ধারাবাহিক
উপন্যাস
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
(১১)
জনপদের
আড়ালে ঘেরাটোপে রাজাদের আবর্তে যে সব রক্তপাত লেখা থাকে তা সব বৈধ। কেননা জমি
দাপের, কেননা জমি বাপের না। এর চাইতে সহজ সোজা কথা আর হয়
না। মানুষ, মানুষ হয়ে এসেছে বলে আলাদা করে পৃথিবীতে তাকে কেউ
বলেনি যে তুমি-ই সব, তোমার জন্যই সব। সে এমনটা বানিয়ে নিয়েছে
বলে এ এমন। অশোক এ কথা জানবে না বা বুঝবে না, এও কী সম্ভব!
-যখন রেখা দিয়ে আমি শরীর তৈরি করি তখন বুঝতে পারি যে
আমি দেখতে পাই। আমার স্মৃতির ভিতরে থাকা রেখা,
রঙ, বিভঙ্গ দিয়ে আমি গড়ে তুলি জীবন। চোখ বন্ধ
করলে বুঝতে পারি যে আমার মতো
সহস্র লক্ষ জন আমার আগে এই সব স্মৃতিচর্চা করে গিয়েছেন। জান,
আমি স্পষ্ট দেখতে পাই ওড্র দেশের সেই গ্রামটি। যার পাশ দিয়ে এক নদী
বয়ে গিয়ে কাছেই সমুদ্রে মিশেছে। মোহনার পাশের সেই গ্রামে, মাটির
ঘরের দাওয়ায় বসে আছে শিশুরা। উঠোনে দুই শিল্পী সকালের রোদ কাজে লাগিয়ে নিমগ্ন হয়ে
এঁকে যাচ্ছেন। কিছুটা দূরে সেই উঠোনেই তৈরি হচ্ছে রঙ। পানপাতা,
রাঙা মাটি, চুন নানা প্রকার মিশিয়ে সেই রঙ
হচ্ছে। আগুন জ্বলছে। প্রথমে ক্কাথ তৈরি হবে,
তারপরে সেই ক্কাথ জলে ভিজবে। দু-একদিন জলে ভেজার পরে তার থেকে
বেরিয়ে আসবে রঙ। কিন্তু সবটাই পরিমাণমতো
হতে হবে। একটু এদিক ওদিক হলেই রঙ নষ্ট। সে সব রঙ প্রাকৃতিক।
এই যে তোমাদের আর্ট স্কুলে যে সব রঙ ব্যবহার শেখায়, সেই সব
রঙ এর ধারেকাছেও আসে না। তার লাল, নীল, সবুজ সমস্ত আলাদা।
-তুমি তো যাওনি কখনো ওড়িষ্যা!
-যেতে হয় না। শুধু চোখ বুজলেই চলে।
-সে রঙ বানাও না কেন?
-চেষ্টা করি। সেই শৈশব থেকে চেষ্টা করে
আসছি অমন রঙ বানাতে।
-তাই?
-একবার, এক সাধু
এসেছিল আমাদের গ্রামে। দরজায় দরজায় ঘুরছিল ভিক্ষাপাত্র নিয়ে। আমাদের ঘরেও এসেছিল।
আমি তখন মাটি নিয়ে নাড়ছিলাম-ঘাঁটছিলাম। সাধু এসে ভিক্ষা চাইল। আমরা সবাই শুনেছি,
কিন্তু কেউ-ই নড়ছিলাম না। ভিক্ষা দেব কি? তার
আগে দু’দিন
আমাদের ঘরে উনোন
জ্বলেনি। বন থেকে পাতা, শাক তুলে এনে
খাচ্ছিলাম ক’দিন।
কাঠ জ্বেলে সেদ্ধ করে খাওয়া। কাঠ ফুরোলো। শাক-পাতা ফুরোলো।
মায়ের গায়ে ভীষণ ব্যথা। নড়তে পারছে না। বাবা নড়বে না। কাঠ আসছে না। এলেও জ্বালাবে কী দিয়ে?
শলাই নেই। উনোন
জ্বলা বন্ধ। আমি আর ভাই দুজনে ফলমূল এনেছিলাম। তাই
দিয়ে শেষ দু’দিন
যা হোক চলছিল। বাবা বাইরে গেছে। একরাম আলি-র ঘরে গিয়ে
তাড়ি খেয়ে চলে এসেছে। ছবি আঁকা ছাড়া বাবা অন্য কিচ্ছু করবে না। হাতের কাজ ভালো। মা বলেওছে অনেকবার,
অন্তত ঘরামির কাজ মাঝে মাঝে করতে! করবে
না তো করবেই না। জাতধম্ম নষ্ট হবে তাতে। সাধু ভিক্ষে চাইছে,
আমরা চুপ করে বসে আছি। আমি আর পারলাম না। উঠে গেলাম। হাতের মধ্যে যা
মাটি ছিল সব দিয়ে দিলাম সাধুকে। ওই মাটি আমি আনতাম ঝর্ণার ধার থেকে। অনেকটা হেঁটে
যেতে হতো। ওই মাটি আমার খুব প্রিয়। নানা
রকম জিনিস বানাতে চেষ্টা করতাম। বাবা দেখত, কিন্তু বাধাও দিত
না, শেখাতও না। সেই মাটি দিয়ে দিলাম। সাধু হাসল। হাত
তুলে আমাকে আশীর্বাদ করে বলল, আমি একদিন রাজা
হব। -- আমি একদিন রাজা হব! হা হা হা হা হা!
সুনীলের হাসির শব্দে যেন চারপাশের
বড় বড় বিল্ডিংগুলোও কেঁপে কেঁপে উঠছিল। বইমেলার পাশের মাঠে আমি আর সুনীল বসে আছি।
আমাদের সামনে বাংলা মদের বোতল। জল-ও দিচ্ছি না। ঢেলে নিচ্ছি গলায়। কেঁপে উঠতেই আমি
ভাবলাম উঁচু উঁচু ক্রেনগুলো এবারে বোধ হয় পরে যাবে। প্রচন্ড একটা শব্দ হবে। সুনীলের
হাসি শেষ হয়ে গেল। হলুদ হ্যালোজেনমাখা মাঠ ও শূন্যতা যে যার জায়গায় ফিরে এলো, যেন পুকুরের জল,
কিচ্ছু বদলালো না।
-আমি অশোক হয়ে গেলাম।
-অশোক?
-কেন? পড়নি
দিব্যাবদান? জান না?
-কি যেন
-অশোক বাল্যকালে বুদ্ধকে ভিক্ষা দিয়েছিল
মাটি, ভেবেছিল সোনা হয়ে যাবে ধুলোমুঠি। ‘What a kingly jest was it...!’
-ওহ হ্যাঁ! বুদ্ধ বলেছিল এই শিশু একদিন
রাজচক্রবর্তী হবে। তুমি-ও? সাধুকে দিয়ে?
-হ্যাঁ! মাটি আমিও দিয়েছি। মাটি, যা আমি নিজের করে পাইনি, আমাদের গুষ্টিতে কেউ কখনো
পায়নি, যতবার ভেবেছে এ মাটি আমার ততবার তাকে সরে যেতে হয়েছে
দেশ থেকে দেশান্তরে, সেই মাটি আমি দিয়ে দিয়েছি সন্ন্যাসীকে।
আমি রাজা না? তবে কে রাজা? রাজা-ও তো
তাই করে! যা তার না, তার হবার কোনো কারণ নেই যার, তা সে ভোগ করে। ছলে, বলে, কৌশলে।
-পেলে তা?
-সুসীমকে ডেকে এনেছিলাম। আমি তার অনুগত
প্রমাণ দেবার জন্য তাকে ডেকেছিলাম। আমার আনুগত্যের জ্বলন্ত প্রমাণ সে পেয়েছিল।
-তাকে তুমি পুড়িয়ে মেরেছিলে!
-ঈর্ষা, সন্দেহ,
অক্ষমতায় সে জ্বলছিলই আজীবন। সেই জ্বলনকে আমি শুধু বাহ্যিক রূপ
দিয়েছি।
-বাকীদের?
-সাম্রাজ্য রক্ষা করতে গেলে সামর্থ্য
লাগে!
-যা তোমার না তা রাখতে গেলে সব সময়েই
শক্তির প্রয়োজন হয়।
-যুবতীর গায়ে যে ছাপগুলো জমাট হয়ে আছে,
নীল রঙের, ওগুলোও শক্তির চিহ্ন।
সুনীলের অশোক হওয়া,
একে আমি উন্মাদনা আলাদা করে না বললেও জানি এ ভারসাম্যের অভাব।
কিন্তু সে অভাব তো রাষ্ট্রের থাকার কথা না। তবে রাষ্ট্র কুত্তা পোষে কেন? কেন লেলিয়ে দেয় অসহায় দেশবাসীর উপর? তবু আমাকে তো
বলতেই হবে। যদি সুনীল ক্রমে সরে যায় সাম্রাজ্য, দখল আর
ক্রুরতার মধ্যে তাহলে আমি বাধা দিয়েছি এও তো আমার জানা দরকার!
-দুই কি এক নাকি?
-না নয়! বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়
সত্যিটা! আমি ওদের না মারলে ওরা আমাকে মারত।
এটাই নিয়ম। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেতে হবে। ক্ষমতাও এমন কাউকে
চায় না যে তার পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতে সক্ষম না। আমি যে হত্যা করছি তা সকলে দেখছে।
সকলে বুঝছে, মাপছে আমাকে। চারটে প্রদেশ, তক্ষশীলা
থেকে উজ্জ্বয়িনী, সর্বত্র যারা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত তারা
বুঝে নিতে চাইছে এই যে যুবক, রাজা হতে চায়, তার এলেম কত! সেই
অনুযায়ী তারা সন্ধি বা যুদ্ধ করবে। ব্রাহ্মণীর গর্ভে জন্ম আমার,
তা বলে আমি দুর্বল নই, এ প্রমাণ আমাকে দিতেই হবে। শাসনে
সক্ষম তার প্রমাণ আমি দিয়েছি আগেই। এবারে আমি যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তার প্রমাণ দিতে হবে।
কিন্তু যুবতীকে যারা ধর্ষণ করেছে তারা কি প্রমাণ দিতে চেয়েছিল?
দুর্বলকে নিয়ে তারা যা খুশী তাই করতে পারে তার প্রমাণ? যুবতী ওদের খুন করতে গেছিল? ওদের ঘর-দোর লুঠ করে
আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল? সার্চের নামে ঘরে ঘরে গিয়ে জিনিসপত্র
ভেঙে, নারীদের যৌন অত্যাচার করে, শিশুদের
মেরে সন্ত্রাস দেখাতে গিয়েছিল?
-আজীবিকরা কি অপরাধ করেছিল অশোক?
-বিতস্তা কি অপরাধ করেছিল?
অপরাধ?
বিতস্তাকে লেখা চিঠিটার কথা মনে এলো। চিঠি, কাগজে কলমে লেখা। ই- মেল না। এ চিঠি একমাত্র পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প
মেখে যেতে পারত ডাকহরকরার হাত দিয়ে। যায়নি।
“মশারির
মধ্যে জ্বলা নীলাভ খাট ভালো
লাগেনি কখনো! আকাশ ঢেকে দেওয়া ছাদ- ও
না। আজীবন ভেবেছিলাম তুমি কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে! হাত ধরে চেনাবে একে
একে সমুদ্র, পাহাড়, আকাশ, নক্ষত্র নকশা। চেনাবে গ্রন্থিগুলোর রহস্য।
অবাক বিস্ময়ে
ডুবে যাব ডোবার অতীত মহাসমুদ্রে। তুমি উন্মোচিত হলে যে সূর্যোদয় তার ছটায়
মন আলো আলো হবে। সেই কবে চলে এসেছি রেলকোয়ার্টার ছেড়ে। উঠোনের নিমগাছ,
অতটা খোলা জমির অক্সিজেন হারিয়ে দিনে দিনে হাঁফানিতে পেয়েছে। পুকুরে
সাঁতার কেটে হৃদযন্ত্রকে সবল রেখেছিলাম তুমি আসবে বলে। বেড়াতে গেলে তোমার দৌড়-ছুটের সঙ্গে যদি না পারি, তাহলে হবে
না। তুমি আসবে বলে সাত সতেরো তিক্ততাকেও এড়িয়ে গিয়েছি, ভুলে
গিয়েছি। মনে রাখলে যদি তোমাকে তেতো দিয়ে ফেলি তাই ফেলে দিয়েছি সব। প্রতিদিন ভেবেছি,
তুমি এলেই বেড়াতে নিয়ে যাবে। এমন ভ্রমণ আমার জন্ম সার্থক করে যাবে।
সেই অলৌকিক ভ্রমণে শেষ হয়ে যাবে আশা ও আকাঙ্ক্ষা সব। শান্ত মনে চলে যেতে পারব।
মুচকি হাসতে হাসতে, গুনগুন করতে করতে, চলে
যাওয়া যাবে। গুনগুনাব - এমন মানব জনম আর কি হবে/ মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে! আর
মিচকি মিচকি হাসব। সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হতে চাইনি, তাজমহল
বানিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে ফোটোসেশন করতে চাইনি, হাতে লোকের
মাথা কেটে নিয়ে ফূর্তি করতে চাইনি - তবে আর সমস্যা কী! জীবনে যা চেয়েছি তা পেয়ে
গেছি! ভাবের ঘরে তুমুল রোশনাই। একেবারে নহবতে সানাই।
কখনো ভাবিনি আমাকে বেড়াতে নিয়ে
যেতে পারবে এমন বিরাট তুমি নাও হতে পার! ভাবনার ভুল ঢাকা যাবে এমন অন্ধকারও আজ
কোত্থাও নেই। এখন কৃত্রিম আলো্য মুখ জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়।
শুধু ভুল জ্বলে না”।
এই ভুল আমার। অপরাধ বিতস্তার।
আমাকে তার জীবনে জড়িয়ে সে কাদায় নামিয়ে এনেছিল, অথচ আমি কাদার কেউ
ছিলাম না। প্রত্যেকটা মুহূর্ত
সে শুধু ব্যপারীপনা করে গিয়েছে। বাজারীপনা করেছে। একেক
রাস্তা হেঁটেছে আর খুঁজে নিয়েছে কার থেকে কিসের বিনিময়ে সে কী পেতে পারে! এই তার
চলা। আমি এ চলার কেউ ছিলাম না।
-আমি না খুব মেটিরিয়ালিস্ট হয়ে যাচ্ছি।
-বুঝছ যখন তখন হচ্ছ কেন?
-কী বাজে না? এই
দেখ, নতুন ফোন।
ফোনটা পছন্দ করার সময় আমি ছিলাম।
থাকার কথা না, দেখা হয়েছিল বলে ছিলাম। ফোনটা কেনার সময় ছিল
গৌহাটির স্বপনদা। তার স্বপনদা গৌহাটি থেকে কলকাতায় আসে। বড় ব্যবসায়ী। গৌহাটিতে বিতস্তাকে ক্লায়েন্ট দেয়। কলকাতা এলে বিতস্তার জন্য নিয়ে আসে হুইস্কির
বোতল। সবই এমনি এমনি। বিবাহিত স্বপনদার বিতস্তার জীবন নিয়ে খুব সমব্যথা আছে।
বিতস্তার বিয়ে ভেঙে যাওয়া, তার উপর ঘটা অত্যাচার এ সব নিয়ে
স্বপনদা খুব উদ্বিগ্ন। বিতস্তা স্বপনদার জীবনে বিয়ের বাইরে
বারান্দা। হাওয়া খেলে যায় সেখানে। পুলকে ছবি ওঠে ফোন কেনার পরে যুগলের। বিতস্তা
অম্লান মুখে জানায় এই ফোন তাকে তার অফিস দিয়েছে। স্বপন দিয়েছে শুনলে আমি জানতে
চাইতে পারি হঠাৎ কেন! তার চেয়ে অফিস ভালো। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। এ
জগতে এ সময় এমনি এমনি কেউ কাউকে দিনের পর দিন দিয়েছে, এ মেনে
নেওয়ার মতো
নির্বোধও আমি না। বিতস্তা এ কথা খুব ভালো
করে জানে। তাই এই খেলা।
-না, অপরাধ
বিতস্তার না। অপরাধ আমার।
-কী
অপরাধ?
-বুঝতে না চাওয়ার অপরাধ।
-কী
বুঝতে চাওনি তুমি?
-যখন যখন সংকেতগুলো পেয়েছি তখন তখন তাকে
এড়িয়ে গিয়েছি।
-কী রকম?
-শীতের রাতগুলো মনে পরে। অথবা ভোরগুলো।
বিতস্তার অফিসে তখন ভোরের শিফট চলছে। হু হু ঠান্ডার মধ্যে রাত তিনটেতে উঠে বেরিয়ে
যেতাম। অনুপমের বাইক নিয়ে চলে যেতাম। বিতস্তাকে বাড়ি থেকে তুলতাম, নামিয়ে দিতাম অফিসে, চলে আসতাম।
-তাতে কী সংকেত ছিল?
-একদিন বিতস্তার খেয়াল হলো,
ও বাইক চালাবে।
-বাইক চালাতে জানে?
-জানে।
-আচ্ছা! তারপর?
-বাইক চালাতে শুরু করল। খানিকবাদেই থেমে
গেল। বলল, এই ঠান্ডায় একমাত্র কুত্তারা ছাড়া কেউ বাইক চালাতে
পারে না। তখনই বোঝা উচিত ছিল।
-কী?
-বাইকটা থামিয়ে যখন দিল তখন তো আমাকেই
চালাতে হলো
আবার! তাহলে কুত্তাটা কে?
-পুষেছিল তোমাকে?
-একে তো পোষাই বলে! অন্তত পোষার ভাবনা।
-ভালো লাগেনি, না?
-না! প্রচন্ড রাগ হয়েছিল। নিজের উপর নিজের
বিতৃষ্ণা বেড়েছিল। এত কেন ভালোবাসব
যে নিজেকে নিজের কাছেও ছোট করে ফেলতে হবে?
-আজীবিকরা ভেবেছিল আমাকে পুষেছে ওরা! বা
আমাদের!
-কেন?
-মহারাজ বিন্দুসারের সময় যখন আচার্য
বিদ্রোহ করেছিলেন তারপর থেকে উজ্জ্বয়িনী ছিল আমার শাসনে। আচার্যকে দমন করেছিলাম,
কিন্তু মন্ত্রী সভার পরিবর্তন ঘটাইনি আমি। পিতা আজীবিক মতকে মেনে
নিয়েছিলেন। তাঁর গুরু ছিলেন আজীবিক ব্রাহ্মণ পিঙ্গলাবৎস। আচার্য গোশালার শিষ্য
ইনি। নিয়তিবাদীতা এঁদের মতবাদে বড় স্থান নিয়েছে। পিতাও নিয়তিবাদকে বিশ্বাস করতেন।
বিশ্বাস করতেন মাতাও। অতএব এই দুজনের সন্তান আমি ওঁদের বিশ্বাস করতে বাধ্য থাকব,
এমনটাই ধারণা ছিল ওঁদের।
-তুমি তো হওনি বাধ্য।
-না। বাধ্যতা বিশ্বাস থেকে আসে না,
আসে আচরণ থেকে। রাজসিংহাসনে আমি বসার পর থেকে একের পর এক যুদ্ধে
ব্যস্ত থেকেছি। সাম্রাজ্যের নানা অংশকে রক্ষা করতে, শক্তিশালী
করতে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে গেছি। পিতা যে সাম্রাজ্য রেখেছিলেন আমি তাকে বহুগুণ
বিস্তৃত করেছিলাম। হয়তো বা দক্ষিণের অংশও আমি জয় করে নিতাম যদি না কলিঙ্গ যুদ্ধের
পরে আমি থামতাম।
-কেন থেমেছিলে?
-এখন থাক সে কথা! আগে বলি আজীবিকদের কথা।
-বল।
-কলিঙ্গ যুদ্ধের পর আমি যখন যুদ্ধ থেকে
সরে এলাম, শাসনে মন দিলাম, তখন আজীবিকরা
ভেবেছিলেন আমি তাঁদের মতে চলব। উজ্জ্বয়িনী ছিল তাঁদের অন্যতম বসতি।
সেখানে আমি শাসক ছিলাম। এঁদের বহুজনার সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ছিল যথাযথ। পিতা-মাতার
কথা তো বলেইছি তোমাকে। তাঁরা এ সব থেকে ভেবে নিয়েছিল আমিও তাহলে পিতার মতোই তাঁদের কাউকে গুরু
বলে বরণ করে নেব। তাঁরা শক্তিশালী হবেন। পিতামহের
রাজত্বের শেষ দিকে শক্তিশালী হয়েছিলেন জৈনরা। নটপুত্ত-র সঙ্গে মোক্ষলি গোশালার
বিরোধ নিশ্চই জান।
-আচার্য গোশালা নটপুত্ত অর্থাৎ মহাবীরের
শিষ্য বা সঙ্গী ছিলেন একদা। নিয়তিবাদীতা নিয়ে দুজনের মধ্যে বিরোধ বাধে। গোশালা
নিয়তিকেই মান্য করে যাগযজ্ঞের বিরোধ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, যদি নিয়তিই সব হয় তাহলে
যাগযজ্ঞ করে লাভ কোথা থেকে হবে! কিন্তু মহাবীর মানেননি। যাগযজ্ঞের বিরোধী ছিলেন
মহাবীর, কিন্তু তা বলে নিয়তিকেই সব বলে স্বীকারে ইচ্ছুক
ছিলেন না। মোক্ষ ছিল বড় বিষয়। মহাবীর যখন গোশালার মতকে
গ্রহণ করলেন না, তখন গোশালা ত্যাগ করলেন মহাবীরের সঙ্গ। সেই
থেকে জৈনরা গোশালাকে সইতে পারেন না।
-নটপুত্তের কাছেই আশ্রয় নিয়েছিলেন জন্মের
পরে দাস হয়ে যাওয়া আচার্য মোক্ষলি গোশালা। দাসজীবন থেকে পালিয়ে এসে এই আশ্রয়
নেওয়া। সেই আশ্রয় ত্যাগ করে আশ্রয়দাতার বিরোধ কেউ-ই সইবে না, জৈনরাও সহ্য করেনি। গোশালার শিষ্যরা সাম্রাজ্যে প্রধান হবেন বলে আশা
করেছিলেন পিতার আমলে। পিতা কিন্তু ব্রাহ্মণ-ভট্টদের মঠেও দান করেছেন। প্রাধান্য
পায়নি কেউ-ই। আমি যখন রাজা তখন তারা ভেবেছিল যে তারা আমার বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করবে
সম্পূর্ণত। কিন্তু তাদের অনুগৃহীত করা সম্ভবপর ছিল না। তারা সাম্রাজ্যের জন্য
নিরাপদ না।
-কেন?
হাসল সুনীল। তারপরে মাথার বড় ও
অবিন্যস্ত চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে অশোক হয়ে গেল আবার।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন