স্মৃতিতে সেলিম আল দীন
খুব ধীরে।
মধ্যরাত্রি পার না হলে আমি বসি না এই বইটা নিয়ে। পড়ছি অন্তত সাত থেকে আট দিন তো হবেই। সেলিম
আল দীনের ‘ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ’। রাত্রি যখন নিঃঝুম
চরাচর নিঃশব্দ,
স্যার তখন নেমে আসেন আমার চোখে মাথায় ঘুমে জাগরণে, কি এক অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে
চারপাশে। আমি
তাঁকে স্যারই বলি। কারণ ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আমার বরের প্রণম্য শিক্ষক। তাঁর লেখা পড়তে
পড়তে আমি মিশে যাই কোনো এক লুপ্তলোকে, যেন কবেকার কোন
সে অমর কথকতা নিয়ে স্যার বলছেন তাঁরর জীবনের
সব নারীদের কথা, তাঁর
জীবনের সব ব্যপ্ত প্রেম আর বিরহে যাপিত জীবনের কথা। যেখানে নির্বিশেষে মিশে যায়
আমারও গভীর ব্যথা, আমার অপসৃত আর অপসৃয়মান পুরনো আর বর্তমান বিশ্বলোক, অপার পৃথিবী। আর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে
এ কোন্ অজানা সত্য যা আমি চিরকাল অণ্বেষণ করে এসেছি পূর্বাপর জীবনে বোধে
যন্ত্রণায় ক্রোধে কিংবা ভালোবাসায়! এর নাম প্রেম। লুকিয়ে থাকা বোধ আর হাত বাড়িয়ে পাওয়াটাকে হৃদয় দিয়ে ছোঁয়াটাকে
পাড়ি দিয়ে আছে আরও এক অসীম আকাশ। যেখানে পাওয়ার আর না পাওয়ার বোধ একাকার হয়ে মিলে
থাকে এক অতীব দৃশ্যমান ক্রম উপলব্ধ যাতনা হয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এবং
যুগের পর যুগ। এই
তাঁর মতে
প্রেম। এই
তাঁর মতে
প্রেমভাব। না
হলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়বার সময় যে মেযেটাকে প্রচন্ড ভালোবেসে কাছে এসেছিলেন, যে
হারিয়ে গেছিল,
আর বহুকাল পর যখন জানতে পেয়েছিলেন সে জীবিকার
প্রয়োজনে হয়েছে যৌনকর্মী, তখন তিনি যে যন্ত্রণায় তাকে উপলব্ধি করেন, তাই তাঁর কাছে
প্রেম। যা
চেয়েছি তা পেয়েছি, যা পেয়েছি তাকে ছুঁয়েছি ভালোবেসেছি আদর করেছি রেখেছি যতনে। তাই
কি আসলে প্রেম!
একসময় যাতে আমরা বিশ্বয়াবিভূত হয়ে
মুগ্ধ হয়ে সচেতনে কিংবা অবচেতনে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে কিছুটা নিচে অবস্থান করি, মানসিক জায়গায়
সেটাই প্রেম। তাই
কেউ কেউ বলেন ‘প্রেমে
পড়া’।
অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থা থেকে পতন। কিন্তু সেলিম আল দীন দিলেন অন্য ব্যথা প্রেমের অন্য এক
অতিন্দ্রিয় ব্যখ্যা। সম্ভোগে
স্পর্শে প্রেম নয়। পতনে
নয় প্রেম। প্রেম এক ঊর্ধ্বতর অধরা অবগাহন। যেখানে শুধু নিমগ্নতাই আছে, আছে অশেষ আত্মউপলব্ধি
কিংবা বিনির্মাণ।
তাঁর সাথে আমার যোগের কথা বলি। সেটা
২০০১/২০০২ সাল। জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে
গেছি। ড্রামা এন্ড ড্রামাটিস্
ডিপার্টমেন্টে। আমার বর এখান থেকেই পাশ করেছে। সেদিন
সারাদিনরাত আমি ছিলাম নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। ডিপার্টমেন্টে সেদিন ছিল
প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। সকালে আমরা যখন স্যারের রুমে ঢুকি তখন সেখানে আফসার
স্যার, হারুন স্যারও ছিলেন। আমার বিয়ের পর
স্যারের সাথে প্রথম দেখা। আমাদেরকে দেখেই সেলিম স্যার বলে উঠলেন, “সবাই এসো, দেখো
বউ এসেছে, বউ এসেছে, এই তাড়াতাড়ি মিষ্টি নিয়ে এসো!” তারপর মিষ্টি আনা হলো। সন্ধ্যায়
ছিল নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। সেখানে তো আরও মজা। নাটক
মঞ্চস্থ হবে, দর্শক সারিতে সবচেয়ে পেছনে বসলেন ইন্টার্নালরা আর বাকিরা দর্শক।
স্যার আমাকে বসতে দিলেন স্যারের ঠিক সামনের সারিতে এবং ঠিক স্যারেরই সামনে। আমি
অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম একজন বিশাল ব্যক্তিত্বকে, একজন অনেক বড় সাহিত্যিককে। এবং তাঁর ভেতরের
অসাধারণ একজন সাধারণ মানুষকে। কোথাও যাঁর এতটুকু অহংকার নেই। কত সহজ আর সরল তাঁর আহ্বান। তিনি
নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন।
খুব ছোট্ট একজন মানুষ আমি, স্যারের
খুব কাছে যেতে পেরেছিলাম দু'একবার, আর এই দু’একটা দিনের স্মৃতিই আমার সমগ্র জীবনে বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে
প্রবহমান আজও।
কিছুদিন পর আবার দেখা সাবলাইমে। তখন
স্যার ‘রঙের মানুষ’ লিখছেন। মনে হয় এডিটিং দেখতে
এসেছিলেন সাবলাইমে। তিনি বাইরে থেকে দরজাটা ধাক্কা দিতেই ভেতরে বসে থাকা আমার গায়ে
লাগল। আমি দরজাটা বোধ হয় খুলতে যাচ্ছিলাম ধাক্কা লাগবে ভেবেই। তারই আগে স্যার দরজা
ঠেলে ঢুকতে গেলেন। যথারীতি স্যারের দেওয়া দরজার ধাক্কাটা এসে লাগল আমার গায়ে। আমি ভাবতেও পারিনি
স্যার আমাকে মনে রেখেছেন। আমি সালাম দিয়ে কিছু বলে ওঠার আগেই স্যার বলে উঠলেন, “আহা হা, আঘাতে সাক্ষাৎ,
বউ, তুমি কেমন আছো? ব্যথা পেয়েছ?” সেদিন আরো একবার মুগ্ধ
হয়েছিলাম। একজন মানুষের সহজ আর সাধারণ প্রকাশ দেখে। পৃথিবীর সব বড় মানুষই বোধকরি এমন ‘মানুষ’!
তারপর বহুদিন গেছে। রাজেশ্বরীকে নিয়ে তাঁর
মৃত্যুদিনে গেছি। পারুলদিকে সেদিন প্রথম
দেখেছি। তাঁকেও শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারি না। শুনেছি তাঁর অনেক না জানা দুঃখ, জেনেছি কীভাবে পারুলদি সেলিম স্যারের
সাহিত্য সাধনায় পাশে থেকেছেন সারাটা
জীবন। পারুলদি'র সাথে রাজেশ্বরী এবং আমিও ফুল দিয়েছি তাঁর কবরে শ্রদ্ধায়, ভালোবেসে।
তারও অনেক পর। ভুলেই গেছিলাম স্যারকে।
শুধু বাসায় বইয়ের
আলমারিতে যখন স্যারের অসংখ্য বইয়ের দিকে তাকাই, সারাদিনের ব্যস্ততায়, আমার পড়ার সময় হয় না, তখন শুধু
স্যারের কথা মনে পড়ে। ভীষণ লজ্জিত হই। আর মনে
মনে সান্তনা দিই
নিজেকে – “আমার
আর দোষ কি,
এই জাতিই তো কত সহজে ভুলে যায় দেশের বীর
যোদ্ধা, বিবেকবান,
বুদ্ধিজীবি
আর সাহিত্যিকদের। আমি তো অকৃতজ্ঞ ক্ষুদ্র একজন সাধারণ মানুষ মাত্র!”
তবে লজ্জার চেয়ে দুঃখ পেলাম এবার আরো
বেশি। বহু বছর
পর আবার যখন ১লা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল, ২০১৫) গেলাম জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢুকবার পথে স্যারের সমাধিটা দেখে বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। কেমন অনাদরে
(আমার মনে হলো)
পড়ে আছে কবরটা!
চারপাশে বাঁধানো তো নয়ই, নামফলকও নেই। কেউ দেখে জানতেও পারবে না যে, এই সেই
মানুষের কবর যিনি সারাজীবন ব্যাপৃত থেকেছেন সাহিত্য সাধনায়; আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে
করে গেছেন সমৃদ্ধ তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞ
দিয়ে। কেন যে এমন হয়!
কেনই বা হয়!
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আমরা
যোগ্য সম্মান জানাতে পারি না জীবিত অবস্থায়। মৃত্যুর পরও যোগ্য সম্মানটুকু না দেখাতে
পারলে কি করে শোধ করব তাঁদের কাছে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধির এই সুবিশাল ঋণ!
আমিও বুঝি আজ প্রেমে পড়েছি। স্যারের
‘ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ’ পড়তে পড়তে বদলে যাওয়া কিংবা ছিলই নিজের ভেতর, কিন্তু প্রকাশের
ভাষা ছিল না
- সেই কথা যখন স্যার বলে দেন তখন মনে হয় স্যারের কাছে আরও বেশি বেশি কেন যাইনি! কেন স্যারের
বইগুলো স্যার জীবিত অবস্থায় পড়ে শেষ করিনি! তাহলে কতই না প্রশ্ন করে
জেনে নিতে পারতাম!
জানতে পারতাম আরো কত অব্যক্ত কথা! এই আফসোস এই না পাওয়াই কি প্রেম? স্যার যখন বলেন, অনেক ভালোবাসার
পরও বড় বোনের মৃত্যুর
পর তার না থাকার উপলব্ধিইটাই তাঁর প্রতি প্রেম। তাঁকে কাছে না পাওয়াটাই প্রেম। ঠিক
এমনি আমারও উপলব্ধি
আজ,
আমিও কি তবে প্রেমে পড়েছি এমন!
অবচেতনে আকাঙ্ক্ষায়
আফসোসে আর নির্লিপ্ততায়!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন