ধারাবাহিক
উপন্যাস
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
(১৩)
তিতির,
খুব
ধীরে অথচ নিশ্চিত বেরিয়ে পরছি। ইমেজের থেকে, লাইনগুলোর থেকে,
ত্রিভুজ অথবা বৃত্তের থেকে। সবটা বুঝবি না হয়তো, তবু...! ইমেজ মানে অন্যের ইচ্ছে, লাইন অন্যের টানা,
ত্রিভুজ, বৃত্ত, উপবৃত্ত,
চতুর্ভূজ সব অন্যের। এ সব কিছুই আমার না। বস্তুত আমার বলে কিছু নেই।
সংসারে থেকে দেখেছি, সংসারের বাইরে থেকে দেখেছি যে, জল আমি সেই জলই। মানুষ যেমন হয় তেমন হওয়ার ইচ্ছে খুব একটা ছিল বলে মনে নেই। যেমন হয় না তা কেমন তাও জানা
ছিল না। একেকবার বন্দর এসেছে, ভেবেছি এখানেই হবে বাসাবাড়ি।
চারটে দেওয়াল, দরজা, জানালা তুলে দিয়ে
বুঝেছি এ এক বন্দীশালা। শূন্যের মধ্যে লাট খেতে খেতে খানিকটা শূন্যকে সহনীয় করতে এ
সব বানিয়েছে মানুষ। অগাধ শূন্যের থেকে স্বল্প কিছু শূন্যতাকে ম্যানেজ করা চলে।
ম্যানেজ এক আশ্চর্য শব্দ। অনেক অনেক
সম্পদ যখন সঞ্চয় হচ্ছে, বাড়তি হচ্ছে কিছু কিছু লোকের, তখন তারা এই শব্দ আনে।
এই শব্দকে গো সম্পদের মতো
পালন করে। এর থেকে দুধ,
ঘি সময়ান্তরে মাংস, চামড়া থেকে জুতো, বেল্ট কত কত কী পাবার আশায় আশায় চলে। এই ম্যানেজ শব্দটার গায়ে যে বেধ আছে
তাতে আমি বারবার হোঁচট খেয়েছি। কখনো ভুল করে, কখনো ইচ্ছে
করে। খেয়ে খেয়ে দেখতে চেয়েছি এর আর আমার ধর্ম এক কী না!
না, এক না!
ভালোবেসে
তুমুল আদর নিয়ে জীবনের সমুদ্রে গিয়েছি। সংসার ম্যানেজ করে
যাইনি। দেখেছি ম্যানেজ করতে। দেখেছি কেমন করে ম্যানেজ করে মানুষ। আমিও পারতাম
বোধহয়। ইতিউতি নানা আখ্যান লিখে। করিনি। গেছি গেছি, ইচ্ছে
হয়েছে গেছি। ভালো
লেগেছে গেছি। ভা্লোবাসা
এসেছে, গেছি। চারপাশ ধ্বসে পড়েছে
এমনও
হয়নি। হবে কী? চারপাশে ধ্বসার মতো কিছুই রাখিনি কখনো যে! ধ্বসবে দেখলে
নিজেই ধ্বসিয়ে দিয়েছি। কবে এক ভূমিকম্প কী মৃদু বাতাস ভেঙে দিয়ে যাবে তার অপেক্ষার
চেয়ে অনেক বড় কাজ পড়ে
আছে। আরেক ব্রহ্মাণ্ড রচনার কাজ।
হাতের থেকে হাত খসে গিয়েছে,
হাতের আড়ালে লুকোনো নখ দেখা দিয়েছে, হাতের
বিজ্ঞাপন দ্বিমাত্রিক হয়েছে আমি করায়ত্ত করব বলে এগোইনি। করব না করায়ত্ত! নিজের
কোনো সম্পদ রাখিনি কখনো। এতকাল তো দেখছিস, জানিসই।
ব্রহ্মাণ্ড যেমন আমার না অথচ আমাকে ধারণ করে রাখে সপ্রেমে তেমনই আমিও ধারণ করেছি,
ধৃত হতে চেয়েছি। কে কী বললো, কে কী ভাবলো তা
নিয়ে ভাবার সময় আমার কোনোদিনই নেই। কেননা ওই যে বলা-কওয়া ওর বিনিময়ে আমাকে নইলে
একটি সুচিন্তিত ইমেজ পড়ে
নিতে হবে। সেই ইমেজের আড়ালে থাকবে আমার দাঁত-নখ সব। মহান
দায়িত্ব শিল্পের নিয়ে আমাকে শিল্পীর পোষাকটা পরে ফেলতে হবে প্রতি মুহূর্তের পার্ফর্মেন্সের
জন্য।
করব না পারফর্ম! পড়ব না ইমেজ। আমি এক
আচমকা, সব নিয়মের মধ্যে অনিয়ম হয়ে
থাকা। দু’
চার টাকার দু’
চার কোটি টাকার কোনো হিসেবেই মিলব না। সময়ের চিহ্নগুলো মুছে যাচ্ছে,
দেখছি, ভাবছি দাম করে একদিন নিজে নিজে মুছে
দেব বাকিটা।
হয়তো খুব দ্রুত, হয়তো কিছু সময় নিয়ে। নিশ্চিত না,
কিন্তু এগোচ্ছি বটে। যাব কোথায় তারও একটা আবছায়া
চেহারা দেখতে পাচ্ছি। জানিসই তো এভাবেই যা করার করে ফেলি।
যৌথ ইচ্ছেকে চিরকাল সন্মান করে
দেখেছি আসলে যৌথ ইচ্ছের আড়ালে থাকে কোনো এক একজনার ইচ্ছে। অথবা কয়েকজনের ইচ্ছে।
প্রকৃত যৌথতা আমি দেখিনি। এবারে সময় হয়েছে এই সব যৌথতার ভ্রান্ত প্রতীকগুলোকে ভেঙে
ফেলার। গড়তে কি চাইনি? চেয়েছি আপ্রাণ! কিন্তু গড়বে কে?
দুজনে এক পথে না হাঁটলে গড়া চলে না। চলছি বলে আসলে দুজন দুটো পথ
নিলে সে আলাদাই। চিঠি লেখালিখি (পড় ইমেল, এস এম এস, হোয়াট্স
অ্যাপ যা ইচ্ছে),
ফোনাফুনি নানারকম চলতে পারে ‘একত্র’ চলতে
পারে না। ভূগোলের শরীরের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ বড় নিয়মনিষ্ঠ। এমন কী ব্যতিক্রমকেও সে
জায়গা ছাড়ে না।
দেবদারু ও পাখিদের আলাপের ফলাফলে সন্ধ্যা
নামে। রাত হতে বিশেষ বাকি নেই।...
নাহ! এবারেও শেষ হলো
না চিঠিটা। ওই অব্দি লিখে রেখেই উঠে গেলাম।
কৌরবাকির কাহিনীতে যেতে হলে আমাকে
এখন কয়েকটা টিলা হাঁটতে হবে। উঁচু উঁচু মহাশালগাছেদের মধ্যে পাতার বিছানায় খানিক
শুয়েছিলাম। প্রায় নিস্তব্ধ জঙ্গল এই দুপুরেই। অনেকদিন আগে এই জঙ্গল দিয়েই হেঁটে
গিয়েছিলাম জামবনি। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে মুণ্ডা,
খেরিয়া, সান্থাল, ওঁরাও-রা হাঁটছে। কোথায় ছোটনাগপুর
কোথায় এই লোধাশুলি?
ছোটনাগপুরই বা কেন, সেই মহাকাব্যের নৈমিষারণ্য?
সেখানেও তো ছিল এরা। তাড়া খেতে খেতে চলে এসেছে একদা এ সব জায়গায়। সব
চাইতে দুর্গম অংশে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্ম নিয়ে কোনোক্রমে টিকে থেকেছে।
মুঘলদের সময় রাজপুতরা রাজা হয়েছে তার বেশিরভাগ
জায়গার। বাদশারা পাঠিয়েছে অঞ্চল দখল করতে,
বিদ্রোহ দমন করতে। এরা সব এসে এসে রাজা হয়ে বসেছে বাহিনীর জোরে।
রাজপ্রাসাদ বানিয়েছে। সে সব মোটেও বিভূতিভূষণের দোবরু পান্নার প্রাসাদ না। মাটির
গড় গড়া না। পাথর-টাথর দিয়ে বানিয়েছে। এদেরই লুটে এদেরই রাজা সব। তাদের দেখাদেখি
এদের সমাজে এসেছে নানা বিভাজন। গাঁও-এর মুখ্য মাঝি থেকে গাঁওতার মাথা মাঝি সবাই
একে একে সিং হতে পারলে খুশি
হয়। মারাং বুরুর পুজোর
চেয়েও ঢেকনা বেশি
দূর্গাপুজোর।
সব রাজার দেখাদেখি।
আর একদল চিরকালই দূরে দূরে থেকেছে
এই সব অনুকরণ থেকে। যতবারই এখানে আসি ততবারই আমার মনে হয় আমি দেখতে পাচ্ছি আসলে
হেলেনাইজেশন কাকে বলে। দেখতে পাচ্ছি হাওয়ার্ড ফাস্ট কী করে এঁকেছেন ম্যাক্কাবি
বিদ্রোহের ইতিহাস। গ্রীকদের দেখাদেখি পুরোহিতরা সব আচারে আচরণে পাল্টে পাল্টে
যাচ্ছে। পাল্টে দিতে চাইছে তারা জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে সমস্ত ইহুদিদের। জুদাইজম
পেছনে পড়ে থাকছে,
সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে প্রভুদের প্রতি আনুগত্য। নগর জেরুজালেম থেকে
দূরে থাকা গ্রাম্য রাবাই পরিবারের পাঁচ ভাই উঠে দাঁড়াচ্ছেন বিদ্রোহে। মহিমময়
ভ্রাতৃবৃন্দ। এখানেও হয়েছে এমন। সে সব ইতিহাস লেখা আমার কাজ না। আমি শুধু হেঁটে
চলি ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে। হেঁটে যাই সুনীলের কাছে।
টিলা পেরিয়ে গিয়ে দেখি ডুলুং-এর
গোড়ালি জলে সুনীল গামছা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে। খলবলে মাছ যদি উঠে আসে। দূরে বসি। ভাবি রঙ যারা বানালো প্রথম তারা
কি ভেবেছিল একদিন তাদের হাতে করে আর রঙ বানাতে হবে না?
রঙ নিয়ে কত কী লেখা আছে! বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের চিত্রসূত্রে আছে
শ্বেত কত রকম হতে পারে আর গাঢ় রঙই বা কত রকম। শ্বেত-এর হালকায় কিছু শ্বেত হবে এবং গাঢ়তে হবে কিছু
শ্যাম। মূলে কিন্তু শ্বেত। শ্বেতকে
বলে গৌর। প্রথমে মনে করি গৌরের বিবিধ লক্ষণ। গৌর হবে সোনার বর্ণ রুক্ম, হাতির দাঁতের মতো
দন্ত-গৌরী, বিভক্ত চন্দনের মতো স্ফুট-চন্দন-গৌরী,
শরতের মেঘের মতো
শারদ-গৌরী, শরতের চাঁদের মতো শরৎ-চন্দ্র-গৌরী।
এবারে বলি শ্যামের কথা। রাই-এর কথা
তো আগেই হলো। গাঢ় লালের সঙ্গে মিশলে হবে
রক্ত-শ্যাম। বাদামী লালের সঙ্গে মিশলে মুদ্গা শস্যের মুদ্গা-শ্যাম,
যাকে প্রাকৃতে বলে মুং ডাল তার রং আর কী! দূর্ব্বা ঘাসের মতো
রঙের সঙ্গে মিশেলে দূর্ব্বাঙ্কুর- শ্যাম।
পাণ্ডুর বর্ণে হবে পাণ্ডু-শ্যাম। টোপাজেরে মতো সবুজ হলে হবে হরিৎ-শ্যাম। হলুদের
সঙ্গে পীত-শ্যাম। প্রিয়াঙ্গুলতার মতো
হলে প্রিয়াঙ্গু-শ্যাম। বাঁদরের মুখের মতো
লালচে বাদামী হলে
কপি-শ্যাম। নীল পদ্মের মতো
হলে নীলোৎপল শ্যাম। আর যদি চাষ পাখির মতো
হয়? চাষ শব্দটি সংস্কৃতে এক পাখির নাম ভাবতেই অবাক
লাগে। সে পাখির রঙে হলে চাষ-শ্যাম।
বেগুনী পদ্মের মতো
লাল হলে হবে রক্তোৎপল-শ্যাম। আর ধুসর-গাঢ় মেঘের মতো হলে হবে ঘন-শ্যাম।
শ্যাম-রাই দিয়ে সব। সেই
বর্ণিকাভঙ্গের পাঁচটি গৌর, বারোটি শ্যাম। এ সব রঙ হবে কী দিয়ে?
তাও বলা হচ্ছে! সোনা বা কনক, রূপা বা রজত, তামা, অব্রকম
অর্থাৎ অভ্র,
রজভর্ত বা লাপিস লাজুলি, লাল সিসে হলো
সিন্ধুরা, সিসে হলো তভরা,
হরিতালা
হলো
পীতবর্ণের আর্সেনিক সালফাইড খনিজ, লক্ষা, হিঙ্গুলাকাম হলো
গাঢ় লাল যাকে ভার্মিলিয়ন বললে ইদানীং বোঝে তাড়াতাড়ি এবং সেই বিখ্যাত নীল চাষের
নীল। এমন আরও কত কথা। পটুয়া সুনীল, তার শরীর-বিভঙ্গ,
আর দিন ভেঙে ভেঙে রাত জেগে ওঠা দেখতে দেখতে মনে চলে এলো। সুনীল এখন রঙ আনায়। নিজেও
বানায়। কিন্তু আনানো রঙ সবাই প্রায় ব্যবহার করছে ওরা।
- যদি
শাসন করতে গিয়ে আমার ভাষার জন্য অক্ষর প্রয়োজন হয়, তখন আমি অক্ষর
নিই বিদেশীর থেকে। রঙ নিলে ক্ষতি কি?
[ক্রমশঃ]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন