ধারাবাহিক
উপন্যাস
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
(১২)
- কেমন দেখতে আমাকে? সারা
মুখে হাত বোলাতে বোলাতে বৃদ্ধা জানতে চেয়েছিল। প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে দেখলাম বড় কঠিন। যতই
বলতে চাইছি, কেমন দেখতে আমাকে বারেবারেই দেখছি বলতে হচ্ছে অন্যে কেমন করে দেখে আমাকে তা দিয়ে! অথচ জলে প্রতিবিম্ব
আমিও দেখেছি। দেখেছি আয়নায়। কিন্তু কীভাবে বলব? চোখগুলো টানা টানা? নাক খাড়া? ঠোঁট পুরুষালি? কিন্তু
না তো, ততটা খাড়াও না যতটা হলে আমাকে
হেলিওকাস-এর মতো দেখতে লাগত! চোখগুলো
টানা, কিন্তু উং তাই মিং-এর মতো এপার থেকে ওপার টানা না। তাহলে এই সব বিশেষণ দিয়ে আমি নিজেকে কীভাবে বর্ণনা করি? হলো না! হচ্ছে
না! বৃদ্ধাকে শ্রান্ত স্বরে জানালাম, আমাকে আমারই
মতো দেখতে। কিন্তু কেন জানতে চাইছেন?
বৃদ্ধা জানতে চাইছিলেন
তাঁর সন্তানের হত্যাকারীকে কেমন দেখতে! অশোক যখন বসেছিল উজ্জ্বয়িনীর
উদ্যানে, তখন বৃদ্ধা প্রহরীদের অনুনয়-বিনয়
করছিলেন তার কাছে যাবার জন্য। অশোকের চোখে পরে যায়, সে আসতে অনুমতি করে।
অশোক জানতে চায়-
- আমাকে ঘৃণা করবেন কি?
- চেষ্টা করব। জানি না পারব
কী না!
- কেন পারবেন না? আমি
তো হত্যাকারী।
- সেও হত্যাকারীই ছিল যে!
- কাকে হত্যা করেছে সে? প্রত্যক্ষত
শুনিনি তো! যুদ্ধের
প্রস্তুতি নিয়েছিল জানি। আমার বাহিনীকে ওরা আক্রমণও করেছিল। কিন্তু তার
বাইরে-
- প্রতি মুহূর্তে কত-শত কীট হত্যা করে চলেছি বাবা! সে, আমি,
তুমি।
- আপনি জৈন না বৌদ্ধ? সে তো
আজীবিক ছিল।
- ধম্ম? জানি
না বাবা! আমি কখন কী, সে তো আমার
হাতে ছিল না। ছোটবেলায় বাবা, বিয়ে
ইস্তক স্বামী, স্বামী চলে গেলে পর ছেলে - যে যা মেনেছে আমিও
মেনেছি।
- প্রশ্ন করেননি?
- করেছি কয়েকবার। কিন্তু
শাস্তর পড়িনি যে! অং বং চং বুঝি না বাবা!
- পালিতে তো আছে।
প্রাকৃতে।
- লিপি পড়ে কে? আমাদের
কি আর গুরুর কাছে কেউ নেয়? ঘরে পয়সা থাকলে তবু কেউ কেউ এ সব
শেখে। জানই তো বাবা সব।
খানিক নীরবতা। বিকেল হয়ে আসছে। ঘরে ফেরা পাখিরা
ডাকাডাকি করছে। বৃদ্ধা ওঠেন।
- চললেন?
- হ্যাঁ, উঠোনে প্রদীপ দিতে হবে।
- ছেলে তো আজীবিক ছিল। সে মানত এসব?
বৃদ্ধা ঘুরে দাঁড়ান। লাঠিটাকে এক হাত থেকে
অন্য হাতে নিতে নিতে বলেন,
- আমি মানি।
কন্ঠস্বর লহমায় বদলে যায়। অশোক নিঃস্তব্ধ। বৃদ্ধার বিভঙ্গ
বলছে আরো কিছু বলবেন। চুপ করে থাকে শোনার অপেক্ষায়।
- মৃত মানুষের আত্মীয়
জীবিতরাই। সগ্গো থেকে বাতি দেখতে পাক না পাক, ওঁরা যে ছিলেন এই তার
স্বীকৃতি।
- সে তো চোদ্দ পুরুষের জন্য। নারীরা?
- তুমি রাজা বাবা! তোমার
মহিষীরা তোমার পরিচয়েই তো পরিচিত। তুমিই কি দিয়েছ সে জায়গা?
- মেনে নিলেন তবে?
- মেনেই তো নেওয়া সব।
মানিয়ে নেওয়া। বুদ্ধবাবার মন্দিরেও কি নারী প্রধান পুরোহিত হয়? হবে
না, আমরা জানি। ছায়ায় ছায়ায় চলা, যতদূর
যায়।
- ভালো লাগে চলতে?
- তোমার পট্টমহিষীর কাছে
জানতে চেয়েছ বাবা, ভালো লাগে কী না তার?
- জানতে চাইব।
- চেয়ো। এখন আসি। অন্ধের রাস্তা বড় শ্লথ। গন্তব্যে যেতে
সময় লাগে।
- তাহলে আমাকে কেমন
দেখতে তা না জেনেই চললেন!
হাসলেন বুঝি বৃদ্ধা। বলিরেখা জীর্ণ মুখে
এখন আর হাসি আলাদা করে পরন্ত দিনের আলোয় চেনার উপায় নেই।
- এও মেনে নিয়েছি। জেনেই বা কী হতো! অন্য যে কোনো পুরুষের মতো তুমি, অথবা
নও। কিছু আসে যায় তাতে? যখন দৃষ্টিশক্তি ছিল তখন যে সব
পুরুষ দেখেছি তাদেরই
কারোর মুখ না হয় কল্পনা করে নেব।
- ঘৃণা? ঘৃণা
করবেন না?
- চেষ্টা করব।
- কার মুখ এখন অবধি
ভাসছে?
- জানতেই হবে?
- আপনি জানালে অবশ্যই, না
হলে না।
- তোমার অসীম জোর, চাইলে
জোর করেও তো জানতে পার!
- জোর তো সর্বত্র ফলানোর
জন্য নয় বৃদ্ধা!
- এই তো সম্রাটের
কন্ঠস্বর!
- হয়েছি যখন সম্রাট তখন তাকে
অস্বীকার করার জন্য তো হইনি!
- সেও এমন করত। যখন দেখত
আমাকে থামানো দরকার, তখন অমন গলাটা গম্ভীর করে নিত। থেমেও যেতাম। ভাবত
বুঝি খুব জয় হলো! দপদপিয়ে চলে যেত। আর আমার হাসি পেত তার
এই ছেলেমানুষী বিজয় দেখে।
- সে কে? আমাকে
শুনেও কি এমনই হাসি পাচ্ছে?
- সম্রাটকে দেখে হাসলে
আমার মুণ্ডুটাই কি ধড়ের উপর থাকবে বাবা? স্বামী
নেই, সন্তানও গেল, তবুও তো আমি আছি।
বাগানের শাকসব্জী, গাছের ফলটা-আঁশটা সামলাচ্ছি।
- সে কে?
- যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি।
- কে সে?
- যার মুখ আমি বসিয়ে নেব
তোমার মুখে।
- বলতে চান না বুঝি?
- আমার স্বামী ছিল সে।
অশোকও স্বামী। প্রজাদের। সাম্রাজ্যের। সুনীল গল্প বানাতে ভালোই পারে। সে যখন অশোকের ভূমিকায় গল্প বলে, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। এই অলিখিত গল্প যে কত সংকীর্ণ, কত
ভাণে ভর্তি, তা মনেই রাখি না।
শুধু শুনে যাই। মুহূর্ত চলে যায়। সময় আছে
কী নেই বুঝি না। দেশকাল সব ভুলে যেতে পারি। সংক্ষুব্ধতা থেকে খানিকক্ষণের বিরতি
নিই গল্পের আঁচলে। আমি শুধু শুনি। বইমেলাতে বিতস্তা এসেছিল। সেই এসেছিল। অজুহাত
যাইহোক খুঁজে নিয়ে এসেছিল। বিতস্তাকে আমি আর ঘৃণাও করতে পারি না। অথবা এত স্বল্প
তার মানে এখন যে সামান্য তেতো লেগে থাকে, আমি প্রথম ভাতের গ্রাসে মেখে
মুখে দিয়ে দিই। তারপরে অন্যান্য স্বাদে ভুলে যাই সব। বিতস্তার মুখ কি আমারই চিরকাল
মনে থাকবে? ভুলে গেলে? অন্য কারো মুখ
বসিয়ে নেব? আমিও তো ঘৃণা করেছি কতজনকে। অথবা আমি কখনো ঘৃণা
করতেই পারিনি। ভেবেছি ঘৃণা করব, তারপরে কালে কালে ভুলে গেছি।
ঘৃণা করার থেকে জরুরী অনেক কাজ থাকে। সে সব কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োগ করেছি। ভুলে
গেছি।
এই ভুলে যাওয়া থেকেই সাম্রাজ্যের জন্ম। মানুষ ভুলে যায়
শাসকের কাজ কী, শাসক তার মতোই আরেকজন মাত্র, শাসককে ভয় পেতে শুরু করে মানুষ। এবং মানুষ ভয় না পেলে শাসক ভাবে যে
সে শাসক হলো না। সেবার যেমন
যুবতীকে দেখে ভেবেছিল প্যারা-মিলিটারি ছেলেগুলো।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন