিশংকরের একটি অতি জনপ্রিয় কম্পোজিশন।
শিবকুমার শর্মা:
https://www.youtube.com/watch?v=KpHGjO_Kqq0
বড় করে গাওয়া বা বাজানো যায় না বলে কোনও অনুষ্ঠানেই মূল পরিবেশনা হিসেবে তা'কে আমরা শুনতে পাই না। পিলু, কাফি, খমাজ, ভৈরবীর মতো সে একটু দেরিতে আসে। অধিকাংশ সময়েই ঠুমরি দাদরার জামা গায়ে। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দের আই, দুরুস্ত আই। পুরিয়া ধনশ্রী বা বাগেশ্রী'র পর দশ-পনেরো মিনিটের একটি পেশকশ, দিল তরর হো জাতি হ্যাঁয়। মুম্বাইর বিখ্যাত হৃদয়েশ সঙ্গীত সমারোহ অনুষ্ঠানে শুনেছিলুম পন্ডিত রাজন-সাজন ভীমপলাশির পর চ্যালেঞ্জ নিয়ে ধানী গেয়েছিলেন, কারণ পর পর এই দু'টি রাগ নিজস্ব সূক্ষ্ম স্বকীয়তা বজায় রেখে এক আসরে গাওয়া অতি দুরূহ। মন ভরেছিলো নিশ্চয়, কিন্তু ছোঁয়ার একটু বাকি থেকে গিয়েছিলো। সেটা পূর্ণ হয়ে গেলো পরবর্তী শিল্পী পন্ডিত শিবকুমার শর্মা যখন মূল নিবেদন চন্দ্রকোষের পর বড় করে কিরওয়ানি বাজাতে শুরু করলেন। সঙ্গতে উস্তাদ জাকির হুসেন। কিরওয়ানি'র লিল্টিং মেলোডির সঙ্গে লয় ও ছন্দকে কীভাবে সীবনহীন মিলিয়ে দেওয়া যায় তার ক্ল্যাসিক নমুনা শুনলুম সেদিন। পন্ডিত শিবকুমারের সন্তুরে কিরওয়ানির রেকর্ডটি এক কথায় অসামান্য। মধুরেণ সমাপয়েৎ কা'কে বলে তখন বুঝতে পারলুম। কর্মক্লান্ত দিনের মহতী আয়োজনকে হয়তো ধরে রাখে মিয়াঁ কি তোড়ি, য়মন কল্যাণ বা রাগেশ্রী বা দরবারী। কিন্তু তা'কে সাঙ্গ করে শিশিরের শব্দের মতো শান্তি নিয়ে ঐ সব ভীরু পায়ে আসা শ্যামলী মেয়েদের মতো রাগরাগিণীর দল সন্ধ্যা হয়ে নেমে আসে। পন্ডিতজীর জন্য ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত স্ট্যান্ডিং অভেশন। আমার জন্য ছিলো ভিলে পার্লে স্টেশনে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত বসে বোরিভিলি লোক্যালের অপেক্ষা, মনে মনে নিরন্তর আক্ষেপহীন গুনগুন। কিরওয়ানির চক্করে পরদিন ভোর সাড়ে ছটায় পন্ডিত উলহাস কসলকারের অনুষ্ঠান আর যেতে পারিনি। আর এই সেদিনের কথা। ভুবনেশ্বরে রাজারানি সঙ্গীত উৎসবে সরোদে গোয়ালিয়র ঘরের বর্তমান দীপধারক দুই ভাই অমান আর আয়ান আলি খান বাজালেন এই রাগটি। সুর মেলাবার সময়ই ধরা পড়ে গেলো কী বাজাতে চাইছেন তাঁরা। বেমিশাল সুরের দাপটে রাগ কিরওয়ানি প্রায় মধ্যরাতের বসন্ত আকাশের নিচে একটা অন্যরকম অভিঘাত নিয়ে এসেছিলো।
আমজদ আলি খান :
https://www.youtube.com/watch?v=H9ns-cT-xOM
(৪)
নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় :
https://www.youtube.com/watch?v=CzsM8toCq9k
হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া :
https://www.youtube.com/watch?v=n6m22khe8Mg
পন্ডিত শিবকুমার, পন্ডিত হরিপ্রসাদ, পন্ডিত বিশ্বমোহন, পন্ডিত রনু মজুমদার, পন্ডিত তরুণ ভট্টাচার্য, পন্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ, যাঁদের বাজানো কিরওয়ানি সামনে বসে শুনেছি তা ছাড়াও মহামহিম দিকপালদের মধ্যে স্বয়ং উস্তাদ আলি আকবর, পন্ডিত নিখিল বন্দোপাধ্যায়, উস্তাদ আমজাদ আলি, উস্তাদ শাহিদ পরভেজ, উস্তাদ আব্দুল হালিম জাফর, পন্ডিত ব্রিজভূষণ কাবড়া, পন্ডিত রামনারায়ণ, পন্ডিত ভি জি যোগ, বিদুষী শিশিরকণা ধরচৌধুরী, বিদুষী এন রাজম এবং এক ও অদ্বিতীয় পন্ডিত রবিশংকর, তাঁদের বাজনা রেকর্ডে শুনেছি। এছাড়া পন্ডিত এল সুব্রামনিয়ান আর উস্তাদ রইস খানের যুগলবন্দিটিও স্মর্তব্য তার পেশকারিতে কর্ণাটকি শৈলি ও সেনী ঘরানার গায়কী অঙ্গের মেলমিলাপের নৈপুণ্যে। পন্ডিত রবিশংকরের দুই শিষ্য কার্তিক শেষাদ্রি আর অনুষ্কাশংকরও রাগ কিরওয়ানি'র রূপায়নে নিজেদের ঘরানার ছাপ রেখেছেন। প্রত্যেকেই নিজস্ব ধরনে অনন্য এবং এই অনুপম রাগটির সম্পূর্ণ মজা সযত্নে আদায় করে রাগটির মর্যাদা রক্ষা করেছেন।
আলি আকবর খান:
https://www.youtube.com/watch?v=om3qC-T3a3U
রাশিদ খান :
https://www.youtube.com/watch?v=ehB9j0gcMAk
শাস্ত্রীয় কণ্ঠসঙ্গীতে আমার প্রিয় শিল্পীদের মধ্যে উস্তাদ রাশিদ খানের গাওয়া রাগ কিরওয়ানি নিঃসন্দেহে সব চেয়ে বেশি মজাতে পেরেছে আমাকে। 'তোরে বিনা মেরে চ্যয়েন নহি, ব্রিজ কে নন্দলালা...' এক কথায় লাজবাব। অফতাব-এ- মৌসিকি উস্তাদ ফৈয়াজ খান একবার বলেছিলেন, রাগ কো উতনা হি ফ্যয়্লাও জব তক উসকা চেহরা সাফ না হো। উসকে বাদ অওর নহি। রাশিদের এই নিবেদনটি নিশ্চয় ওঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি নয়, কিন্তু রাগ কিরওয়ানির আসল চেহারাটি ধরেছেন নির্ভুল। রামপুর সহসওয়ান ঘরানার আরেক দিকপাল উস্তাদ মুস্তাক হুসেন খানের পুত্র উস্তাদ গুলাম হুসেন খানের গাওয়া রাগ কিরওয়ানির রেকর্ড রয়েছে। তবে তিনি মেজাজে অ্যাকাডেমিক, আকুতিতে রাশিদকে ছুঁতে পারেননি। উস্তাদ মশকুর আলি খানের গাওয়া রাগ কিরওয়ানি পরিবেশন শুনেছিলুম কিশোর বয়সে, এখনও কানে লেগে আছে। তাঁকে ছাড়া কিরানা ঘরের আর কারো কণ্ঠে রাগ কিরওয়ানি আমি শুনিনি। শুনিনি আগ্রা বা জয়পুর ঘরের কোনও মুখ্য প্রতিনিধির কণ্ঠেও। চিরকাল গ্রামবাসী হয়ে থাকার ফলশ্রুতি হয়তো!
অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে :
https://www.youtube.com/watch?v=mGBixJOXAH8
(৫)
"ফিরিয়া যদি সে আসে", সুকুমার মিত্র :
https://www.youtube.com/watch?
v=Z3oQsS0eqEs
বাংলাগানে রাগ কিরওয়ানির ছায়া বেশ কম। অবাক লাগে, এত জনপ্রিয় সুর হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের কোনও গান কিরওয়ানি অঙ্গে বাঁধা হয়নি। সম্ভবতঃ এই রাগটি সেই সময়ে স্বীকৃত প্রধান হিন্দুস্তানি রাগগুলির তালিকায় ছিলো না। পিলু, কাফি, খমাজ, যোগিয়া ভিত্তিক সুরে গান তো অসংখ্য, এমনকি গারাতে বাঁধা রবীন্দ্রসঙ্গীতও আছে, কিন্তু কিরওয়ানিতে নেই। তাই লঘু মেজাজের সুর বলে অবহেলিত, এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই বোধ হয়। তাঁর গানে যদিও কিছু কর্ণাটকি রাগাশ্রয়ী সুর নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেখানে কিরওয়ানির স্থান হয়নি। হয়তো সেই সময় সে 'ঘরেও নহে, পারেও নহে' গোছের অবস্থানে ছিলো, নয়তো কবিকে হয়তো এই রাগটি কেউ গেয়ে বাজিয়ে শোনায়নি। বাংলাগানে সুরের বৈচিত্র্য ও পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যপ্তির বিচারে নজরুলের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বিশেষতঃ রাগাশ্রিত সুরভিত্তিক কম্পোজিশন নজরুলের প্যাশন ছিলো। কিন্তু নজরুলের গানেও আমার অতি প্রিয় 'ফিরিয়া যদি সে আসে, আমারে খোঁজে ঝরা গোলাবে' গজলটি ছাড়া চিহ্নিত রাগ কিরওয়ানি আর শুনিনি। তবে নিবেদিত ও সিদ্ধ নজরুলগীতি শিল্পী সুকুমার মিত্র মশায় একটা অনবদ্য কম্পোজিশন করেছিলেন কিরওয়ানিতে, 'যমুনা কি বলতে পারে কতোবার কেঁদেছে রাধা....' গেয়েছিলেন শ্রীমতী শিপ্রা বসু। একেবারে মণিকাঞ্চন যোগ। আরেকটি মণিকাঞ্চন ছিলো ছোটকত্তা আর কিশোরের যুগলবন্দি 'একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে'... মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
"যমুনা কি বলতে পারে", শিপ্রা বসু :
https://www.youtube.com/watch?v=-DLhjQ-8b5s
"একদিন পাখি উড়ে", কিশোরকুমার :
https://www.youtube.com/watch?
v=RQIfpDiS_Cw
(৬)
এবার বলি রাগ কিরওয়ানিতে বাংলায় আমার প্রিয়তম রচনা শ্রদ্ধেয় রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া 'আমার মধু বনের ফুল, না ফুটিতে অবেলাতে ঝরিতে আকুল'। আমার কাছে যে লাইভ রেকর্ডিংটি রয়েছে সেখানে স্বয়ং রাধাকান্ত রয়েছেন সঙ্গতে। ঢিমে দাদরায় শুরু হয়ে তা আস্থাইতে যখন ফিরে আসছে দ্বিগুন লয়ে রাধাকান্তের তেরেকেটের মিহিন জালির কাজ, সঙ্গে রামকুমারের কণ্ঠসম্পদ খাজুরাহোর ভাস্করদের ছেনির মতো মসৃণ, দীপ্ত ও দৈবী মহিমায় ঋদ্ধ। রামকুমার গানের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ছদ্ম ভর্ত্সনায় অনুজপ্রতিম রাধাকান্তের বাদননৈপুণ্যের ব্যাজস্তুতি করে চলেছেন। বৈঠকী বাংলাগানের একটা পর্যায় সৃষ্টি হয়ে যায় এভাবে।
(৭)
"ইয়াদ ন জায়েঁ", মহম্মদ রফি :
https://www.youtube.com/watch?v=-DLhjQ-8b5s
"আঁখো সে জো উতরি হ্যাঁয় দিলমেঁ, আশা ভোঁসলে :
https://www.youtube.com/watch?v=qitBaM3Ly8s
ভারতবর্ষে সঙ্গীতের সর্বস্বীকৃত জনপ্রিয় ধারা, হিন্দি ছায়াছবির সঙ্গে সম্পৃক্ত সুরের আয়োজনগুলি। বাংলায় রাগ কিরওয়ানির বহুল ব্যবহার তেমন চোখে না পড়লেও হিন্দি ছবিতে বিভিন্ন সিদ্ধ সঙ্গীতকার বার বার এই সুরটিকে আশ্রয় করে বহু কালজয়ী গান আমাদের উপহার দিয়েছেন। শংকর জয়কিশন এই সুরটি নিয়ে প্রায় অবসেসড ছিলেন। প্রথমে যে গানটির কথা লিখেছি, সেটি ছাড়াও মনে পড়ছে কিশোরের কণ্ঠে 'গীত গাতা হুঁ ম্যঁয়, গুনগুনাতা হুঁ ম্যঁয়' বা রফিসাহেবের কণ্ঠে 'ইয়াদ ন জায়ে বীতে দিনোঁ কি' অথবা 'ম্যঁয় কভি কবি ন বন জাঁউ, তেরে প্যার মেঁ কবিতা'। এ ছাড়াও 'লাভ ম্যারেজ' ছবিতে তিনি উপহার দিয়েছিলেন লতার কণ্ঠে 'কহে ঝুম ঝুম রাত ইয়ে সুহানি, পিয়া হওলে সে ছেড়ো দুবারা...'। এই রাগটি নিয়ে সুরের আরেক জাদুকর পাগল ছিলেন। তিনি ওমকার প্রসাদ নৈয়র, ওরফে ও পি নৈয়র। যদিও সবাই তাঁকে রাগ পিলুর প্রতি সমর্পিত বলেই বেশি জানতেন, কিন্তু কিরওয়ানিতে তাঁর কয়েকটি রচনার কথা ভাবা যাক। রফিসাহেবের কণ্ঠে 'পুকারতা চলা হুঁ ম্যঁয়', 'ম্যঁয় প্যার কা রাহি হুঁ', আশার কণ্ঠে 'আঁখো সে উতরি জো দিলমেঁ, তসবির হ্যাঁয় এক অনজান কি'। ছোটকত্তাও পিছিয়ে ছিলেন না। 'আনেওয়ালা পল, জানেওয়ালা হ্যাঁয়', 'মেরি ভিগি ভিগি সি পলকোঁ মেঁ রহ গই', 'রিমঝিম গিরে শাওন', 'তুম বিন জাঁউ কঁহা'। এছাড়া আরো দু'টি গানের গানের উল্লেখ তো করতেই হয়। শচীনকত্তার 'দুখি মন মেরে' এবং রবির 'ইয়ে রাতেঁ ইয়ে মৌসম নদী কা কিনারা, ইয়ে চঞ্চল হওয়া'...
"রিমঝিম গিরে শাওন", কিশোরকুমার:
https://www.youtube.com/watch?v=kg3gLQBVd18
"ইয়েহ রাতেঁ ইয়েহ মৌসম", কিশোর-আশা, https://www.youtube.com/watch?v=4np5V2wTXwE
(৮)
এক একটা বিশেষ সুর যখন রাগের মর্যাদা পায়, তখন তার একটা মূর্তিগত অস্তিত্ত্বও সৃষ্টি হয়। তাদের দৃশ্যরূপ নিয়ে ভারতশিল্পে 'রাগমালা চিত্রে'র পৃথক জঁরও কল্পিত হয়েছে। শুধু শ্রাব্য থাকছে না সে আর, দৃশ্যরূপ নিয়ে স্বচ্ছন্দে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। যারা দেখতে পায়, তারা দেখে। দিলীপ রায়ের ভাষায় 'ওরা হাসে আর বলে হায়রে মধুর স্বপন, বলে কৃষ্ণ কাহিনী কল্পনা কবিকথন। আমি জানি, তাই মানি, আমি অন্তরে তার বাঁশরি শুনেছি তাই আমি তারে মানি'। ধূর্জটিপ্রসাদ রবিশংকরের পরিবেশনা শুনে যে রকম বলেছিলেন, '...এতো স্পষ্ট, যেন মনে হয় রাগিণীর পটভূমি থেকে বেরিয়ে এসে চোখের সামনে দাঁড়ালো। এই বেরিয়ে এসে দাঁড়ানো আধুনিক আর্টের একটি প্রধান লক্ষণ। এতে একটু পশ্চিমী আমেজ থাকে নিশ্চয়ই... তাঁর বাজনা শুনলে আমার পূর্ব বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে সঙ্গীত মনের অন্য স্তরের ভাষা। সাহিত্য ছাড়া অন্য, তবু ভাষা...'।
রবিশংকর :
https://www.youtube.com/watch?v=yff0Zgg5e_g
(৯)
'আর যা বলে বলুক অন্য লোক
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ...'
আমি একজন নিতান্ত ইতর শ্রোতা, কিন্তু এই ভাষাটি বোঝার সন্ধান যখন করি তখন আমাদের রাগরাগিণীগুলি এভাবেই মূর্ত হয়ে আমাকে অনেক কথা বলতে থাকে। কিছু বুঝি, বেশিটাই বুঝি না। তবু অকুলীন রাগ কিরওয়ানির সুর বহু দিগ্গজ সঙ্গীতস্রষ্টার মতো আমার কাছেও ময়নাপাড়ার কৃষ্ণা মেয়েটির মতো অমোঘ আবেদন নিয়ে হাজির হয়। তাই কৈফিয়ৎ দেবার একটা দায় থেকেই যায়, সবার জন্য।
"...যে বলয় তাকে দিতে চাই
তার অধীনতা ঐ দিয়ে গড়া হোক, ও কর্পূর জ্বলুক ও অশোক
দুধের বাটির পাশে, গলা রুপো থেকে তৈরি হোক
বাল্যের শিশির আর ঘুম গান, ঘুমে ঢলে পড়া কথা।"
(উৎপলকুমার বসু)
ki likhecho boss, tupi namie rakhlam!
উত্তরমুছুনki likhecho boss, tupi namie rakhlam!
উত্তরমুছুন